Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রক্তদান দিবসেই রক্তের হাহাকার

শুক্রবার সকালে পাঁচ ইউনিট প্লেটলেট জোগাড় করতে বলেছিলেন ডাক্তারবাবু। ইএম বাইপাসের ধারে এক হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গি রোগী সুবীর ঘোষের পরিবারের লোকেরা ২৪ ঘণ্টা শহরের বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্ক ঢুঁড়েও দু’টির বেশি পাননি। ও দিকে, হাসপাতাল থেকে তাগাদা আসছে ঘন ঘন।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৩৬
Share: Save:

শুক্রবার সকালে পাঁচ ইউনিট প্লেটলেট জোগাড় করতে বলেছিলেন ডাক্তারবাবু। ইএম বাইপাসের ধারে এক হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গি রোগী সুবীর ঘোষের পরিবারের লোকেরা ২৪ ঘণ্টা শহরের বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্ক ঢুঁড়েও দু’টির বেশি পাননি। ও দিকে, হাসপাতাল থেকে তাগাদা আসছে ঘন ঘন। রোগীর প্লেটলেট যে নেমে গিয়েছে ৩০ হাজারে!

এসএসকেএম হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে শনিবার সকালে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলেন সবিতা অধিকারী। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত তাঁর এক মাত্র ছেলের এবি নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত দরকার। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানেই খোঁজ নিয়েছেন শুনতে হয়েছে, রক্ত নেই।

শনিবার ছিল ‘ন্যাশনাল ভলান্টারি ব্লাড ডোনেশন ডে’। সরকারি তরফে এ নিয়ে ন্যূনতম প্রচার নেই। উল্টে রক্তদান দিবসেই দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীর পরিজনদের এক ইউনিট রক্তের জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে কলকাতার ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিতে। পরিস্থিতির সুযোগে রক্তের কালোবাজারিরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এক ইউনিট রক্ত তিন-চার হাজার টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে!

সুমনা সরকারের সমস্যা অন্য। তাঁর ৮০ বছরের বৃদ্ধা মায়ের হার্টের গুরুতর সমস্যা ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছেন, অবিলম্বে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা দরকার। কিন্তু কে করবেন অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি? ডাক্তারবাবু তো ছুটিতে যাচ্ছেন মঙ্গলবার, ফিরবেন লক্ষ্মীপুজো কাটিয়ে! তত দিন গুরুতর অসুস্থ রোগী কেমন থাকবেন, সেই আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে রয়েছে পরিবার।

শুধু সপ্তমী থেকে দশমীর চার দিন নয়, শুক্রবার কার্যত মহালয়ার দিন থেকেই পুজোর ছুটি শুরু হয়ে গিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের একটা বড় অংশে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের একটা বড় অংশ ছুটিতে যেতে শুরু করেছেন। বহু ক্ষেত্রেই বিকল্প ব্যবস্থা হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়াবহ রক্তের আকাল। রাজ্যে ডেঙ্গির প্রকোপ এখনও যে রকম জাঁকিয়ে বসে আছে, তাতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য বলছে, যাঁরা রক্ত আনতে যাচ্ছেন, তাঁদের অর্ধেককে ‘নেই’ বলে শুরুতেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাঁদের রক্ত দেওয়া হবে বলে কাগজপত্র নেওয়া হচ্ছে, তাঁদের ভাগ্যেও পাঁচ ইউনিট চেয়ে মিলছে এক ইউনিট।

কেন এই হাল?

ব্লাড ব্যাঙ্ক সূত্র বলছে, পুজো-মরসুমে রক্তদান শিবির কম হচ্ছে। অনেক সংগঠন শিবির করার প্রস্তাব নিয়ে এলেও লোকবলের অভাবে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেটুকু রক্তদান হচ্ছে, তার একটা বড় অংশ যাচ্ছে বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে। থমকে রয়েছে রক্তের উপাদান বিভাজনের কাজও। রক্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে ডেঙ্গি রোগীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য সরকারের মৌখিক নির্দেশ রয়েছে। আকালের জেরে তাঁরাও রক্ত পাচ্ছেন না। থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া, ক্যানসার রোগীদের অবস্থা আরও সঙ্গীন।

পরিস্থিতি যে ভয়াবহ, তা মানছেন মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা কুমারেশ হালদার। ‘‘আমরা পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছি। পুজোর মধ্যেও তিন দিন রক্তদান শিবির আছে। তবে শুধু আমরা চেষ্টা করলেই হবে না। বাকিদেরও করতে হবে,’’ বলেন কুমারেশবাবু। ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অপূর্ব ঘোষের আশঙ্কা, ‘‘যা পরিস্থিতি, তাতে পুজোর ছুটিতে কোনও বড় বিপর্যয় না ঘটে যায়!’’ রক্তদান আন্দোলনের নেতা দীপঙ্কর মিত্রের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিকে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। স্বাস্থ্য ভবনও তা বলছে। কিন্তু কর্মীদের একটা বড় অংশ মানছেন না। এটা দুর্ভাগ্যের!’’ বহু শূন্য পদ সমস্যা আরও বাড়িয়েছে।

রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী অবশ্য কোনও সমস্যাই দেখছেন না। তাঁর বক্তব্য, কোনও কোনও দিন একটু সমস্যা হচ্ছে। সে জন্য রক্তদান শিবিরের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু পুজোয় ডাক্তারের আকাল কি এ বার ডেঙ্গি পরিস্থিতিতেও একই রকম থাকবে? তাঁর জবাব, ‘‘ডাক্তারদের আলাদা ডিউটি চার্ট তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য ভবন খোলা থাকবে। আমি নিজে পুজোর চার দিন অফিস করব।’’

কিন্তু মহালয়া থেকেই যে ভাবে পরিস্থিতি সঙ্গীন হতে শুরু করেছে, তাতে স্বাস্থ্য অধিকর্তার আশ্বাস কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে।

সঙ্কটের পাঁচ

• পর পর রক্তদান শিবির বাতিল

• সরকারি ব্যাঙ্কে উপাদান বিভাজন খুবই কম

• রক্তের আকালে দালালচক্র সক্রিয়

• মহালয়া থেকেই ডাক্তারের সংখ্যা কমছে

• স্বাস্থ্য দফতরের বিকল্প ব্যবস্থা নেই

পুজোয় রক্তদান

• আরজিকর, এসএসকেএম, ন্যাশনাল: কোনও শিবির নেই

• এনআরএস: দশমীতে হতে পারে

• কলকাতা মেডিক্যাল: সপ্তমী-১টি নবমী-১টি

• সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক: সপ্তমী-৪টি, অষ্টমী-নেই, নবমী-১টি, দশমী-২টি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

SSKM hospital Blood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE