দীর্ঘ ক্ষণ দাঁড়িয়ে ট্রেন। লাইনের পাশেই চলছে খাবার বিক্রি। সোমবার। নিজস্ব চিত্র।
পুরনো মালদহ জংশনে দাঁড়ানোর কথাই নয়। তবু আচমকা থেমে গেল ট্রেন। সবে ভোর হয়েছে। ঘুম ভেঙে যাত্রীদের কেউ কেউ ঘড়িতে চোখ রাখলেন। সকাল সওয়া ছ’টা। তখনও তাঁরা জানেন না, পরের ১২ ঘণ্টার এখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে পদাতিক এক্সপ্রেস।
সারাদিন পেটে কিল মেরে বসে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না, যদি না এগিয়ে আসতেন আশপাশের বাসিন্দারা। খিচুড়ি আর ডিমভাত সহযোগে তাই তো দিনটা কাটল কোনও রকমে!
পুরনো মালদহ স্টেশনে কস্মিন কালে কোনও বড় মাপের যাত্রীট্রেন দাঁড়ায় না। ছোট্ট স্টেশন চত্বরে কয়েকটা ভাঙাচোরা চায়ের দোকান ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। ততক্ষণে দিন গড়িয়ে দুপুর। যাত্রীরা জেনে গিয়েছেন, ঝাড়খণ্ড দিশম পার্টি ১২ ঘণ্টার রেল ও সড়ক অবরোধের ডাক দিয়েছে বলেই ট্রেন এতক্ষণ ধরে থ্রু লাইনে নট নড়নচড়ন। পাশে কোনও প্ল্যাটফর্মও নেই। স্টেশনের কর্মীরা বলছিলেন, ‘‘ওটা তো থ্রু ট্রেন। তাই থ্রু লাইন দিয়েই যায়।’’
আরও পড়ুন: কুয়াশার দোসর অবরোধ, নাকাল ট্রেনযাত্রীরা
চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে শিলিগুড়ি হয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন মহম্মদ হোসেন। শিলিগুড়ি ফেরার পথে এই বিপত্তি। শুকনো মুখে এস-৬ কামরায় জানলার পাশে বসে বলেন, “প্ল্যাটফর্মে না দাঁড়ানোয় একবারের জন্যেও নীচে নামতে পারিনি। এত ঠান্ডায় চা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। তা-ও জোটেনি।’’ ওই বৃদ্ধের পাশেই চার বছরের ছেলেকে চাদরে জড়িয়ে কোলে নিয়ে বসেছিলেন কলকাতার বাসিন্দা মঞ্জুশ্রী মাইতি। বললেন, “এ ভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছেলেকে নিয়ে কামরায় বন্দি হয়ে আছি!’’
এরই মধ্যে কয়েক জন উদ্যোগী যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনে গিয়ে খোঁজ শুরু করেন খাবারের। কিন্তু কোথায় কী! তবে আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন সমানে আসছিলেন পদাতিক দেখতে। যাত্রীদের কথা শুনে রিনা মাহাতোদের মতো কেউ কেউ এগিয়ে এসে বলেন, ‘‘রান্না খাবার এনে দেব। তবে পয়সা লাগবে।’’ রূপা মালিক-অর্পিতা মাইতিরা যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। কয়েক জন উৎসাহী যাত্রী বললেন, রান্না চড়িয়ে দিন!
দ্রুত বড় ডেকচিতে হল ভাত। সঙ্গে ডিমের ঝোল। কেউ কেউ আবার বসিয়ে দিলেন খিচুড়ি। রান্না হতেই শালপাতা বা থার্মোকলের প্লেটে গরমাগরম ধরিয়ে দেওয়া হল যাত্রীদের হাতে। দাম? একটি ডিম দিয়ে ঝোল-ভাত ৫০ টাকা প্লেট। খিচুড়ি ১৫ টাকা প্লেট। একটু কি বেশি পড়ল? যাত্রীদের অনেকে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘‘খাবারই তো জুটছিল না। এখানে টাকাটা কী বড় হল! ভাগ্যিস আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসেছিলেন! নইলে আজ দিনটা উপোস করেই কাটত!’’
সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় নড়ে উঠল গাড়ি। ট্রেন রওনা দিল এনজেপি-র দিকে। আর রানি মাহাতোরা খুশি মনে দিনের রোজগার পকেটে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সঙ্গে দুর্গতদের খাওয়ানোর পুন্যিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy