সাবিত্রী বিশ্বাস (মিশ্র), সবিতা মিশ্র এবং সরস্বতী মিশ্র
তিন বোন। এক জন ৮২, এক জন ৭৭, আর এক জন ৭২। প্রথম ও তৃতীয় জন বিয়ে করেননি। মাঝের জন ঘোর সংসারী। জীবন-সায়াহ্নে পৌঁছে তিন বোন তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তির প্রায় পুরোটাই দান করেছেন বেলুড়ের শ্রমজীবী হাসপাতালকে। সরকারি হিসেবে সেই সম্পত্তির মূল্য কম করেও তিন কোটি টাকা।
অথচ এই তিনের কেউ-ই কোটিপতি নন। তিন বোন, বালির দেওয়ান গাজী রোডের মিশ্র বাড়ির তিন কন্যা সবিতা মিশ্র, সাবিত্রী বিশ্বাস (মিশ্র) এবং সরস্বতী মিশ্র নেহাতই মধ্যবিত্ত।
কর্মজীবনে সবিতাদেবী পড়িয়েছেন সংস্কৃত কলেজ, লেডি ব্রেবোর্ন এবং বেথুনের মতো কলেজে। আর সরস্বতীদেবী পিএইচডি করছেন লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্সে। ইংরেজি ছাড়াও সংস্কৃত, পালি এবং উর্দুতে অসাধারণ দখল রয়েছে সরস্বতীদেবীর। গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করেছেন ন্যাশনাল লাইব্রেরি, প্রেসিডেন্সি কলেজ-সহ বিভিন্ন সরকারি কলেজে। দুই বোন থাকেন দেওয়ান গাজী রোডে প্রায় একশো বছরের পুরনো পৈতৃক বাড়িতে। সেই বাড়ি এবং লাগোয়া প্রায় তিন বিঘে জমি এবং একটি পুকুর তাঁরা দান করেছেন শ্রমজীবী হাসপাতালকে। তাঁদের সিদ্ধান্তে সামিল হন বেলগাছিয়ার মিল্ক কলোনির সরকারি আবাসনের বাসিন্দা মেজ বোন সাবিত্রীদেবীও।
তিন কন্যা জানান, জনকল্যাণের জন্য নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি তাঁরা প্রথমে একটি আধ্যাত্মিক সংগঠনকে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু সেই সংগঠন প্রস্তাব দেয়, সম্পত্তি বিক্রি করে নগদ টাকা তাদের হাতে তুলে দিতে। তাঁরা রাজি হননি। সবিতাদেবী বলেন, ‘‘টাকা দেব কেন! আমরা তো চাই এই বাড়িতেই কর্মযজ্ঞ শুরু হোক। সেই যজ্ঞে আমরাও অংশ নেব।’’ আরও দু’টি সংগঠনের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন তাঁরা। কিন্তু কেউই সে ভাবে এগিয়ে আসেনি বলে জানিয়েছেন সাবিত্রীদেবী। এর পরেই, মিশ্র-কন্যারা শ্রমজীবী হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সরস্বতীদেবী বলেন, ‘‘এক ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য কলকাতার সরকারি এবং নামজাদা বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরতে হয়েছে আমাদের। ভেলোরেও গিয়েছি তিন বার। সব মিলিয়ে অভিজ্ঞতা একেবারেই ভাল নয়।’’ তবে শ্রমজীবী হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগের পরে ধারণা বদলায় তিন বোনের। সরস্বতীদেবীর কথায়, ‘‘শ্রমজীবী গরিব মানুষের জন্য ধারাবাহিক ভাবে কাজ করে চলেছে।’’ বেলুড়ের এই হাসপাতালের বাহুল্য-বর্জিত স্বল্প খরচে চিকিৎসা এবং মানুষের সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহার তাঁদের আকৃষ্ট করে। সরস্বতীদেবী বলেন, ‘‘এরা খুবই যত্নবান। গরিব মানুষের বড় ভরসা এই হাসপাতাল।’’
১৯৮২-তে বেলুড়ের ইন্দো-জাপান স্টিল কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই হাসপাতালের কাজ শুরু করে জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের কয়েক জন ডাক্তার। ১৯৯৬ সালে কারখানাটি বন্ধ হয়। কিন্তু বন্ধ হয়নি হাসপাতাল। সাড়ে তিন দশক ধরে শ্রমজীবী হাসপাতাল চিকিৎসা করেছে তিরিশ লক্ষেরও বেশি গরিব মানুষের। স্থানীয়দের দাবি, ন্যূনতম খরচ এবং এক টাকাও লাভ না রেখে হাসপাতালটি চালানো হয়। ফলে বেশির ভাগ চিকিৎসাই সরকারি হাসপাতালের থেকেও কম খরচে হয়। সরকার বা কোনও সেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে আজ পর্যন্ত কোনও আর্থিক সাহায্য নেয়নি শ্রমজীবী। ঋণ নেয়নি ব্যাঙ্ক থেকেও। মানুষের শ্রম আর সাহায্য পুঁজি করেই গড়ে উঠেছে হাসপাতালটি। বেলুড় ছাড়াও সুন্দরবনের সরবেড়িয়া, হুগলির শ্রীরামপুরে কাজ করে চলেছে শ্রমজীবী। বীরভূমের কোপাইয়ে শুরু হয়েছে হাসপাতাল গড়ার কাজ।
তবে বেলুড়ে হাসপাতালটির জায়গার সমস্যা রয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, স্থানাভাবে বহু মানুষকে ফিরিয়ে দিতে হয় প্রতিদিনই। সবিতাদেবী, সরস্বতীদেবীরা এই হাসপাতালে যাতায়াত শুরু করেন ২০১০-এ। স্থানাভাবের সমস্যাটি তাঁদেরও নজরে আসে। পরে তিন বোন আলোচনা করে শ্রমজীবীকেই জমি-বাড়ি দান করার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানিয়েছেন মিশ্র-কন্যারা।
মিশ্র বাড়িতে এখন প্রতি রবিবার শ্রমজীবী হাসপাতালের বহির্বিভাগ চালানো হয়। দিদিদের পাশাপাশি তাঁদের ভাই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শিবকুমার মিশ্রও হাসপাতালের কাজে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন। রবিবার বহির্বিভাগে রোগী সামলান তিনি।
বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের প্রধান কারিগর ফণীগোপাল ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বহির্বিভাগ ছাড়াও এখানে আমারা ‘শ্রমজীবী পাঠশালা’ নামে একটি জনশিক্ষা কেন্দ্র বা কমিউনিটি কলেজ শুরু করতে চলেছি। সেখানে নার্সিং ট্রেনিং, ডক্টরস অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ এবং কয়েকটি প্যারা-মেডিক্যাল কোর্সের পঠনপাঠন হবে। কোর্সগুলির স্বীকৃতি দিতে প্রাথমিক ভাবে রাজি হয়েছে কলকাতারই একটি বিশ্ববিদ্যালয়। সব ক’টি শিক্ষাক্রমই আবাসিক এবং অবৈতনিক। প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রশিক্ষণগুলি পাবে।’’ এ ছাড়াও ওই জমিতে একটি বৃদ্ধাবাস গড়ে তোলার ভাবনা
রয়েছে বলে জানান তিনি। আগামী ১৩ অগস্ট এই জমিতে সমাজের সব স্তরের মানুষ ‘শ্রমজীবী পাঠশালা’র ভিত খোঁড়ার কাজে যোগ দেবেন। তিন কন্যা-সহ সাধারণ মানুষই হবে ভিত্তি-প্রস্তর স্থাপক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy