গ্র্যাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ।
শারদ উৎসবে রাজনীতির ভূমিকা ঠিক কতটা?
উত্তর পেতে বেশি দূর যেতে হবে না। শহর কলকাতা তো বটেই, রাজ্যের বেশির ভাগ পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তাদের নাম একটু খেয়াল করলেই জবাবটা মিলে যাবে হাতেগরম। কারণ, তাঁদের অনেকেই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য। তাতে যেমন চুনোপুঁটিও আছেন, তেমন আছেন রাঘব বোয়ালও। আর বিষয়টিকে বাঙালি নেতিবাচক ভাবে তো নয়ই, বরং অনেক অনেক গুণ ইতিবাচক ভাবে দেখে এসেছে।
খুঁটি পুজো থেকে শুরু। এই সব নেতাদের অনেকেই পুজোর সঙ্গে এমন ভাবে জড়িয়ে থাকেন যে, দলের ভীষণ প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া পাড়া ছেড়ে বেরনোর কথা ভাবতেই পারেন না। পুরোটা তো তাঁরই নখদর্পণে। দশমী পেরিয়ে গেলেও উৎসবের সেই ঘোর থেকে বেরনো তাঁদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর এই গোটা সময়টা জুড়ে রাজনীতির কথা সেই অর্থে মুখেও আনেন না তাঁরা। কিন্তু উৎসবের আবহে কি হাল্কা ভাবেই তাঁরা মিশিয়ে দেন না, রাজনীতির ‘সুবাস’?
আরও পড়ুন: নাফ নদীতে বিসর্জন, কোরিয়ায় কালো মেঘ, হিমালয়ে ভারসাম্য
হ্যাঁ। মিশিয়ে দেন। এবং সেটা অতীব সুকৌশলে। এই যেমন, বোধনের ঠিক আগেই তৃণমূলের মতো দলে একটি বড় ‘বিসর্জন’ হয়ে গেল। মুকুল রায় দল ছেড়ে দিলেন। এটা মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠে রয়েছে, তাঁকে দল থেকে সাসপেন্ড করা হল। আবার এর একটা মধ্যাংশও রয়েছে, দল থেকে বের করে দেওয়া হবে বুঝতে পেরেই তিনি নাকি আগে থেকে দল ছাড়ার ঘোষণা করেন।
অথচ দলনেত্রীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি প্রায় দু’দশক কাটিয়েছেন দলে। একটা সময় তো তাঁকে ‘চাণক্য’ও বলা হত। কিন্তু, সেই তাঁকেই ছাউনি ছেড়ে, যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে সরে যেতে হল। এবং সেটা দেবীপক্ষে এসে। তো সেই অনেক দিনের পোড় খাওয়া রাজনৈতিক কর্মী মুকুল রায়ও পঞ্চমীর দিন দলছাড়ার কথা ঘোষণা করার সময় উৎসবের সঙ্গে হাল্কা ছন্দে মিশিয়ে দিলেন নিজের সুসংহত বার্তা। তিনি বললেন, ‘‘আজ শুভ পঞ্চমী। সারা বাংলা তথা ভারতবর্ষ দুর্গোৎসবে মেতে আছে। এই সময়ে কোনও রাজনৈতিক বার্তা বা রাজনৈতিক কুটকচালি বাংলার মানুষ পছন্দ করে না। আমি তাই আজকে বড় ভাবে না বলে ছোট দুটো কথা বলব।’’ এর পরেই তিনি দল ছাড়ার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। নিঃসন্দেহে ‘বিসর্জন’। রাজনৈতিক কেরিয়ারে না হলেও নিজের হাতে গড়ে তোলা দলে তো তাঁর বিসর্জন বটেই।
কিন্তু, একটা বিসর্জনের পর তো ফিরে আসে আর একটা বোধন। রাজ্য রাজনীতিতে এই বিসর্জনের পর ঠিক কী ভাবে বোধনের আবির্ভাব হতে পারে? মুকুল কি অন্য দলে যাবেন? না, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষেত্র। মুকুল যদি নতুন কোনও রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তবে সেটাই বাংলার রাজনীতিতে বোধন। বিসর্জনের পর ফের বোধন।
একই রকম ভাবে পাহাড়ের রাজনীতিতে বোধন হয়েছে বিনয় তামাঙ্গ নামের এক গোর্খা রাজনীতিকের। শারদীয় বোধনের সঙ্গে সঙ্গে জিটিএ-তেও তাঁর এক প্রকার বোধন হয়েছে। সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ পেরিয়ে ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী— না পাহাড় এখনই বিসর্জনের কথা ভাবতে চাইছে না। বিসর্জন যদি দিতেই হয়, তবে তাঁরা এই মুহূর্তে আন্দোলনের উগ্রতাকে তা দিতে চাইছেন। বন্ধের নিষ্ঠুর পরিণতিকে হঠিয়ে পাহাড় থেকে খাদে গড়িয়ে দিতে চাইছেন। সারিতে বিমল গুরুঙ্গের মতো নেতারাও রয়েছেন। তবে, তাঁদের হাতে যে পাহাড়ের বোধনডালি সেজে উঠবে না, তা পাহাড়বাসীর একাংশ বুঝতেও পারছেন। কারণ, বিমলদের মতো কট্টরপন্থীদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব অন্য দলগুলির কাছে গুরুত্ব হারাচ্ছে। তারা নিজেরাই অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়েছেন নিজেদের নানা ক্রিয়াকলাপে।
আসলে এ-ও এক ধরনের বোধনের গল্প। সমতলের দল যদি পাহাড়ে চারিয়ে নিতে চায় নিজের অস্তিত্ব, তা হলে এমন পরিস্থিতিই প্রয়োজন। পাহাড়ের দলগুলির সঙ্গে হাত না মিলিয়েই এখন সমতলের দলগুলি পাহাড়বাসীর আস্থা অর্জন করতে চায়। মিরিক পুরসভা তার উদাহরণ।
কাজেই ভাবার কোনও কারণ নেই, বিসর্জন মানেই সব ফুরিয়ে গেল। আনন্দের দিনগুলো কেটে গেল। ফের অপেক্ষা। না, রাজনীতিতে তেমন অবকাশ নেই। রাজনীতিতে বিসর্জন এবং বোধন একসঙ্গেই চলতে থাকে। যাত্রামঙ্গল পাঠের পর মুহূর্তেই তাই এখানেও ফের উচ্চারিত হতে পারে আবাহনের মন্ত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy