Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সেই ঝর্ণার হুমকি-মারে আত্মঘাতী যুবক

ক’মাস আগেই লোকসভা ভোটের সময় তাঁকে দেখা গিয়েছিল বুথের ভিতরে ঢুকে ভোটারদের উপরে প্রভাব খাটাচ্ছেন। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল সেই ছবি। রাতারাতি শিরোনামে এসে গিয়েছিলেন আরামবাগের তিরোল গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্যা ঝর্ণা সিংহ।

কার্তিক বাগ

কার্তিক বাগ

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ও মোহন দাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৪:০১
Share: Save:

ক’মাস আগেই লোকসভা ভোটের সময় তাঁকে দেখা গিয়েছিল বুথের ভিতরে ঢুকে ভোটারদের উপরে প্রভাব খাটাচ্ছেন। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল সেই ছবি। রাতারাতি শিরোনামে এসে গিয়েছিলেন আরামবাগের তিরোল গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্যা ঝর্ণা সিংহ।

রবিবার সেই ঝর্ণা আবারও শিরোনামে। এ বার জমি নিয়ে মা-ছেলের বিবাদে মায়ের পক্ষ নিয়ে ছেলেকে হুমকি, মারধর এবং আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ উঠল তাঁর বিরুদ্ধে। ঝর্ণার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নামলেন কয়েক হাজার গ্রামবাসী। পরিস্থিতি সামলাতে নামল পুলিশ, র্যাফ। মৃত যুবক কার্তিক বাগের দেহ উদ্ধার করে সৎকার করতে রাত গড়িয়ে গেল।

এক কালে লাল দুর্গ বলে পরিচিত আরামবাগে প্রতি পদে সিপিএমের নাক গলানো, মাতব্বরি এবং শাসানিতে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন সাধারণ মানুষ। পুঞ্জীভূত সেই ক্ষোভের জেরেই পরিবর্তনের জোয়ারে কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যান বামপন্থীরা। এ বার কিন্তু সেই একই মাতব্বরি-হুমকির অভিযোগ ফিরে আসছে তৃণমূলের দিকে। যে ঝর্ণা নিজে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন তিরোলে, রবিবার সেই ঝর্ণার বিরুদ্ধেই গ্রামবাসীরা স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন। মৃত কার্তিক বাগের দেহ ঝর্ণার বাড়ির বারান্দায় ফেলে রেখে স্লোগান তুললেন, ‘ঝর্ণাকে এসেই দেহ সৎকার করতে হবে। তাঁর জন্যই কার্তিক আত্মহত্যা করেছেন। ঝর্ণাকেই দিতে হবে ক্ষতিপূরণ।’

লোকসভা নির্বাচনের সময় ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগে গ্রেফতার হলেও জামিনযোগ্য ধারা দেওয়ায় ঝর্ণাকে হাজতবাস করতে হয়নি। কেন তাঁকে জামিনযোগ্য ধারা দেওয়া হল, তা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। এ বার কিন্তু অভিযোগ আরও গুরুতর। বেগতিক বুঝে তাই এ দিন সকাল থেকেই সপরিবার গা ঢাকা দিয়েছেন ডাকাবুকো ওই নেত্রী।

গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের আঁচ পেয়ে অবশ্য কিছুটা নড়াচড়া শুরু হয়েছে তৃণমূলের শীর্ষ মহলে। দলের হুগলি জেলা নেতৃত্বের কাছে রিপোর্ট চেয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “দলের হুগলি জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্তকে বলেছি, কী ঘটেছে খোঁজ নিয়ে জানাতে। রিপোর্টের ভিত্তিতে দলের তরফে কিছু করণীয় থাকলে করা হবে।” আরামবাগ কেন্দ্রের তৃণমূল সাংসদ অপরূপা পোদ্দার বলেন, “ওই পরিবারের প্রতি যদি কোনও অন্যায় হয়ে থাকে, তা হলে বিষয়টি নিশ্চয়ই দেখব। ঝর্ণার ভূমিকা দলীয় স্তরে খতিয়ে দেখছি।”

এ দিন ঠিক কী ঘটেছিল গ্রামে?

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর পঁচিশ আগে কার্তিকের বাবা মারা যান। সেই সময় আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় তিনি তাঁর চার বিঘা জমি বন্ধক দিয়েছিলেন। তার পরে দিনমজুরি করে কার্তিক ধীরে ধীরে ওই জমি ছাড়িয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। বছর খানেক ধরে ওই সম্পত্তির পুরোটাই কার্তিকের মা ষষ্ঠীদেবী নিজের নামে লিখিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে অভিযোগ। কিন্তু কার্তিক দিতে রাজি হননি। সম্প্রতি ষষ্ঠীদেবী ঝর্ণার শরণাপন্ন হন। তার পর থেকেই ঝর্ণাদেবী এবং তাঁর স্বামী রঞ্জিত ক্রমান্বয়ে কার্তিককে হুমকি দিতে থাকেন বলে অভিযোগ।

পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয় শুক্রবার। অভিযোগ, সে দিন বিকেলে ঝর্ণাদেবী, তাঁর স্বামী ও কয়েক জন অনুগামীকে নিয়ে বছর তিরিশের কার্তিকের বাড়িতে চড়াও হন। সেই সময়ে কার্তিকের স্ত্রী ঝুমা বাড়িতে ছিলেন না। কার্তিককে বেধড়ক মারধর করা হয় এবং একটি স্ট্যাম্প-পেপারে তাঁকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়ার চেষ্টারও অভিযোগ ওঠে ঝর্ণাদের বিরুদ্ধে। সই না করে কোনও এক ফাঁকে কার্তিক নিজের ঘরে ঢুকে পড়েন। বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন ঝর্ণারা। কিছু ক্ষণ পরে কার্তিক বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘ভয়ে আমি বিষ খেয়েছি। আমাকে বাঁচাও।’ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ভ্যানেও উঠে পড়েন তিনি।

বেশ কয়েক জন গ্রামবাসী জানিয়েছেন, কার্তিককে ভ্যানে উঠতে দেখে সেখানেও ধেয়ে যান ঝর্ণারা। ভ্যান থেকে টেনে নামিয়ে কার্তিককে ফের একপ্রস্ত মারধর করা হয়। ঝর্ণারা বলতে থাকেন, ‘তুমি কীটনাশক খাওয়ার নাম করে অভিনয় করছ। মরে যাও আর যাই করো, আগে সই করো’। এর মধ্যে অবশ্য গ্রামবাসীরা জড়ো হয়ে যান। তখন সেখান থেকে সরে যান ঝর্ণারা। প্রথমে কার্তিককে আরামবাগ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শনিবার তাঁকে স্থানান্তরিত করানো হয় স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে। রাতেই তিনি মারা যান।

ঝর্ণা সিংহের বাড়িতে কার্তিকের দেহ রেখে বিক্ষোভ গ্রামবাসীদের। নিজস্ব চিত্র

রবিবার সকালেই ঝর্ণাদেবী, তাঁর স্বামী এবং নিজের শাশুড়ি-সহ আট জনের বিরুদ্ধে স্বামীকে মারধর এবং আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করেন কার্তিকের স্ত্রী। মৃত্যুর খবর গ্রামে চাউর হতেই কয়েক হাজার গ্রামবাসী পথে নামেন। ময়না-তদন্তের পরে দেহ গ্রামে যেতে গ্রামবাসীরা তা ঝর্ণাদেবীর বাড়ির বারান্দায় নিয়ে গিয়ে রাখেন। শুরু হয় বিক্ষোভ। দেহ উদ্ধার করতে বিশাল পুলিশ বাহিনী ও র্যাফ যায়। কিন্তু কয়েক হাজার গ্রামবাসীর সামনে তাঁরা আর দেহ উদ্ধার করতে এগোননি। গ্রামবাসীরা ঘটনাস্থলে ঝর্ণাদেবীকে নিয়ে আসার দাবি তোলেন।

গ্রামবাসীদের বোঝাতে গ্রামে যান ওই পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান কাজি নিজামুদ্দিন এবং ওই দলের অঞ্চল সভাপতি লক্ষ্মী মণ্ডল-সহ স্থানীয় নেতারা। তাঁদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়েন গ্রামবাসীরা। পুলিশ কোনও রকমে নেতাদের উদ্ধার করে। সেই সময়ে পুলিশের সামনেই নেতারা গ্রামবাসীদের হুমকি দিতে থাকেন, “তোরা এ বার যা পারিস কর। আমরাও যা করার করে নেব।” এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পরে অবশ্য তৃণমূল নেতারা হুমকি দেওয়ার কথা মানেননি। রাত সাতটা নাগাদ আরামবাগ থানার আইসি অলোকরঞ্জন মুন্সি এবং ব্লক তৃণমূল সভাপতি স্বপন নন্দী ঘটনাস্থলে যান। কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে গ্রামের একটি আটচালায় দাঁড়িয়ে আইসি আশ্বাস দেন, অভিযুক্ত আট জনকেই গ্রেফতার করা হবে। মৃতের পরিবারের লোক এবং গ্রামবাসীদের নিয়ে পাঁচ জনের একটি দল গড়ার পরামর্শ দেন তিনি। তাঁর আশ্বাস, “দল গড়ে আমার কাছে আসবেন। থানাতে মৃতের শিশুপুত্রের নামে সম্পত্তি লিখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।”

আইসি-র আশ্বাসের পরে বিক্ষোভ থামে। পুলিশ দেহ সৎকারের ব্যবস্থা করে। স্বপনবাবু মৃতের স্ত্রীকে তাঁর বাপের বাড়ির এলাকায় ইন্দিরা আবাস যোজনায় বাড়ি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। মৃতের স্ত্রী বলেন, “কয়েক দিন ধরে যে ভাবে ঝর্ণাদিরা হুমকি দিচ্ছিলেন, স্বামী ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। শাশুড়িমাকে জমি দিলে উনি পুরোটাই বেচে দিতেন। তাই স্বামী দিতে চাননি। কিন্তু শাশুড়িমা টাকার লোভ দেখিয়ে ঝর্ণাদির কাছে যান। ঝর্ণাদির জন্যই স্বামীর মৃত্যু হল।”

কিন্তু গত বছরই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা ঝর্ণার বিরুদ্ধে বছর ঘুরতেই কেন এত ক্ষোভ গ্রামবাসীর? তাঁদের অভিযোগ, গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে এবং পরে লোকসভা ভোটে বিপুল জয়ের পরে ঝর্ণাদেবীর মাতব্বরি লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছে।

এক গ্রামবাসী বলেন, “ঝর্ণার অত্যাচার সহ্য করা যাচ্ছে না। গ্রামের যে কোনও ব্যাপারে উনি মাথা গলান। তাঁর মতে না চললেই হুমকি, কটূক্তি শুনতে হয়।” আর এক গ্রামবাসীর কথায়, “দু’মাস আগেও ঝর্ণাদেবী আর এক পরিবারের বাবা-ছেলের মধ্যে জমি নিয়ে বিবাদে সালিশি করেছিলেন। সেখানেও বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন।” আর এক গ্রামবাসী বলেন, “খেলার মাঠ ব্যবহার করতে গেলেও ঝর্ণাদেবীর স্বামীর ওজর-আপত্তি শুনতে হয়।”

আরামবাগের এই ঘটনায় বিরোধীরা অবশ্য তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বকেই কাঠগড়ায় তুলছেন। সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, “দীপালি সাহা, ঊষারানি মণ্ডল বা ঝর্ণা সিংহের মতো যাঁরা ভোটের সময় অন্যায় করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তৃণমূল কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। হুগলি জেলাতেই এক কর্মী খুনের পরে অভিযুক্ত বিধায়কের (অসীমা পাত্র) উপরে আস্থা রেখেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। নেতৃত্বের প্রশ্রয় পেলে ঘটনা তো ঘটবেই।” দলের জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, ঘটনার প্রতিবাদে আজ, সোমবার তাঁরা আরামবাগ থানায় স্মারকলিপি দেবেন। তিনি বলেন, “বিভিন্ন সালিশি সভায় উনি (ঝর্ণা) মাতব্বরি করেন। সালিশি করতে গিয়েই এমন ঘটনা ঘটল।” বিজেপির জেলা সভাপতি স্বপন পাল বলেন, “আরামবাগে আইনের শাসন নেই। এই ঘটনায় সেটাই প্রমাণ হল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE