পায়েল এখন ক্লাস এইট। কিন্তু জীবন ক্রমশ কঠিন হয়েছে।—নিজস্ব চিত্র।
বয়স তখন মাত্র ২ বছর ৪ মাস। পায়েল মায়ের কোলে। রাতের অন্ধকার নেমেছে। বিডিও অফিস চত্বরে লাগানো সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পগুলো অন্ধকার তাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু হঠাৎ নিভে গেল সেই আলোগুলোও। অন্ধকার, হইচই, দৌড়ঝাঁপ। অবেশেষে চন্দননগরের পুলিশ লক-আপে দেখা মিলল ছোট্ট পায়েলের। মা কৃষ্ণার কোলে অবিরাম কেঁদে চলেছে পায়েল।
সেই শুরু। তার পর প্রায় ১০টা বছর কেটে গিয়েছে। পায়েল এখন ক্লাস এইট। কিন্তু জীবন ক্রমশ কঠিন হয়েছে।
২০০৬ সাল। সেপ্টেম্বর মাস। সিঙ্গুরে জমি আন্দোলন তুঙ্গে উঠছে। টাটার কারখানা গড়ার জন্য জমি অধিগ্রহণ করেছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। কিন্তু জমি দিতে নারাজ কৃষকদের একাংশ। পায়েলের বাবা-মা তাঁদেরই অন্যতম। তাই জমির দাম বাবদ সরকার যে চেক দিচ্ছে, পায়েলের পরিবার তা নেয়নি। ২৫ সেপ্টেম্বর পায়েলদের বাড়িতে খবর গেল, জমির চেক ভুয়ো সই করে অন্য কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সিঙ্গুরের গ্রামের পর গ্রামে সে দিন ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এই খবর। রতনপুর, বেড়াবেড়ি, খাসেরভেড়ি, জয়মোল্লা থেকে বহু মানুষ ছুটে গেলেন সিঙ্গুর বিডিও অফিসে। শুরু হল বিক্ষোভ। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে বিক্ষোভ ক্রমশ উত্তাল হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে। কৃষ্ণা বাগ এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারেন সেই রাতের কথা। ক্রমশ প্রচুর পুলিশ ঘিরে ফেলছিল গোটা এলাকা। তবু কেউ বিডিও অফিস চত্বর ছাড়তে রাজি নন। রাত বাড়তেই আলো নিভল। ব্যাপক ধরপাকড় চালাল পুলিশ। ছত্রভঙ্গ হলেন বিক্ষোভকারীরা।
২ বছর ৪ মাসের মেয়েকে বাড়িতে রেখে আসতে পারেননি কৃষ্ণা। মেয়েকে কোলে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন বিডিও অফিসে। তাই ধরপাকড়ের পর মেয়েকে কোলে নিয়েই সোজা লক-আপ।
কৃষ্ণা বাগের সঙ্গে তাঁর শিশুকন্যা পায়েল বাগের গ্রেফতারি সিঙ্গুর আন্দোলনের ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা। তিন রাত লক-আপে কাটে মা আর শিশুকন্যার। তার পর জামিনে বাড়ি ফেরা। কৃষ্ণার চোখে আজও ঘৃণা। ‘‘বাচ্চা মেয়েটার জন্য দুধ চেয়েছিলাম লক-আপে। তাও দেয়নি পুলিশ।’’ বেড়াবেড়ি পূর্বপাড়ায় নিজের বাড়িতে ছোট্ট একফালি বারান্দায় বসে স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন কৃষ্ণা। কিন্তু স্মৃতির রাজ্যে বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না। ঘৃণা ছাপিয়ে কৃষ্ণা বাগের চোখে ফুটে উঠল হতাশা। এত কিছু হল, এত লড়াই দিলাম, কিন্তু কী পেলাম? প্রশ্নটা ঘুরপাক খেয়ে ফিরে আসছিল বার বার।
পড়ুন
শিল্পের জন্য পথ হাঁটা শুরু আজ, সিঙ্গুরে বুদ্ধ
সিঙ্গুর থেকে শিল্পের পক্ষে জোরালো সওয়াল বুদ্ধের, জোটের ডাকও
জমি গিয়েছে। তৎকালীন বিরোধী দলের কথা শুনে জমির দামও নেওয়া হয়নি। আজ সেই দল রাজ্যের শাসক। কিন্তু পরিবারের কী হল? পায়েলের বাবা অসুস্থ। হার্টের অসুখ। অন্যের জমিতে মজুরি খাটার ধকল শরীর নিতে পারে না। কৃষ্ণা বাগের আশা ছিল ‘দিদি’ সরকারে এলে কিছু সুরাহা হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ‘দিদি’ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সাড়ে চার বছর কেটে গেলেও সে আশা আশাই রয়ে গিয়েছে। পায়েল এখন ক্লাস এইট। কিন্তু ভবিষ্যতটা কেমন? দেখতে পাচ্ছেন না কৃষ্ণারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy