Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

শ্বশুর-শাশুড়ির দিকেও সেবার হাত, পরিবারের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প

নিজের সংসারেই অভাব। অসুস্থ বাবার ভাল চিকিৎসা করাতে চেয়েও পারতেন না মল্লিকা দেবাংশী। বাঁকুড়ার ছাতনা ব্লকের জামতোড়া গ্রামের ওই গৃহবধূর স্বামী বিদ্যুৎ দেবাংশী সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ করে যে-বেতন পান, তাতে শ্বশুরের চিকিৎসার খরচ তাঁর উপরে চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৪৭
Share: Save:

নিজের সংসারেই অভাব। অসুস্থ বাবার ভাল চিকিৎসা করাতে চেয়েও পারতেন না মল্লিকা দেবাংশী। বাঁকুড়ার ছাতনা ব্লকের জামতোড়া গ্রামের ওই গৃহবধূর স্বামী বিদ্যুৎ দেবাংশী সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ করে যে-বেতন পান, তাতে শ্বশুরের চিকিৎসার খরচ তাঁর উপরে চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। মনের কষ্ট মনেই চেপে রেখেছিলেন মল্লিকা।

সপ্তাহখানেক আগে সেই মল্লিকাই তাঁর তিয়াত্তর বছরের বাবার পেটের টিউমার অস্ত্রোপচার করিয়ে এনেছেন নামী বেসরকারি হাসপাতাল থেকে। বরের পকেট থেকে এক টাকাও খরচ করতে হয়নি তাঁকে! ‘ক্যাশলেস’ চিকিৎসা হয়েছে মল্লিকার বাবার।

এটা সম্ভব হল কী ভাবে?

জবাবে একটি কার্ড বার করে দেখালেন মল্লিকা। সেটা তাঁর স্বামীর ‘স্বাস্থ্যসাথী’র কার্ড। ‘‘নিজে তো চাকরি করি না। এতগুলো টাকা পকেট থেকে খরচ করে আমার বাবার অপারেশন করানোর কথা কোনও দিন বরকে বলতে পারতাম না। মুশকিল আসান করে দিয়েছে এই কার্ডটাই,’’ বললেন মল্লিকা।

আসলে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে চালু হওয়া ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্প ‘পরিবার’-এর সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছে। বৃহত্তর আকার নিয়েছে পরিবারের বৃত্ত। সাধারণ ভাবে এত দিন কোনও স্বাস্থ্য প্রকল্পে সুবিধা-প্রাপকেরা হতেন যাঁর নামে বিমা, তিনি এবং তাঁর স্বামী বা স্ত্রী, তাঁদের নাবালক সন্তান। এবং সেই সঙ্গে বড়জোর বিমাকারীর বাবা-মা। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে ‘পরিবার’ হিসেবে ঢোকানো হয়েছে বিমাকারীর শ্বশুর এবং শাশুড়িকেও। সেই সুবাদেই স্বামীর কার্ড নিয়ে নিজের বাবার অর্থাৎ তাঁর স্বামীর শ্বশুরের চিকিৎসা করাতে পেরেছেন মল্লিকা।

স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প কাদের জন্য?

এই প্রকল্পের আওতায় আছেন মূলত সরকারি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত স্বল্প বেতনের অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা। যেমন আশা-কর্মী, আইসিডিএসের কর্মী, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য, সিভিক ভলান্টিয়ার, গ্রিন পুলিশ, হোমগার্ড, ভিলেজ ভলান্টিয়ার। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, ‘‘স্বল্প বেতনের ওই কর্মীরা নিজের বা নিকটাত্মীয়ের চিকিৎসার খরচ চালাতে পারছিলেন না। ওঁরা যে-হেতু দারিদ্রসীমার নীচের বাসিন্দা নন, তাই আরএসবিওয়াই বা ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা’র সুবিধাও পাচ্ছিলেন না। ওঁদের কথা ভেবেই এই প্রকল্প চালু করা হয়েছে।’’

ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক বন্ধন ও সম্পর্কের দিক দিয়ে স্বামী-স্ত্রীর নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়িকেও তাঁদের বাবা-মায়ের মর্যাদাই দেওয়া হয়। এঁদের প্রত্যেকের দায়িত্বই স্বামী ও স্ত্রী দু’জনের নেওয়ার কথা। ‘‘কিন্তু এখনও আমাদের সামাজিক পরিস্থিতিতে অনেক পুরুষই স্ত্রীর বাবা-মায়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে চান না। নিজস্ব রোজগার না-থাকলে স্ত্রীও নিজের বাবা-মাকে সাহায্য করতে পারেন না এবং চরম মনঃকষ্টে ভোগেন,’’ বলছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী। তিনি জানান, এই অসুবিধা দূর করতেই স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে সুবিধা-প্রাপকের তালিকায় কর্মীদের শ্বশুর-শাশুড়িদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্য কোনও সরকারি স্বাস্থ্য বিমায় এই সুবিধা নেই।

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে সুবিধা-প্রাপকদের তালিকায় শ্বশুর-শাশুড়িরা চলে আসতেই জেলায় জেলায় রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছে। ১ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প চালু হওয়ার পরে প্রথম ১৫ দিনের মধ্যেই অন্তত ১২০০ জন এই প্রকল্পের আওতায় চিকিৎসার সুযোগ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডধারী কর্মীর শ্বশুর বা শাশুড়ি হিসেবে চিকিৎসার সুবিধা পেয়েছেন, এমন রোগীর সংখ্যা অন্তত ২৫০!

জামতোড়ার মল্লিকার মতো বাঁকুড়ার পুরন্দরপুরের মিঠু নন্দী বা বীরভূমের ময়ূরেশ্বর-২ ব্লকের বন্দিহাটের বাসিন্দা মানসী খন্দকারের মতো অনেকেই উচ্ছ্বসিত। মিঠুর স্বামী গোপাল ভিলেজ ভলান্টিয়ার আর মানসীর স্বামী স্বরূপ হোমগার্ড। স্বামীদের নামে পাওয়া স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডেই সম্প্রতি মিঠুর বাবা এবং মানসীর মায়ের ‘ক্যাশলেস’ অস্ত্রোপচার হয়েছে। ওই দুই গৃহবধূ জানিয়েছেন, এই কার্ড না-থাকলে কোনও দিনই স্বামীরা পকেট থেকে এত টাকা দিয়ে শ্বশুর বা শাশুড়ির এই চিকিৎসা করাতে পারতেন না।

স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের জন্য দরপত্র ডেকে দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সং‌স্থাকে বাছাই করা হয়েছিল। দুই সংস্থার তরফে দুই রিজিওনাল ম্যানেজার বাসুদেব সান্যাল ও মণীশ মালিক জানাচ্ছেন, স্বাস্থ্যসাথীতে সংশ্লিষ্ট কর্মীর শ্বশুর-শাশুড়ির চিকিসার প্রিমিয়াম গুনছে সরকারই। শ্বশুর বা শাশুড়ির চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে কর্মীরা তাই আর ইতস্তত করছেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE