Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

উত্তরেও ছড়াচ্ছে সিবিআই-শঙ্কা

সারদা তদন্তে সিবিআইয়ের তৎপরতা বাড়তেই আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছেন উত্তরবঙ্গে সারদার প্রায় ২০০ কোটি টাকার জমি-সম্পত্তির লেনদেনের সঙ্গে জড়িতদের অনেকে। এঁদের অনেকেই রাজ্যের শাসক দলের নানা স্তরের নেতা-কর্মী। সিবিআইয়ের গত ক’দিনের গতিবিধি থেকে স্পষ্ট, সারদা-কাণ্ডে তদন্তকারীরা উত্তরবঙ্গের দিকে নজর দিলে এঁদের অনেককেই জেরার মুখে পড়তে হবে।

ইডি তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার পর সারদা রিসর্টের সামনে স্থানীয় তৃণমূল নেতা রেজাউল বাকি। এত দিন রিসর্টের চাবি তাঁর হাতেই থাকত। শুক্রবার লাটাগুড়িতে। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।

ইডি তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার পর সারদা রিসর্টের সামনে স্থানীয় তৃণমূল নেতা রেজাউল বাকি। এত দিন রিসর্টের চাবি তাঁর হাতেই থাকত। শুক্রবার লাটাগুড়িতে। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৫২
Share: Save:

সারদা তদন্তে সিবিআইয়ের তৎপরতা বাড়তেই আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছেন উত্তরবঙ্গে সারদার প্রায় ২০০ কোটি টাকার জমি-সম্পত্তির লেনদেনের সঙ্গে জড়িতদের অনেকে। এঁদের অনেকেই রাজ্যের শাসক দলের নানা স্তরের নেতা-কর্মী। সিবিআইয়ের গত ক’দিনের গতিবিধি থেকে স্পষ্ট, সারদা-কাণ্ডে তদন্তকারীরা উত্তরবঙ্গের দিকে নজর দিলে এঁদের অনেককেই জেরার মুখে পড়তে হবে। তার মধ্যে শুক্রবারই সিবিআই-এর একটি সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে, আগামী দু’-এক দিনের মধ্যে তাদের একটি দল জলপাইগুড়ি পৌঁছবে সারদা নিয়ে তদন্ত করতে।

উত্তরবঙ্গে সারদার বিপুল পরিমাণ জমি-সম্পত্তি কেনাবেচার সঙ্গে দলের একাধিক নেতা-কর্মী-জনপ্রতিনিধি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত বলে বহু বারই অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের অন্দরে। তৃণমূল সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গে দলের কোন কোন নেতা-মন্ত্রী জেরার মুখে পড়তে পারেন, তা নিয়ে রাজ্য নেতৃত্বের তরফে খোঁজখবর করা হয়েছে। একই সঙ্গে বার্তা দেওয়া হয়েছে, জমি বা সম্পত্তি কেনাবেচায় জড়িত কেউ অন্যায় ভাবে টাকা নিয়ে থাকলে দল তাঁর পাশে দাঁড়াবে না।

আলিপুর আদলত চত্বরে দেবব্রত সরকার।—নিজস্ব চিত্র।

ঘটনাচক্রে, শুক্রবারই এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) এক দল অফিসার ডুয়ার্সে অভিযান চালিয়ে সারদার ১টি রিসর্ট-সহ ৩টি এলাকার জমি কী অবস্থায় রয়েছে, তা খতিয়ে দেখেন। সেই তালিকায় লাটাগুড়ির একটি রিসর্ট, সেটির লাগোয়া ৬ বিঘা জমি এবং মৌলানি এলাকার একটি বড় জমি রয়েছে। সেই সব জমি নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ইডি-র অফিসারেরা।

ইডি-র অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পদমর্যাদার এক অফিসার এ দিন বলেন, “উত্তরবঙ্গে সারদার রিসর্ট, জমি ও সম্পত্তি সংক্রান্ত অনেক তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। আপাতত ওই তিনটি সম্পত্তি হেফাজতে নিয়েছি। শীঘ্রই আইনি প্রক্রিয়া মেনে ৩টি সম্পত্তি দখলে রাখার বিজ্ঞপ্তি জারি হবে। কী ভাবে, কাদের মাধ্যমে ওই লেনদেন হয়েছিল? তাতে সারদা সংস্থাকে কোনও ভাবে কেউ সুবিধা পাইয়ে দিয়েছিলেন কি না, সেটাও দেখা হবে। রিসর্ট লাগোয়া জমিটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের হলেও তা কী ভাবে কার প্রভাবে রাতারাতি হস্তান্তর হয়েছিল, সবই তদন্ত হবে। সংশ্লিষ্ট সকলকেই জেরা করা হবে।”

উত্তরবঙ্গের সাত জেলাতেই সারদার বিপুল পরিমাণ জমি ও সম্পত্তি রয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ জমি কেনার ব্যাপারে এলাকার প্রভাবশালী তৃণমূল নেতারা সাহায্য করেছেন বলে অভিযোগ সারদার আমানতকারী ও এজেন্টদের একটা বড় অংশের। বিশেষত ডুয়ার্সে। সেখানে একাধিক স্থানীয় তৃণমূল নেতার নাম সামনে এসেছে। এ দিন ইডি-র অফিসারেরা লাটাগুড়ির রিসর্টে গিয়ে জানতে পারেন, সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে ওই রিসর্টের চাবি এলাকার এক তৃণমূল নেতা তথা দলের সংখ্যালঘু সেলের প্রাক্তন জেলা সম্পাদক রেজাউল বাকির কাছে ছিল। ইডি-র অফিসারদের কাছে অবশ্য রেজাউল দাবি করেছেন, তিনি সারদার রিসর্টে কাজের বরাত পেয়েছিলেন। সেই বাবদ বহু টাকার কাজও করেছিলেন। কিন্তু টাকা পাননি। তাই রিসর্ট যাতে বেহাত না হয়ে যায়, সে জন্য তিনি চাবিটি নিজের কাছে রেখেছিলেন। ইডি সূত্রের খবর, রেজাউলের সঙ্গে পরে বিশদে কথা বলবেন তদন্তকারীরা। এ দিন তাঁরা রিসর্টের চাবিটি নিজেদের হেফাজতে নিয়েছেন। পরে রেজাউল বলেন, “সারদার রিসর্ট ও লাগোয়া এলাকার জমিতে নির্মাণের কাজ করেও টাকা পাইনি। প্রায় ১২ লক্ষ টাকা সারদার কাছে পাব। শ্যামল সেন কমিশন, পুলিশকে সব জানিয়েছি। আমি অন্য কোনও লেনদেনে যুক্ত নই।”

সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে রাজ্যে তোলপাড় শুরু হতেই উত্তরবঙ্গে সংস্থাটির সম্পত্তির ব্যাপারে তদন্তে নামে রাজ্য পুলিশের তদন্তকারী দল ‘সিট’। প্রাথমিক তদন্তে সিট জানতে পারে, উত্তরবঙ্গের নানা জায়গায় সারদা সব মিলিয়ে প্রায় ২৫২ বিঘা জমি কিনেছে। কোথাও পর্যটন কেন্দ্র গড়ার জন্য জমি কেনা হয়েছে। কোথাও হাসপাতাল তৈরির কথা বলা হয়েছে। ডুয়ার্সে কেনা হয়েছে একটি রিসর্ট। শিলিগুড়িতে চালু ইংরেজি মাধ্যম স্কুল কেনার নজিরও রয়েছে।

উত্তরবঙ্গের সারদার এজেন্টদের একাংশের অভিযোগ, তৃণমূলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের একাংশ ওই জমি, সম্পত্তি কেনাকাটার সুবাদে ‘কমিশন’ হিসেবে মোটা টাকা পেয়েছেন। সারদার শিলিগুড়ি শাখার দুই আধিকারিক গৌতম চৌধুরী ও প্রণব মোহান্তর দাবি, সারদার কোথায় কী সম্পত্তি রয়েছে, কী ভাবে কার মাধ্যমে সেগুলি কেনা হয়, সে সবই তাঁরা পুলিশকে বিশদে জানিয়েছেন।

সারদার আমানতকারী ও এজেন্টদের উত্তরবঙ্গের সংগঠনের একাংশের অভিযোগ, ডুয়ার্সের লাটাগুড়িতে আড়াই বিঘার উপরে তৈরি একটি রিসর্ট কেনার ব্যাপারে সারদা-কর্তাদের

সাহায্য করেছিলেন স্থানীয় তৃণমূলের একাধিক নেতা। ওই রিসর্টের পাশেই একটি আদিবাসী পরিবারের ৬ বিঘা জমিও কিনে নেয় সারদা। সেই জমি কেনার আগে সেটির চরিত্রও বদলে ফেলা হয়। উপরন্তু, ওই জমিতে আদিবাসীদের মোরগ-লড়াইয়ে আসর বসতো। সেগুলিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ নিয়ে এলাকায় বিক্ষোভ দানা বাঁধে। তৃণমূলের একটি গোষ্ঠী আন্দোলনকারীদের সমর্থন করে। পুলিশকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়। পরে তৃণমূলের জলপাইগুড়ি জেলার এক নেতার মধ্যস্থতায় আন্দোলন উঠে যায়।

সারদার জমি নিয়ে অভিযোগ আরও আছে। ডুয়ার্সেই ধূপঝোরার গাছবাড়ি লাগোয়া এলাকায় মূর্তি নদীর চর ঘেঁষে সারদা প্রায় ১৭ বিঘা জমি কেনে। এলাকার লোকজন ওই জায়গা দিয়ে মূর্তি নদীর চরে গরু চরাতে যেতেন। সেখানে সারদা পাঁচিল তুলে দিলে আন্দোলনে নামেন বাসিন্দারা। আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন, ওই জমির একাংশে নদীর চর রয়েছে, যা সেচ দফতরের। সেই জমি সারদা কী করে কিনেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। অভিযোগ পৌঁছয় গরুমারা ট্যুরিজম ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কাছেও। তাঁরাও খোঁজখবর নেন। ইতিমধ্যে সুদীপ্ত সেন ফেরার হয়ে যান। তখন মূর্তি নদীর চর ঘেঁষা ওই জমিতে সারদার তৈরি পাঁচিলটি জনতা ভেঙে দেয়।

সারদা যে সময় ওই এলাকায় জমি কেনা শুরু করে, তখন তৃণমূলের জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি ছিলেন চন্দন ভৌমিক। তখন চন্দনবাবুর কী ভূমিকা ছিল, এখন সেই প্রশ্নও দলে উঠেছে। বর্তমানে অবশ্য চন্দনবাবু জেলা সভাপতির পদ থেকে অপসারিত। তা ছাড়া, এসজেডিএ-র বহু কোটি টাকা দুর্নীতি মামলায় পুলিশ তাঁকে জেরা করেছে। চন্দনবাবুর কথায়, “মালবাজার মহকুমায় কয়েকটি জমি নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ শুনেছিলাম। সে সময়েই সাংগঠনিক স্তরে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসনকেও দল না দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছিল।” চন্দনবাবুর দাবি, জমির দালালি করেন এমন অনেকেই সুযোগ-সুবিধা নিতে তৃণমূলে নাম লিখিয়েছিলেন। তাঁদের কয়েক জনকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “জেলা সভাপতি থাকার সময়ে কোনও সংস্থাকে জমি পাইয়ে দিতে বা বিক্রি করাতে কোনও হস্তক্ষেপ করা হয়নি। বরং অভিযোগ উঠলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

সারদা-তদন্তের ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি তৃণমূলের উত্তরবঙ্গের কোর কমিটির চেয়ারম্যান তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তৃণমূলের জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারের জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তীর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “এখনই কিছু বলার নেই। সময় হলে যা বলার বলব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE