Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সরকারি অবহেলায় বন্ধ ফল-সব্জি রফতানি

জুটমিল, কয়লা খনির পর এ বার ফল-সব্জি রফতানি। সরকারি অবহেলা আর শাসকদলের ‘দাদাগিরি’তে রাজ্যে অব্যাহত ব্যবসা বন্ধের অভিযোগ। এক দিকে যখন সিঙ্গাপুর সফরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিদেশি শিল্পপতিদের রাজ্যে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছেন সেখানে রাজ্যের ছোট ব্যবসায়ীরা আঙুল তুলছেন সরকারের বিরুদ্ধেই। অভিযোগ, রাজ্য সরকার কোনও রকম সাহায্য না করায় গত জুলাই থেকে বন্ধ হয়েছে রাজ্য থেকে বিদেশে ফল-সব্জি রফতানি।

বেহাল প্যাক হাউস। সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

বেহাল প্যাক হাউস। সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৪ ০২:৩৬
Share: Save:

জুটমিল, কয়লা খনির পর এ বার ফল-সব্জি রফতানি। সরকারি অবহেলা আর শাসকদলের ‘দাদাগিরি’তে রাজ্যে অব্যাহত ব্যবসা বন্ধের অভিযোগ।

এক দিকে যখন সিঙ্গাপুর সফরে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিদেশি শিল্পপতিদের রাজ্যে বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছেন সেখানে রাজ্যের ছোট ব্যবসায়ীরা আঙুল তুলছেন সরকারের বিরুদ্ধেই। অভিযোগ, রাজ্য সরকার কোনও রকম সাহায্য না করায় গত জুলাই থেকে বন্ধ হয়েছে রাজ্য থেকে বিদেশে ফল-সব্জি রফতানি। দক্ষ কর্মীর অভাব, পরিকাঠামো সংস্কারের প্রশাসনিক কর্তাদের ঢিলেমিতে নাজেহাল ব্যবসায়ীরা জীবিকা বাঁচাতে নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করে সরকারি ভবন সংস্কার করছেন। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের ‘চোখ রাঙানি’, কর্মী নিয়োগের সুপারিশ সব মিলিয়ে তালা পড়েছে শিল্পকেন্দ্রে!

২০০৭ সালে কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের অনুমোদনে উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে ১২ কাঠা জমির উপরে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ফল-সব্জি সংরক্ষণ করে বিদেশে রফতানির জন্য একটি প্যাক হাউস তৈরি হয়। তবে এত দিন সেটি ব্যবহার না করেই মাসে প্রায় ৮ কোটি টাকার ফল ও সব্জি বিদেশে রফতানি করে আসছিলেন জনা পনেরো ব্যবসায়ী। কলকাতা বিমানবন্দরের হিমঘরেই সব পণ্য জড়ো করে পাঠিয়ে দেওয়া হতো বিদেশে। ব্যবসায় বাদ সাধে গত ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি নির্দেশিকা। ওই নির্দেশিকায় সাফ জানানো হয়, আন্তর্জাতিক নিময় মেনে প্যাক হাউসে সংরক্ষণ করলে তবেই বিদেশে পণ্য রফতানির ছাড়পত্র মিলবে।

এই নির্দেশে প্রশ্নের মুখে পড়ে রাজ্যের ১৫ জন ফল-সব্জি রফতানিকারীর রুজিরুটি। সমস্যা মেটাতে রফতানিকারী সংস্থাগুলি একজোট হয়ে তৈরি করে ‘ওয়েস্টবেঙ্গল ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশন’। তারা রাজ্যে একটি প্যাক হাউসের আবেদন জানিয়ে ২১ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দেয়। তাঁদের দাবি, রাজ্যে যে একটি প্যাক-হাউস রয়েছে, তা তাঁরা জানতেনই না।

সংগঠনের সম্পাদক মৃণাল সিংহের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে ফ্যাক্স ও ই-মেল করা হয়েছে। বার বার যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু তার কোনও উত্তর মেলেনি।” শেষে দিল্লির দারস্থ হয় অ্যাসোসিয়েশন। কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের পরামর্শে তাদেরই অধীনস্থ ‘এগ্রিকালচারাল প্রসেস ফুড এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’র (অ্যাপেডা) দ্বারস্থ হন। সেখানেই জানতে পারেন রাজ্যের একমাত্র প্যাক-হাউসের উপস্থিতির কথা। প্যাক-হাউসটি দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানপালন দফতর।

অ্যাপেডার মধ্যস্থতায় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতর থেকে ১ এপ্রিল প্যাক-হাউস ভাড়া নেয় অ্যাসোসিয়েশন। মাসে সিকিওরিটি বাবদ ৪৭ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ সংযোগ বাবদ ২৫ হাজার টাকা এবং অতিরিক্ত ৪৫ হাজার টাকা দেয় সংগঠন। অভিযোগ, প্যাক-হাউস হাতে পেয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন সেখানে কোনও পরিকাঠামোই নেই। হিমঘরের বাতানুকূল যন্ত্র খারাপ, কাজ করে না অন্য যন্ত্রপাতিও। এই অবস্থায় জুলাইয়ের মাঝামাঝি কার্যত রফতানি বন্ধ করে দিতে বন্ধ হন ব্যবসায়ীরা।

অবশ্য খাদ্য প্রক্রিয়া দফতরের এক কর্তার সাফাই, “২০০৭ সালে প্যাক-হাউস তৈরির পরে পাঁচটি বেসরকারি সংস্থা হাউসটি ভাড়া নেয়। গত প্রায় এক বছর প্যাক-হাউস কেউ ভাড়া নেয়নি। তাই এই বেহাল দশা। যন্ত্রে মরচে পড়ে, ছাদ দিয়ে জল পড়ে। মালপত্র চুরিও হয়ে গিয়েছে।”

রফতানিকারীদের অভিযোগ, রাজ্য সরকারের সহযোগিতা না পেয়ে প্যাক-হাউসটির অবস্থার কথা তাঁরা অ্যাপেডাকে জানান। অ্যাপেডা সংস্কারের জন্য টাকা দিতে রাজিও হয়। তবে নোডাল দফতর হিসেবে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতর প্রকল্প-রিপোর্ট না পাঠানোয় কাজে হাত দেওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে নিজেরাই ৪ লক্ষ টাকা খরচ করে, কিছু সংস্কারের করে ২৩ মে থেকে ফের ফল-সব্জি প্যাকিংয়ের কাজ শুরু করেন রফতানিকারীরা। তবে সমস্যা তাতেও মেটেনি।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এ পরে শুরু হয় তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের চাপ। তাঁদের ‘চোখ রাঙানি’তে স্থানীয় ১৪ জন স্থানীয় যুবককে মাস-মাইনে দিয়ে নিয়োগ করতে হয়। কিন্তু তাঁদের সব্জি বা ফল প্যাকেজিংয়ের কোনও প্রশিক্ষণ নেই। কর্মীরা নিয়ম মেনে কাজ করতে চান না বলেও দাবি তাঁদের। স্থানীয় তৃণমূল নেতা খোদাবক্স অবশ্য জোর জবরদস্তির যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘‘প্যাক-হাউসে কর্মীর দরকার ছিল। এলাকার ১৪টি ছেলেকে কাজে ঢুকিয়েছিলাম। কিন্তু খবরদারি করিনি।” স্থানীয় সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার বলেন, “বিষয়টি জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখব।” আর খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর কথায়, “আমি অফিসারদের প্যাক-হাউসটির ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলেছি। কী কী সমস্যা হচ্ছে তাও দেখা হচ্ছে।”

তবে প্রতিশ্রুতিতে আর ভরসা রাখতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। তাঁদের বক্তব্য, “এতদিন ধরে আশ্বাসই পেয়ে আসছি। তবে তাতে কাজ কেন হচ্ছে না, তা এখনও বোধগম্য হচ্ছে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE