দেড় বছর পর হারানো ছেলেকে খুঁজে পেলেন বাবা। চারঘাট ফাঁড়িতে। —নিজস্ব চিত্র।
মাস চারেক ধরে চারঘাট বাজারে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছিল ছেলেটাকে। অসংলগ্ন হাঁটতে হাঁটতে কখনও-সখনও গ্রামের ভিতরেও। গোটা গ্রামে কেউ চিনতেন না বছর চৌত্রিশের ওই যুবককে। আশপাশের বিশ-পঞ্চাশটা গ্রামে তাঁর কোনও আত্মীয়-পরিজন রয়েছেন, এমন খবরও কারও কাছে ছিল না। উদ্দেশ্যবিহীন চলাফেরা, উদভ্রান্ত চাউনি, আপন মনে বিড়বিড়ানি দেখে সকলেই কম-বেশি বুঝতেন, এ ছেলের মানসিক ভারসাম্য টলে গিয়েছে।
কিন্তু চকোলেটের প্যাকেটে ‘এক্সপায়ারি ডেট’-টা অভ্রান্ত খুঁজে নিয়ে গোপাল যে দিন প্যাকেটটা ফিরিয়ে দিল দোকানদারের হাতে, উত্তর ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত প্রান্তের নিস্তরঙ্গ বাজারটা সে দিন বেজায় চমকে গেল।
বিহারের পটনা জেলার বাঢ় ব্লক। সেখান থেকে কলকাতার দূরত্ব কম-বেশি সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার। কলকাতা থেকে মছলন্দপুর ৭৬ কিলোমিটার। সেই মফস্সল স্টেশনে নেমে আরও ৮ কিলোমিটার ভিতরে ঢুকলে চারঘাট বাজার।
আশপাশের গোটা তিরিশেক গ্রামের মধ্যে চারঘাটের বাজারটাই একটু বড়সড়। স্বাভাবিক ভাবেই সদর গোছের। বাজারের মাঝেই ছোট্ট একটা বাড়িতে পুলিশ ফাঁড়ি। পিছন দিকে ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা একটা ছোট মাঠ। সে মাঠে পড়ে রয়েছে পুলিশের হাতে আটক হওয়া বেশ কয়েকটা গাড়ি। বিহারের বাঢ় থেকে আসা গোপালকুমার বর্মা সে রকমই একটা গাড়ির মধ্যে সেঁধিয়ে যেতেন রাত নামলেই। সকাল হলেই আবার উদভ্রান্ত ঘোরাঘুরি শুরু হয়ে যেত।
‘‘কোথা থেকে এসেছে, আমরা কেউই জানতাম না। তবে বুঝতাম মাথার ঠিক নেই। এই বাজারেই কেউ কেউ ডেকে খেতে দিতেন। কখনও না খেয়েও হয়ত থাকত। কিন্তু ও যে বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র, বুঝতেই পারিনি কখনও।’’ বললেন স্থানীয় ব্যবসায়ী মানস বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: গরাদে দাঁতে শান মুসার, ভয়ে কাঁটা রক্ষীরা
কী ভাবে সামনে এল পরিচয়? স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানালেন, কেউ কেউ ওঁকে মাঝে-মধ্যে কিছু টাকা-পয়সা দিতেন। সেই টাকায় গোপাল খাবার-দাবার কিনে খেতেন। কয়েক দিন আগে মধ্যম মণ্ডলের দোকানে হাজির হয়ে ১০ টাকার একটা নোট দিয়ে চকোলেট চান গোপাল। মধ্যমবাবু চকোলেটও দেন। এক্সপায়ারি ডেট সম্ভবত খেয়াল করেননি তিনি। কিন্তু গোপাল বর্মা সর্বাগ্রে সেটাই খুঁজে দেখেন এবং জানিয়ে দেন, ওই চকোলেট তিনি নেবেন না, কারণ ওটার সময় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে।
মধ্যম মণ্ডলের বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না। পাশেই শ্যামল সরকারের বস্ত্র বিপণি। শ্যামলবাবুকে ঘটনাটা জানান মধ্যম। শ্যামলও চমকে যান। তার পর গোপালকে ডেকে নাম-ধাম জিজ্ঞাসা করা শুরু হয়।
চারঘাট বাজারে এই দুই দোকানের সামনেই পরিচয় প্রকাশ্যে আসে গোপালকুমার বর্মার। —নিজস্ব চিত্র।
মেজাজ সে দিন সম্ভবত ভালই ছিল গোপালের। বাড়ির ঠিকানা বলে দেন তিনি। যোগাযোগের নম্বর আছে? প্রশ্ন শুনে গড়গড় করে কয়েকটা ফোন নম্বরও আউড়ে দেন। তারই একটাতে ফোন করে শ্যামল সরকার ধরে ফেলেন গোপাল বর্মার মামাকে। শুক্রবার এই ফোনালাপ। রবিবার বিকেলের মধ্যেই প্রায় সাড়ে ছশো কিলোমিটার দূরবর্তী বাঢ় থেকে চারঘাটে পৌঁছন গোপালের বাবা ও মামা। দেড় বছর পর দেখা পান ছেলের।
গোপালের পরিচয় জানার পর সক্রিয় হয়েছিলেন চারঘাট ফাঁড়ির কর্তা সাব-ইনস্পেক্টর তাপস ঘোষ। মাসের পর মাস বনে-বাদাড়ে রাত কাটানো গোপালের থাকার বন্দোবস্ত ফাঁড়ির ভিতরেই করে দিয়েছিলেন তিনি। তাপস ঘোষের জিম্মা থেকেই ছেলেকে ফিরে পেয়েছেন সত্তরোর্ধ্ব সুনীলকুমার বর্মা।
আরও পড়ুন: ‘কষ্ট কম হল, ভগবান বোধ হয় খুশি হলেন না!’
আজ, মঙ্গলবার সকালেই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছেছেন সুনীল। ফোনে বললেন, ‘‘দিল্লির এক কলেজে পড়াশোনা করছিল গোপাল। একটা পরীক্ষা হওয়ার পরে আমরা গিয়েছিলাম দেখা করতে। তখনই আচরণে অসংলগ্নতা টের পাই। চোখের সামনে রেখে চিকিৎসা করাব বলে বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছিলাম। নানা জায়গায় চিকিৎসা করিয়েছি। সব শেষে রাঁচী নিয়ে গিয়েছিলাম। চিকিৎসকেরা বলেন, ওঁর সমস্যা খুব জটিল নয়। আবাসিক চিকিৎসার প্রয়োজন নেই, ওষুধেই সেরে যাবে। তাই বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা চলছিল। এক দিন দুপুরে হঠাৎ বাড়ি থেকেই নিখোঁজ হয়ে যায়।’’
সুনীলকুমার বর্মা জানালেন, ২০১৬-র ২০ অগস্ট নিখোঁজ হয়েছিল গোপাল। হন্যে হয়ে খুঁজেছেন তার পর থেকে। কখনও খবর এসেছে, বড়হিয়া স্টেশনে দেখা গিয়েছে ছেলেকে। কখনও শোনা গিয়েছে লক্ষ্মীসরায়তে দেখা গিয়েছে। খবর পাওয়া মাত্র ছুটে গিয়েছেন। কিন্তু গোপালকে পাননি। অনির্দিষ্ট ভাবে ঘুরতে ঘুরতে বাঢ় থেকে এত দূরে, বাংলার প্রত্যন্ত প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে গোপাল, কল্পনাও করতে পারেনি তাঁর পরিবার।
ফোনে কথা বলতে বলতে আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসছিল প্রবীণ সুনীলকুমারের গলা। তিন জনের নাম বার বার বলছেন সুনীল— সাব-ইনস্পেক্টর তাপস ঘোষ, বস্ত্র ব্যবসায়ী শ্যামল সরকার আর স্টেশনারি দোকানদার মধ্যম মণ্ডল। ‘‘এঁদের কী বলে ধন্যবাদ দেব আমি জানি না। এঁরা না থাকলে কোনও দিন কি আর ফিরে পেতাম ছেলেকে? জানি না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy