Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিধানসভায় তুলকালাম, বিল ঘিরে ধস্তাধস্তি, অসুস্থ মান্নান বেরোলেন স্ট্রেচারে

সম্পত্তি ভাঙচুরে কড়া শাস্তির বিধান দিতে বিল পেশ করল রাজ্য সরকার। আর সেই বিল পেশের দিনেই ধুন্ধুমার বাধল বিধানসভায়! সরকারি নিরাপত্তারক্ষী ও বিরোধী পক্ষের বিধায়কদের ধস্তাধস্তিতে অসুস্থ বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানকে হাসপাতালে পাঠাতে হল।

বিধানসভা থেকে বার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অসুস্থ বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানকে। বুধবার প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।

বিধানসভা থেকে বার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অসুস্থ বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানকে। বুধবার প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৪৫
Share: Save:

সম্পত্তি ভাঙচুরে কড়া শাস্তির বিধান দিতে বিল পেশ করল রাজ্য সরকার। আর সেই বিল পেশের দিনেই ধুন্ধুমার বাধল বিধানসভায়! সরকারি নিরাপত্তারক্ষী ও বিরোধী পক্ষের বিধায়কদের ধস্তাধস্তিতে অসুস্থ বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানকে হাসপাতালে পাঠাতে হল। সভার মধ্যেই তাঁদের আক্রমণ ও শ্লীলতাহানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ আনলেন বিরোধী শিবিরের অন্তত দু’জন মহিলা বিধায়ক। এই কুরুক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বিধানসভার আসবাবের মূল্য নির্ধারণের নির্দেশ দিলেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়।

এক কথায়— সম্পত্তি ভাঙচুরের বিহিত করার জন্য যে আইনি সংস্থান রেখে বিধানসভায় বিল এল, তার প্রয়োগ শুরু করতে হচ্ছে বিধানসভা থেকেই!

ভাঙচুর ঠেকানোর নামে রাজ্য সরকার প্রতিবাদ-আন্দোলনের কণ্ঠ রোধ করতে চাইছে বলে অভিযোগ তুলে গোড়া থেকেই বিলের বিরোধিতা করছিল কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট। তাদের অভিযোগ, ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে বিধানসভায় ভাঙচুর চালিয়েছিলেন তৃণমূলের বিধায়কেরা। কাজেই এমন বিল তৈরির নৈতিক অধিকার তৃণমূলের আছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন বিরোধীরা। ২০০৬-এর সেই ভাঙচুরের ঘটনার ছবি সংবলিত অ্যাপ্রন গলায় পরেই বুধবার সভাকক্ষে ঢুকেছিলেন কংগ্রেস ও বাম বিধায়কেরা। উত্তেজনার সূত্রপাত সেই ছবি থেকেই।

পোস্টারের অ্যাপ্রন না খোলায় মান্নানকে সভা থেকে সাসপেন্ড করেন স্পিকার। সঙ্গে সঙ্গেই কংগ্রেস বিধায়কেরা ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন। কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী দৌড়ে গিয়ে স্পিকারের ন্যায়দণ্ড তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে বাধা দেন মার্শাল। কেন মান্নানকে সভা থেকে বার করে দেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়ে নাগাড়ে মন্তব্য করতে থাকে শাসক বেঞ্চ। স্পিকারের নির্দেশ সত্ত্বেও মান্নান সভায় থেকে যাওয়ায় মার্শাল দিয়ে তাঁকে বার করে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তখন বিরোধী দলনেতাকে আগলে রাখতে গিয়ে সরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়েন বাম ও কংগ্রেস বিধায়কেরা।

বিধানসভা থেকে আজ ওয়াকআউট করেছেন কংগ্রেস ও বাম বিধায়করা। যৌথ বিক্ষোভ করেছেন তাঁরা। (প্রতীকী ছবি / সংগৃহীত)

ওয়েলে নেমে পড়েন শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কয়েক জন মন্ত্রীও। নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বিরোধীদের ধস্তাধস্তি দেখে শাসক দলের কয়েক জন বিধায়ক সে দিকে এগোতে যান। পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস তাঁদের নিরস্ত করেন। বড়ঞার কংগ্রেস বিধায়ক প্রতিমা রজককে সভাকক্ষ থেকে টানতে টানতে বার করে দেন মহিলা নিরাপত্তারক্ষীরা। কংগ্রেস বিধায়ক আশিস মার্জিতকেও একই ভাবে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন নিরাপত্তারক্ষীরা। আক্রান্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ তোলেন সিপিএমের বিধায়ক জাহানারা খানও।

এই টানাহেঁচড়ার মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মান্নান। স্ট্রেচারে করে সভার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। ভর্তি করা হয় লেনিন সরণির একটি হাসপাতালে। তাঁর অস্থায়ী পেসমেকার বসাতে হয়েছে। চিকিৎসক শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে আইসিইউ-এ থাকলেও মান্নানের অবস্থা স্থিতিশীল বলে হাসপাতালের বক্তব্য।

শেষ পর্যন্ত প্রায় বিরোধীশূন্য সভায় বিলটি পাশ হয়ে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের রসদ পেয়ে গিয়েছে বিরোধীরা। বামফ্রন্ট যেমন আজ, বৃহস্পতিবারই রাজ্য জু়ড়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে। কলকাতায় ধর্মতলা থেকে মৌলালি পর্যন্ত আজ মিছিল করবে তারা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, ‘‘বিরোধী দলনেতার উপরে বর্বরোচিত কায়দায় হামলা করা হয়েছে। সরকারের যদি বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করার স্বাধিকার থাকে, আমাদেরও প্রতিবাদের অধিকার আছে! আইন ভেঙেই এই আইনের প্রতিবাদ হবে!’’ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী নেত্রী থাকার সময়ে ‘বহু কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন’ বলেও মন্তব্য করেছেন সূর্যবাবু। একই সুরে প্রধান বিরোধী দলের সচেতক মনোজ চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘ল ব্রেকার আজ ল মেকার হয়েছে! এই কালা কানুন মানব না।’’ হামলার প্রতিবাদে বাম ও কংগ্রেস আগামী দু’দিন বিধানসভা বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে, আজ শিক্ষায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিল এবং কাল, শুক্রবার রাজ্য বাজেটের সময়ে সভায় থাকবেন না দুই বিরোধী দলের বিধায়কেরা। তার বদলে বিধানসভা চত্বরে ধর্নায় বসবেন তাঁরা। যেখানে কাল, শুক্রবার সামিল হতে পারেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও। মান্নানের এলাকা শেওড়াফুলিতে এ দিন সন্ধ্যাতেই রেল এবং জি টি রোড অবরোধ করেন কংগ্রেস এবং সিপিএম সমর্থকেরা।

আরও পড়ুন:

প্রেমিকই মেয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী, থানায় গেলেন বিতস্তার মা

শশিকলার সঙ্গে শতাধিক বিধায়ক, তবু আস্থাভোটের পথেই হাঁটছেন পনীর

তুলকালামের সময়ে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য সভায় ছিলেন না। নিজের ঘর থেকে তিনি সভায় ঢোকেন ঘটনার পর। বিলের পক্ষে মমতা এ দিন সভায় বলেছেন, ‘‘এই আইন দাঙ্গাকারী, হামলাকারীদের স্তব্ধ করবে। কিছু করে খাওয়ার কাজকে মদত দেয় যারা, তাদের জব্দ করবে এই আইন।’’ তিনি জানিয়েছেন, এই সংক্রান্ত মামলার দ্রুত বিচারের জন্য ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট গড়া হবে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘মানুষের সম্পত্তি জ্বালিয়ে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও যারা বলবে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’’ বিরোধীদের প্রতি মমতার কটাক্ষ, ‘‘অপদার্থতা যাদের একমাত্র শক্তি, তারা তো এর বিরোধিতা করবেই!’’

মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের জবাবে বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘বিরোধী থাকার সময়ে বিধানসভায় ভাঙচুর কারা করেছিল?

এই সরকারের আমলে ২০১৩ সালে শুধু এক রাতেই আমাদের ১২০০ পার্টি অফিস ভাঙা হয়েছে। এমন বিল আনতে হলে সরকারের আগে উচিত ছিল হাতজোড় করে ক্ষমাপ্রার্থনা করা!’’ কংগ্রেসের সুখবিলাস বর্মা, নেপাল মাহাতোরা বিলের ধারা দেখিয়ে সভার বাইরে দাবি করেছেন, সংশোধনী আইনে আদালতের এক্তিয়ারের সঙ্গে প্রশাসনিক ক্ষমতার সংঘাত রয়েছে।

সরকার পক্ষের অবশ্য দাবি, যে ভাবে যে কোনও অছিলায় থানা আক্রমণ, পুলিশের গাড়িতে আগুন বা বাড়ি ভাঙচুরের প্রবণতা বাড়ছে, তা সামাল দিতেই পুরনো আইন সংশোধন করা হল। পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘পুরনো বিলে শুধু সরকারি সম্পত্তির কথা ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার জনগণের সম্পত্তিও রক্ষা করতে চায় বলে সংশোধনী আনা হল।’’

বিরোধী দলনেতাকে পাল্টা দুষে পার্থবাবুর আরও দাবি, ‘‘সভায় স্পিকারের নির্দেশই শেষ কথা, ওঁর মতো প্রবীণ বিধায়কের জানা উচিত! উনি স্পিকারের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ, অশালীন আচরণ করে বাকিদের প্ররোচিত করেছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Abdul Mannan assembly
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE