Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
দাদরির দায় নেবেন না মোদী

শিল্পীদেরও সহিষ্ণু হতে হবে, পুরস্কার না-ফিরিয়ে বলছেন শীর্ষেন্দু-সুবোধরা

পঞ্জাব, দিল্লি, গুজরাত, কেরল, মধ্যপ্রদেশ...। সংখ্যাটা সমানে বাড়ছে। প্রতিবাদী স্বর রাজ্যে রাজ্যে। এ রাজ্য অবশ্য এখনও নিশ্চুপ। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কন্নড় লেখক এম এম কালবার্গির হত্যা বা উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে খুনের প্রতিবাদে এক-এক করে দেশের ২১ জন লেখক অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন।

সুরবেক বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:০০
Share: Save:

পঞ্জাব, দিল্লি, গুজরাত, কেরল, মধ্যপ্রদেশ...। সংখ্যাটা সমানে বাড়ছে। প্রতিবাদী স্বর রাজ্যে রাজ্যে। এ রাজ্য অবশ্য এখনও নিশ্চুপ।

সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কন্নড় লেখক এম এম কালবার্গির হত্যা বা উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে খুনের প্রতিবাদে এক-এক করে দেশের ২১ জন লেখক অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেন্দ্রের বা রাজ্যের শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর পন্থা হিসেবে পুরস্কার বা সম্মান ফেরানোর কথা ভাবতে পারছেন না পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক-শিল্পীরা।

অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই রাজ্যের যে সব কবি-সাহিত্যিক জীবিত, তাঁদের কেউই ওই পুরস্কার ফিরিয়ে দেননি। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনযাপনে এই সারস্বত সাধকদের
মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকলেও এই একটা বিষয়ে কিন্তু তাঁরা এককাট্টা। প্রত্যেকের মুখে একই কথা— ‘অকাদেমি পুরস্কার ফেরাব না।’

পুরস্কার আঁকড়ে থাকার এই প্রবণতা শুধু অকাদেমির ক্ষেত্রেই নয়, রাজ্য সরকারের দেওয়া নানা সম্মানের ক্ষেত্রেও বহাল। সম্প্রতি বিধাননগর পুরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা ঘটনায় এ রাজ্যে সাধারণ নাগরিকের ভোটদান তথা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও সংবাদমাধ্যমের উপর আক্রমণের অভিযোগ উঠেছে। তার সমালোচনা কোনও কোনও লেখক-শিল্পী করলেও রাজ্য সরকার প্রদত্ত বঙ্গবিভূষণ, বঙ্গভূষণের মতো সম্মান ছাড়ার কথা ভাবছেন না কেউই।

সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এক দিকে যেমন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত, তেমনই তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনের চালু করা সর্বোচ্চ সরকারি সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ও পেয়েছেন। কেন্দ্রে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের ‘ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা’র কথা বললেও তিনি মনে করেন, ‘‘যে সরকার এখন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে, আমি তো তাদের আমলে অকাদেমি পাইনি। তাই, সেই পুরস্কার ফিরিয়ে দিতে যাব কেন?’’ সমালোচনার ঢঙেই তিনি বলেন, ‘‘অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়াটা যেন হুজুগের মতো লাগছে। যে-ই এক জন করলেন, তাঁর দেখাদেখি পর পর কয়েক জন পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেন।’’

বিধাননগর পুরভোটের পর রাজ্য সরকার প্রদত্ত সম্মান ফেরানোর কথা কেন ভাবছেন না? শীর্ষেন্দুবাবুর কথায়, ‘‘ভোটের সময়ে গণ্ডগোল নতুন নয়। খবর সংগ্রহে গিয়ে সাংবাদিকদের অধিকার হরণ আগেও হয়েছে। এ সব সমর্থন করছি না। কিন্তু এই সরকারের পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করার সময় এখনও আসেনি। আমাদের আরও একটু সহিষ্ণুতা দরকার।’’

একটা সময়ে বামফ্রন্ট-ঘনিষ্ঠ, পরে শিবির বদল করা এবং এই বছর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে ‘বঙ্গভূষণে’ সম্মানিত কবি সুবোধ সরকারও মনে করেন, ‘‘সাংবাদিক নিগ্রহকে সমর্থন করিনি, ভবিষ্যতেও করব না। তবে এর সঙ্গে রাজ্য সরকারের পুরস্কার গ্রহণ বা বর্জনের সম্পর্ক নেই।’’ আর অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া লেখকদের উদ্দেশে ২০১৩-তে সাহিত্য অকাদেমি পাওয়া সুবোধের তির্যক মন্তব্য, ‘‘লেখকেরা এসি ঘরে বসে ই-মেল করে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে না দিয়ে রাস্তায় নামুন, অনশনে বসুন। আমিও বসব।’’

কবি শঙ্খ ঘোষও জানিয়ে দিচ্ছেন, তিনি সাহিত্য অকাদেমি ফেরাচ্ছেন না। তাঁর যুক্তি, ‘‘সাহিত্য অকাদেমি কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। তাই, অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়াকে প্রতিবাদের যথেষ্ট পথ বলে আমার মনে হচ্ছে না।’’ দিন কয়েক আগেই কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী মহেশ শর্মা বলেছিলেন, ‘‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার সরকারি সম্মান নয়। এখানে লেখকরা লেখকদের পুরস্কার দেন। তবু কেউ যদি সেই পুরস্কার ফিরিয়ে দিতে চান, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়।’’ একই মত অকাদেমি কাউন্সিলের সদস্য শীর্ষেন্দুবাবু ও সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের।

পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা ও নৈতিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন সমরেশ মজুমদার। তাঁর ‘কালবেলা’ উপন্যাসটি ১৯৮৪-তে অকাদেমি পেয়েছিল। সমরেশবাবু বলছেন, ‘‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পাওয়ার পর ‘কালবেলা’র বিক্রি লক্ষাধিক হয়েছিল। তা হলে সেই বইয়ের জন্য পাওয়া অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিতে গেলে ওই রয়্যালটির টাকাও ফেরত দিতে হয়।’’ সমরেশবাবুর মতে, ‘‘প্রতিবাদের পথ হিসেবে অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া অত্যন্ত ছেলেমানুষি ও আবেগপ্রবণ মানসিকতার পরিচয়।’’ তবে তিনি বলছেন, ‘‘যে কথা মাথায় রেখে পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা আমি অবশ্যই সমর্থন করছি।’’ বাণী বসু বলছেন, ‘‘অকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়ে আমি কিছু অভীষ্ট সাধন করতে পারব বলে মনে করি না। প্রতিবাদের এই পথটা স্পষ্ট নয়।’’

নবতিপর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সাফ কথা, ‘‘পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়াকে আমি প্রতিবাদের সঠিক পন্থা বলে মনে করি না। এটা প্রতীকী প্রতিবাদ। এতে আমার আস্থা নেই।’’ তিনি বলছেন, ‘‘১৯৭৪ সালে আমি যখন ওই পুরস্কার পাই, তখন সাহিত্য অকাদেমির চেয়ারম্যান সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর হাত থেকে নেওয়া পুরস্কার আমি ফেরত দিতে যাব কেন? আমি তো আর এই সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার নিইনি!’’

নীরেনবাবু অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন ‘উলঙ্গ রাজা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য। সেই কবিতা যেখানে এক শিশু রাজাকে উলঙ্গ দেখে কৃপাপ্রার্থী-উমেদার-প্রবঞ্চকদের মতো হাততালি দেবে না, চেঁচিয়ে বলবে না ‘সাবাশ, সাবাশ’। বরং, একমাত্র সে-ই নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে গলা তুলে জিজ্ঞেস করতে পারবে, ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’

এ রাজ্যেও তো গণতন্ত্রের ওপরে আঘাত নেমে আসছে। ‘বঙ্গ’ সম্মান প্রাপকেরা তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য সে সব ফিরিয়ে দিচ্ছেন না কেন? ২০১১-তে বঙ্গবিভূষণ পাওয়া প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি তো বিশ্বাসই করি না পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে!’’ পরের বছর একই সম্মান পাওয়া শিল্পী যোগেন চৌধুরী আরও খোলামেলা, ‘‘আমি তৃণমূলের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলি না।’’ ২০১১-তে বঙ্গবিভূষণ পাওয়া সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অসুস্থতার কারণে কথা বলতে চাননি। গত বছর বঙ্গবিভূষণ প্রাপক মাধবী মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘আমি সিরিয়াল নিয়ে এত ব্যস্ত যে কোথায় কী হচ্ছে খবর রাখার সময় পাই না। তাই এ ব্যাপারে কিছু বলব না।’’ ২০১২-র বঙ্গবিভূষণ, নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘এই মুহূর্তে কোনও মন্তব্য করব না।’’ ২০১৪-তে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে একই সম্মান পাওয়া সঙ্গীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লর বক্তব্য, ‘‘রাজনৈতিক ব্যাপারে জড়াতে চাই না। পুরস্কার ফিরিয়ে প্রতিবাদ করার কথা ভাবছি না।’’

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

অকাদেমি পুরস্কার না ফেরানোর যুক্তি হিসেবে অন্য কথা বলছেন লেখক-কবি নবনীতা দেবসেন। তাঁর কথায়, ‘‘চাপটা সাহিত্য অকাদেমির দিকে চলে যাচ্ছে, ফলে এর ব্যাপ্তিটা ছোট হয়ে যাচ্ছে। আসলে বিষয়টা অনেক বড়। আমাদের আক্রমণ করতে হবে সরকারকে। অকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করার চেয়েও বেশি প্রয়োজন ভারতের মুক্ত চিন্তাকে স্বাধীন করা।’’

শুধু অকাদেমি পুরস্কারই নয়। মঙ্গলবার পদ্মশ্রী সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছেন বিশিষ্ট পঞ্জাবি লেখিকা দলীপ কউর টিওয়ানা। মঙ্গলবার সন্ধেবেলা ২০০৪ সালে পাওয়া তাঁর ‘সাহিত্য অকাদেমি স্বর্ণজয়ন্তী যুবা পুরস্কার’ ফেরানোর কথা ঘোষণা করেন এ রাজ্যের মন্দাক্রান্ত সেনও। তাঁর কথায়, ‘‘দাদরি ও তার পরে হয়ে চলা অসিহষ্ণুতার নানা ঘটনার প্রতিবাদে আমার এই সিদ্ধান্ত।’’ মন্দাক্রান্ত অবশ্য এ বিষয়ে রাজ্যে এখনও ব্যতিক্রম।

এ বার সাহিত্য অকাদেমি ফেরাচ্ছেন মন্দাক্রান্তা সেন

প্রতিবাদের বিকল্প কোনও পথ ভেবেছেন কি রাজ্যের লেখক-শিল্পীরা? সমরেশ মজুমদারের মতে, ‘‘যাঁরা পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই শক্তিশালী লেখক। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখে তাঁরা জনমত জাগ্রত করুন, মানুষকে সত্যি কথাগুলো জানান।’’ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর নিদান, ‘‘মাঠে নেমে খোলাখুলি প্রতিবাদ করতে হবে।’’ নবনীতা দেবসেন বলছেন, ‘‘আমি সমাজের গণতন্ত্রকামী, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, মুক্তচিন্তার মানুষের সই সংগ্রহে নামব। অসুস্থ শরীরে যেটুকু পারি। সেই সই আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাব।’’

আর শঙ্খবাবুর বক্তব্য, ‘‘অকাদেমি পুরস্কার না ফেরালেও অন্য ভাবে প্রতিবাদ করার কথা ভাবছি।’’ কী ভাবে? কবি বললেন, ‘‘সেটা এখনই বলব না। কয়েক জন মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’’

১৯৭৭-এ শঙ্খ ঘোষ সাহিত্য অকাদেমি পেয়েছিলেন ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য। এই বইয়েরই কবিতার লাইন—

ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

সহ-প্রতিবেদন: মধুরিমা দত্ত ও সৌভিক চক্রবর্তী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE