Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
কথা যেমন, খাতা তেমন নয়

নোট বাতিলের জেরে লাভই হয়েছে বাংলার!

নোট নাকচের সিদ্ধান্তকে বাজেট বক্তৃতায় আগাগোড়া তুলোধোনা করলেন অমিত মিত্র। মোদ্দা অভিযোগ, কেন্দ্রের ওই হঠকারী পদক্ষেপে জোর ধাক্কা খেয়েছে দেশের অর্থনীতি।

চলছে রাজ্য বাজেট। ফাঁকা বিরোধী আসন। শুক্রবার বিধানসভায়। — নিজস্ব চিত্র।

চলছে রাজ্য বাজেট। ফাঁকা বিরোধী আসন। শুক্রবার বিধানসভায়। — নিজস্ব চিত্র।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০২:৩৭
Share: Save:

নোট নাকচের সিদ্ধান্তকে বাজেট বক্তৃতায় আগাগোড়া তুলোধোনা করলেন অমিত মিত্র। মোদ্দা অভিযোগ, কেন্দ্রের ওই হঠকারী পদক্ষেপে জোর ধাক্কা খেয়েছে দেশের অর্থনীতি। আর তার খেসারত গুনতে হচ্ছে রাজ্যকে। কিন্তু রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর এই বয়ানে শুক্রবার যেন মুচকি হেসেছে তাঁর হাতে তৈরি বাজেটের সংখ্যাই। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, নোট বাতিলের জেরে ক্ষতি হওয়া তো দূর অস্ত্‌, বরং কিছুটা লাভই হয়েছে বাংলার!

শুধু নোট বাতিলের পরের দু’মাসে ৫,৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারানোর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে রাজ্য। অথচ এ দিন অমিতবাবু যে রাজ্য বাজেট পেশ করলেন, তার পরিসংখ্যান বলছে, এই অর্থবর্ষে রাজ্যের নিজের কর আদায় পৌঁছে যাবে লক্ষ্যের কাছাকাছি। আদায় কম হবে মাত্র ১,৮৪৭ কোটি টাকা। যেখানে আগের বার এই ফারাক ছিল ৪,০০০ কোটি। নোট বাতিলের ঝঞ্ঝাট কিন্তু তখন ছিল না।

চোখে পড়ার মতো বেড়েছে কেন্দ্রীয় করের ভাগও। ২০১৬-’১৭ সালে ওই খাতে ৪১,৮৬১ কোটি টাকা পাওয়ার কথা ছিল। সেখানে মিলছে ৪৪,৬২৫ কোটি।

কর ও কর বহির্ভূত আয় মিলিয়ে, রাজ্যের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। সেখানে সংশোধিত হিসাবে রাজ্যের দাবি, তা হবে ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৩৪০ কোটি। অর্থাৎ, ফারাক প্রায় নেই বললেই চলে। অর্থকর্তারা মানছেন যে, রাজস্ব আদায়ে এমন সাফল্য অতীতে আসেনি। তাঁদের কথায়, ‘‘একে নোট বাতিলের সুফলই বলতে হবে।’’ অনেকের মতে, নোট বাতিলের ঠেলায় পড়ে এখন কারবার ‘সাদা’ করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। রাজ্যের নিজস্ব কর আদায় ভাল হওয়ার সেটাও একটা বড় কারণ।

অমিতবাবু বক্তৃতার গোড়ায় বলেছেন, ‘‘পৃথিবীর যে সমস্ত দেশে অতীতে নোট বাতিল হয়েছে, সেখানে একনায়কতন্ত্র ছিল। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেবে।’’ এমনিতে নোট বাতিলে কৃষি, ছোট শিল্প যে ধাক্কা খেয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এর দরুন কাজ হারিয়েছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের বহু কর্মী। শিল্পের চাকা শ্লথ হওয়া কিংবা দেশের বৃদ্ধির হার ঝিমিয়ে পড়ার অভিযোগও মিথ্যে নয়। কিন্তু ঘটনা হল, এর দৌলতে কর আদায় বাড়ার সুফল কেন্দ্রের মতো পুরোদস্তুর পেয়েছে রাজ্যও।

অর্থমন্ত্রীও এই সত্যিটুকু সম্ভবত বিলক্ষণ জানেন। তাই অর্থনীতিবিদদের উল্লেখ করে এক দিকে তিনি বলেছেন যে, নোট নাকচের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে ২-৩ বছর লেগে যাবে। অথচ অন্য দিকে, আগামী অর্থবর্ষে রাজ্যের নিজের কর আদায় এ বারের সংশোধিত হিসেবের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়বে বলে পরিসংখ্যানে দেখিয়েছেন তিনি। আশা রেখেছেন, কেন্দ্রীয় করের ভাগ বাড়বে প্রায় ৫ হাজার কোটি। এ বারের বাজেটেও মোট ১ লক্ষ ২৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৭৮ হাজার কোটিই আসছে দিল্লি থেকে।

অর্থ দফতরের কর্তাদের একাংশ মানছেন, অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়লে, কর আদায় এ ভাবে বাড়ে না। তাঁরা জানান, কেন্দ্রীয় করের ভাগ বেড়েছে আয়কর, পরিষেবা কর ইত্যাদি খাতে দিল্লির বাড়তি আদায় হওয়ায়। যার মূল কারণ আসলে নোট বাতিলই। পরিষেবা কর বৃদ্ধির জন্য রাজ্য গেল-গেল রব তুলেছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, আখেরে সেই খাতেও বাড়তি ১,২০০ কোটি পেতে পারে বাংলা।

এ ছাড়াও তথ্য বলছে, স্ট্যাম্প ডিউটি ছাড়া আর প্রায় কোনও খাতেই রাজ্যের আয় কমেনি। অর্থ দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘আবাসন শিল্পে কালো টাকার কারবার বেশি। নোট বাতিলে তা মার খেয়েছে। কিন্তু বাদবাকি প্রায় সব ক্ষেত্রে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী কর দিতে বাধ্য হওয়ায় রাজ্যের ভালই রোজগার হয়েছে।’’ যদিও বাজেট পেশের পরেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, রাজ্যের আয় ২৫% কমতে পারে।

শুধু রাজস্ব আদায়ে নয়। নোট বাতিল নিয়ে রাজনীতির দাবি অর্থনীতির সংখ্যার সঙ্গে খাপ খায়নি আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রেই। যেমন, নোট কাণ্ডের জেরে যে শিল্প সম্মেলন রাজ্য পিছিয়ে দিতে চেয়েছিল, সেখানে ২ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। রাজ্যের দাবি ছিল, নোট বাতিলের ফলে সমবায় ব্যাঙ্কের মাধ্যমে চাষিদের দাদন দেওয়া কার্যত বন্ধ। চাষবাস বন্ধ হলে রাজ্যে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি হবে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। চাষিরা ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বলে দাবি করে এ দিনও তাঁদের জন্য ১০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিলের কথা ঘোষণা করেছেন অমিতবাবু। অথচ বাজেট-পরিসংখ্যান বলছে, ৪২ লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে। সমবায়গুলির মাধ্যমে বিলি হওয়া কৃষিঋণের অঙ্ক বছরের শেষে গিয়ে দাঁড়াবে অন্তত ২,০০০ কোটি টাকায়!

খটকা রয়ে গেল আরও বেশ কিছু জায়গাতেই। যেমন, নোট নাকচের পরে অর্থমন্ত্রী জোর গলায় দাবি করেছিলেন, নীতিগত ভাবে বিরোধী না হলেও এ বার জিএসটি চালুর প্রক্রিয়া রয়েসয়ে এগোবেন তাঁরা। কারণ, নোটবন্দির সঙ্গে জিএসটির ‘ডবল ধামাকা’ সামলানো দেশের অর্থনীতির পক্ষে বেশ কঠিন হবে। কিন্তু এ দিন সেই অবস্থান বদলে ফেল অমিতবাবু বলেছেন, আখেরে এতে সাধারণ মানুষ, ছোট ব্যবসায়ীদের ভালই হবে। এমনকী ঘুরপথে জিএসটি চালুর বিষয়ে রাজ্যের কিছুটা কৃতিত্বই দাবি করেছেন তিনি। এ বছর ১৩ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থানের কথা বলেছেন অমিতবাবু। কিন্তু তাতে রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের প্রতিক্রিয়া, ‘‘দেশে মোট নতুন কাজের সংখ্যাই তো দেড় লক্ষ বলে বাজেটে জানিয়েছে কেন্দ্র!’’

রাজ্যের ঘাড়ে ঋণের বিপুল বোঝা চেপে থাকার জন্য পূর্বতন বাম সরকারের দায় মনে করিয়ে দেওয়ার পালা এ বারও একই রকম বজায় থাকল। ঘোষণা রইল অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের ভাতা বৃদ্ধির। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল নোট কাণ্ডে কাজ হারানো ৫০ হাজার কর্মীকে (বিশেষত কারিগর) ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়ার।

ছোট শিল্পকে চাঙ্গা করতে করনীতিতে একগুচ্ছ সুবিধার কথাও ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী। বলা হল আবাসন শিল্পকে চাঙ্গা করতে স্ট্যাম্প ডিউটি মেটাতে বাড়তি সময় দেওয়ার কথা। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর পরেও দিনের শেষে এই রাজ্য বাজেট হয়ে রইল পাশাপাশি শুয়ে থাকা সংখ্যা ও শব্দের দুই রেললাইনের মতো। যারা প্রায় কখনওই মেলেনি।

অমিতবাবুকে পাশে বসিয়ে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘(নোট বাতিল) বড় ধাক্কা। তারপরেও ডাল-ভাতের বাজেট করা হয়েছে। যেটুকু সামর্থ্য, সেটুকুই করা হয়েছে।’’ তবে দিনের শেষে দেখা যাচ্ছে, সেই রান্নার বাজার অনেকটা করে দিয়েছে নোট নাকচ নিয়ে তোপের মুখে থাকা সেই কেন্দ্রই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Taxation State Budget Demonetisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE