Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নিষ্ফল আশ্বাস মন্ত্রীর, ঝামেলায় রাজ্য ছাড়তে পারে কাগজকল

কখনও ‘আমাদের লোকের কাছ থেকে মাল নিতে হবে’, কখনও ‘আমাদের লোককেই কাজে নিতে হবে’। এ সব বন্ধ করতে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ কিংবা শ্রমমন্ত্রীর আশ্বাস কোনও কিছুতেই রাজ্যের শিল্পচিত্রে পরিবর্তনের কোনও লক্ষণ নেই। রাজনৈতিক দাদাগিরির সর্বশেষ শিকার দুর্গাপুরের কাগজকল।

কাগজকলের গেটের সামনে দু’পক্ষের বচসা।  নিজস্ব চিত্র

কাগজকলের গেটের সামনে দু’পক্ষের বচসা। নিজস্ব চিত্র

সুব্রত সীট
দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৪:০৫
Share: Save:

কখনও ‘আমাদের লোকের কাছ থেকে মাল নিতে হবে’, কখনও ‘আমাদের লোককেই কাজে নিতে হবে’। এ সব বন্ধ করতে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ কিংবা শ্রমমন্ত্রীর আশ্বাস কোনও কিছুতেই রাজ্যের শিল্পচিত্রে পরিবর্তনের কোনও লক্ষণ নেই। রাজনৈতিক দাদাগিরির সর্বশেষ শিকার দুর্গাপুরের কাগজকল।

নিয়োগ নিয়ে লাগাতার রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন লাউদোহা থানার প্রতাপপুর এলাকার ওই কাগজকল কর্তৃপক্ষ। শ্রমমন্ত্রীর আশ্বাস পেয়ে রবিবার ফের কাজ শুরু করতে যান কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, স্থানীয়দের নিয়োগের প্রশ্নে ফের বিপাকে পড়লেন তাঁরা। শ্রমিক নিয়োগ নিয়ে তৃণমূল এবং এসইউসি-র দ্বন্দ্বে আবারও কাজ বন্ধ হওয়ার জোগাড় সেখানে। এমন পরিস্থিতিতে এ রাজ্যে আর কাগজকল চালাবেন কি না, তা-ও ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। কাগজকলটির মালিক বাবুভাই খান্ডেলওয়াল মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন। তাঁর সাফ কথা, “ঝামেলা নিয়ে তো কাজ করতে পারব না। সে ক্ষেত্রে এখানে কাগজকল পুরোপুরি বন্ধ করে, যে রাজ্যে সুবিধা পাব, সেখানে চলে যাব।” আপাতত কয়েক দিন অপেক্ষা করে দেখতে চান তিনি। বাবুভাইয়ের কথায়, “মন্ত্রীর আশ্বাসের পরেও সমস্যা হয়েছে। দিন কয়েক দেখি। তার পরে সিদ্ধান্ত নেব।”

শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের দাবি, “এসইউসি সমস্যা তৈরি করেছে বলে খবর পেয়েছি। আমাদের কেউ তা করলে দল অবশ্যই ব্যবস্থা নিত। কিন্তু, এটা অন্য দলের ব্যাপার। কারখানা কর্তৃপক্ষ লিখিত অভিযোগ জানালে প্রশাসন নিশ্চয় ব্যবস্থা নেবে।” এই ক্ষেত্রে তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী অন্য দলকে দুষলেও এ রাজ্যের বহু ছোট-বড়-মাঝারি কারখানা কর্তৃপক্ষই শাসক দলের ‘আব্দারে’ জেরবার। এক দিকে লগ্নি টানতে মুখ্যমন্ত্রী যাচ্ছেন সিঙ্গাপুর, অন্য দিকে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের দাদাগিরি ও লোক নিয়োগের চাপে শিল্প বন্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে। তার ব্যতিক্রম নয় দুর্গাপুরের কাগজকলটিও। এবং এটা একেবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তফাত শুধু এটাই যে, এই ক্ষেত্রে অভিযোগের তির শুধু তৃণমূল নয়, এসইউসি এবং সিপিএমের দিকেও।

শাসক দলের লোককেই কাজে নিতে হবে, আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বহু কারখানা মালিকই এমন চাপের মুখোমুখি হয়েছেন। অনেকে অশান্তি এড়াতে সেই চাপ মেনে নিয়েছেন। অনেকে থানা-পুলিশ করেছেন বটে, তবে তাঁদের অনেকেরই সমস্যা মেটেনি। লোক নিয়োগ নিয়ে বারবার শাসক দলের চাপে পড়তে হয়েছে ‘এসার অয়েল’-কে। দুর্গাপুরের কাঁকসা, লাউদোহায় তাদের কোলবেড মিথেন তোলার প্রকল্প অনেক বারই বাধা পেয়েছে নিয়োগ নিয়ে দাদাগিরির জেরে। জামুড়িয়ায় শ্যাম গোষ্ঠীর কারখানাও শাসক দলের হুমকির মুখে পড়েছে বলে অভিযোগ। ওই ঘটনায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা অলোক দাস ও চঞ্চল বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাসপেন্ড করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।

কিন্তু দাদাগিরি কি কমেছে?

সিন্ডিকেটের দাপাদাপি নিয়ে দিন কয়েক আগেই বর্ধমান জেলা পরিষদের সভাধিপতির কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন দুর্গাপুরের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপতিরা। এর পরপরই প্রতাপপুরের ওই কাগজকলটি কাজ বন্ধের নোটিস দেয়। কাজের বরাত দেওয়ার দাবিতে এক তৃণমূল নেতার হুমকির জেরে সঙ্কটে পড়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের একটি জুতোর কারখানা। বণিক মহলের একাংশের ব্যাখ্যা, এটি একটি বিষচক্র। উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে শিল্প সে ভাবে আসছে না রাজ্যে। ফলে, বাড়ছে বেকারি। তাই কারখানায় নিজেদের লোক ঢোকাতে চাপ দিচ্ছে শাসক দল। স্থানীয় স্তরে প্রভাব থাকলে অন্যান্য দলও একই জিনিস করছে। প্রতাপপুরে নিয়োগ নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের উপরে তৃণমূলের পাশাপাশি চাপ দিচ্ছে এসইউসি-ও। এরই ফলে আরও বিগড়ে যাচ্ছে রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি। কারখানা গুটিয়ে ভিন্রাজ্যে যাওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে।

দুর্গাপুর স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কৃপাল সিংহের বক্তব্য, “পুরনো শিল্প চলে গেলে বেকারি আরও বাড়বে। সিন্ডিকেট-রাজের মতো উপদ্রবের অভিযোগও বাড়বে পাল্লা দিয়ে।” বেঙ্গল সাবার্বান চেম্বার অব কর্মাসের সাধারণ সম্পাদক প্রফুল্ল ঘোষ স্পষ্ট বলছেন, “শিল্প না আসার জেরেই লোক নিয়োগের জন্য চাপ বাড়ছে। পরিস্থিতি না পাল্টালে নতুন শিল্পও আসবে না।”

ঠিক কী ঘটেছে প্রতাপপুরে? গত জুনে প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকায় এখানে একটি কাগজকল কিনেছেন দিল্লির শিল্পপতি বাবুভাই। কারখানা চালুর আগে সেখানে কিছু নির্মাণকাজ চলছে। সিন্ডিকেট ও নিয়োগ নিয়ে চাপের অভিযোগে গত ২২ অগস্ট কাজ বন্ধের নোটিস দেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। তাঁদের অভিযোগ, তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠী ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। সঙ্গে সামিল হয়েছে সিপিএম এবং এসইউসি-ও। সমস্যা মেটাতে গত সোমবার নবান্নে কাগজকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক। পুলিশ-প্রশাসনের তরফে সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে কাজ শুরুর নোটিস দেন কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু, রবিবার কাজ শুরু করতে গেলে অশান্তি বাধে। কারখানা সূত্রে জানা গিয়েছে, এখন যা কাজ হবে, তার জন্য ৬ জন শ্রমিক লাগবে। তৃণমূল প্রথমে ৭ জনকে নেওয়ার জন্য চাপ দিলেও পরে ৬টি নামের তালিকা দেয়। এসইউসি-র স্থানীয় কর্মীরাও ৫ জনের নামের তালিকা নিয়ে হাজির হন। কাদের কাজে নেওয়া হবে, সে নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত না হওয়ায় সারা দিন কাজই হয়নি।

দিনভর কারখানা চত্বরে দু’পক্ষের লোকজনই অপেক্ষা করতে থাকেন। খবর পেয়ে পৌঁছয় লাউদোহা থানার পুলিশ। বিকেলের দিকে তৃণমূল-এসইউসি’র মধ্যে বচসা থেকে হাতাহাতি শুরু হলে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। তৃণমূলের যে কর্মীরা কাজ করতে এসেছিলেন, তাঁরা মানস মণ্ডলের অনুগামী হিসেবে পরিচিত। নিয়োগ নিয়ে কারখানাকে চাপ দেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে ওই স্থানীয় নেতার বক্তব্য, “কাজের দাবি জানাতে হবে কর্তৃপক্ষের কাছে। তা জানিয়েছি। এসইউসি-র লোক শ্রমিকদের হেনস্থা করেছে।” স্থানীয় এসইউসি নেতা বিপ্লব মণ্ডলের পাল্টা অভিযোগ, “তৃণমূল একতরফা লোক নিয়োগ করিয়েছে। আমরা তা মানব না।”

শ্রমমন্ত্রীর আশ্বাস ছিল, সমস্যা যাতে না হয়, তা পুলিশ-প্রশাসন দেখবে। কিন্তু এ দিন প্রশাসনের তরফে সমস্যা মেটানোর কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। দুর্গাপুরের মহকুমাশাসক কস্তুরী সেনগুপ্তর বক্তব্য, “কারখানা কর্তৃপক্ষ এ দিনের ঘটনা আমাকে কিছু জানাননি।” পুলিশ জানায়, কোন ৬ জনকে কাজে নিচ্ছেন, কর্তৃপক্ষ তা জানালে বাকিদের হঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু গোটা পরিস্থিতিতে কারখানার স্থানীয় আধিকারিকরা এতটাই চাপে যে, কাদের কাজে নেওয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কাগজকলের ম্যানেজার অর্ধেন্দু হাজরা বলেন, “যা পরিস্থিতি, সুষ্ঠু ভাবে কাজ হওয়া মুশকিল। বিষয়টি মালিককে জানাব। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তিনি নেবেন।”

মালিক বাবুভাই বলেই রেখেছেন, “যে রাজ্যে সুবিধা পাব... ।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE