Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
অশনি সঙ্কেত /১

হাড়-হাভাতেদেরও বাদ দেন না নেতারা

মাটির দেওয়াল, খড়-খাপরার চালা— ইন্দিরা আবাসের টাকাটা মঞ্জুর হওয়ায়, বাপ-ঠাকুর্দার ভিটের ভোল বদলানোর একটা সুযোগ পেয়েছিলেন খিরো সর্দার। বাধ সেধেছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা। তাঁর বাঁধা ‘রেট’ পাঁচ হাজার টাকা। সেটা হাতে না-পেলে পাকা ঘর তোলা যাবে না।

রাহুল রায়
বারিকুল শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩১
Share: Save:

মাটির দেওয়াল, খড়-খাপরার চালা— ইন্দিরা আবাসের টাকাটা মঞ্জুর হওয়ায়, বাপ-ঠাকুর্দার ভিটের ভোল বদলানোর একটা সুযোগ পেয়েছিলেন খিরো সর্দার। বাধ সেধেছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা।

তাঁর বাঁধা ‘রেট’ পাঁচ হাজার টাকা। সেটা হাতে না-পেলে পাকা ঘর তোলা যাবে না।

বাঁকুড়ার জাঁতাডুমুরের খিরোর চোয়াল শক্ত, চোখে শূন্য দৃষ্টি। বলছেন, ‘‘ঘরটা আর হল না বাবু।

পাঁচ হাজার টাকা কি মুখের কথা? কোথায় পাব!’’

‘রেট’-এর কিঞ্চিৎ হেরফের আছে। তবে জঙ্গলমহলের আদিবাসী মহল্লায় পা রাখলেই শোনা যাচ্ছে শাসক দলের মেজ-সেজ নেতাদের এমন আবদারের কথা। অঙ্গনওয়াড়ি সহায়িকার কাজে যোগ দেওয়ায় তৃণমূলের পার্টি ফান্ডে ‘বাধ্যতামূলক’ দিতে হবে ১২০০ টাকা চাঁদা। কোথাও বা মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের প্রৌঢ় শিক্ষককেই দায় নিতে হচ্ছে দলীয় অনুষ্ঠানের নিমকি-সন্দেশের। ছাড় মিলছে না মাঝগেড়িয়া এলাকার বিপিএল তালিকায় থাকা ন্যুব্জ বৃদ্ধ সনঝো মুন্ডারও। গ্রামের তৃণমূল নেতার বাড়িতে ‘কুটুম’ আসায় সাধের মোরগটিকে ভেট দিয়ে আসতে হয়েছে তাঁকে। পুষ্যিটি নেতার পায়ে নামিয়ে এসে সনঝো এখন বলছেন, ‘‘ইয়ারা বড় ভয়ঙ্কর বাবু, ছাগ-মোরগও ছিনায়ে লয়!’’

শাসক দলের নেতা-কর্মীদের এই ‘ভয়ঙ্কর’ জুলুমবাজির চেহারাটাই আদিবাসী সমাজ থেকে তাঁদের ক্রমশ দূরে ঠেলে দিচ্ছে। সম্প্রতি নবান্নে পাঠানো কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও বলা হয়েছে— সরকারি প্রচারে ‘জঙ্গলমহল হাসলেও’ গত কয়েক বছরে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের আদিবাসী সমাজের একটা বড় অংশ শাসক দলের থেকে মুখ ফিরিয়েছে। যার বড় কারণ,

শাসক দলের নেতাদের জুলুমবাজি। সঙ্গে দোসর— দলীয় কোন্দল। পূর্ণাপানি গ্রামে পাথুরে রাস্তার পাশে ছাগল চরানোর ফাঁকে অমর কিস্কু ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘শেষ দশ

বছরে সিপিএমকে পাশে পায়নি জঙ্গলমহল। তবে সে দলের নেতারা আমাদের কাছে অন্তত জুলুম করত না। কিন্তু তৃণমূলের নেতারা তো দেখছি আমাদের মতো হাড়-হাভাতেদেরও চুষে খেতে ছাড়ে না।’’

গোয়েন্দাদের অনুমান, শাসক দলের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভটাকেই কাজে লাগাতে চাইছে মাওবাদীদের ‘প্রোপাগান্ডা স্কোয়াড’। দিল্লির রিপোর্ট খুঁটিয়ে ধরিয়ে দিচ্ছে— আদিবাসী সমাজ এবং জনজীবনের ‘অনুভূতিতে’ অজান্তেই ‘আঘাত’ করে বসেছে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন। রাজ্যের শাসক দলের বেশ কিছু ‘নেতা-মন্ত্রী’ আদিবাসী সমাজের সম্মাননীয় কয়েক জন ব্যক্তিত্ব (রিপোর্টে যার উল্লেখ ‘আইকন ফিগার’) সম্পর্কে সম্প্রতি এমন কিছু ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ মন্তব্য করেছেন, আদিবাসী সম্প্রদায় যাকে ‘অসম্মান’ বলে মনে করছেন। ‘প্রোপাগান্ডা স্কোয়াড’-এর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে সেটাও।

বারিকুল ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রামের এক আদিবাসী স্কুল শিক্ষক বলছেন, ‘‘বড় ভুল হয়ে গেছে জানেন।’’

কেন? পড়াশিয়া গ্রামের মাঝবয়সী ওই শিক্ষক বলছেন, ‘‘গত এক দশকে বামেদের কাছে আমরা কিছুই পাইনি। ঝাড়খণ্ড পার্টি ভেঙে টুকরো হয়ে গিয়েছিল। মাওবাদীদের সম্মতি পেয়ে আমরা বেছে নিয়েছিলাম তৃণমূলকে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বুঝেছি— মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছে!’’

ভুলটা শুরু হয়েছিল সরকারি তরফেই। বছর চারেক আগে কলকাতার সিধো-কানহো ডহরে সাঁওতাল বিদ্রোহের শহিদ স্মরণের অনুষ্ঠানে সিধো ও কানহো মুর্মুর উত্তরসূরিদের সংবর্ধনা দেওয়ার সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোঁজ করেছিলেন, ‘ডহরবাবু’র পরিবারের কেউ আছেন কি না। সাঁওতালি ভাষায় ডহর শব্দের অর্থ পথ— মুখ্যমন্ত্রী যাকে ভেবে বসেছিলেন সাঁওতাল বিদ্রোহের কোনও শহিদের নাম। এ বছর হুল দিবসে তিনিই আবার ‘সাঁওতাল বিদ্রোহের অমর শহিদ সিধো-কানহো-বিরসা’র প্রতি শ্রদ্ধা জানান। সরকারি বিজ্ঞাপন বিরসাকে সাঁওতাল বিদ্রোহের ‘অমর শহিদ’ বলে চিনিয়ে দিলেও ইতিহাস অন্য কথা বলছে। প্রথমত, বিরসা সাঁওতাল নন, মুন্ডা। ফলে সাঁওতাল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দ্বিতীয়ত, সাঁওতাল বিদ্রোহ আর মুন্ডা বিদ্রোহের সময়কালও এক নয়। ফলে হুল দিবসে বিরসা-স্মরণ যুক্তিহীন।

আদিবাসীদের পুরনো সংগঠন ভারত-মাঝি পরগনা মহলের পক্ষে সনগিরি হেমব্রম বলছেন, ‘‘দুঃখটা এখানেই। সরকার আমাদের সমাজ জীবন কিংবা তার প্রাণ পুরুষদের নাম, সময়কাল সম্পর্কে কিছুই জানে না। অবলীলায় তাঁদের সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়েও কোনও অনুতাপ নেই তাঁদের।’’ বাঁকুড়ার এই আদিবাসী শিক্ষক নেতার অভিযোগ, ধামসা-মাদল বাজানো ছাড়া আদিবাসীদের আর কোনও ‘যোগ্যতা’র স্বীকৃতি সরকার দেয় না। আদিবাসীদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর এই মনোভাব যে মাওবাদীদের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে— সে ব্যাপারে সতর্ক করে দিচ্ছেন তিনিও।

আদিবাসীদের সংগঠন ‘আসেকা’র সম্পাদক দুখুরাম হাঁসদা ধরিয়ে দিচ্ছেন সরকারের ‘ফাঁকা আশ্বাসের’ কথা। প্রবীণ এই আদিবাসী নেতার দাবি, ‘‘পালাবদলের পরে সাঁওতালি মাধ্যমের স্কুলে জঙ্গলমহলের ছেলেমেয়েরা শিক্ষকতার সুযোগ পাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। আশ্বাস ছিল হোমগার্ড পদে নিয়োগের। খোঁজ নিয়ে দেখুন, শিক্ষক ও পুলিশের চাকরিতে যাঁদের নিয়োগ করা হয়েছে তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই অনাদিবাসী।’’ জঙ্গলমহলের ‘আদিবাসী শিক্ষার অধিকার মঞ্চ’-এর সভাপতি গোরাচাঁদ মুর্মু বলছেন, ‘‘যাঁরা অলচিকি হরফই চেনেন না তাঁরা কী করে সাঁওতালি মাধ্যম স্কুলে পড়াবেন? আমাদের প্রস্তাব ছিল, শিক্ষিত আদিবাসী যুবকেরা ওই সব স্কুলে স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেবেন। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে এগারো বার গিয়েছি, তিনি দেখাটুকুও দেননি!’’

বাঁকুড়ার সভাধিপতি তৃণমূলের অরূপ চক্রবর্তী ‘বিরোধীদের রটনা’ ছাড়া আর কিছুই দেখছেন না। গলা চড়িয়ে তাঁর দাবি, ‘‘আদিবাসী দিবসে আশি হাজার মানুষ এসেছিলেন। ধামসা-মাদল বাজিয়ে দিব্যি নাচ-গান করলেন। কীসের ক্ষোভ?’’

সুদূর ধানঝাড় গ্রাম থেকে একটি ভ্যানে গাদাগাদি করে যে ৪২ জন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন, হপন মাঝি তাঁদেরই এক জন। বলছেন, ‘‘সরকার বাহাদুর ডাকলেই আমাদের গরু-ছাগলের মতো ট্রাকে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। নাচ-গান করে বাবুদের আমোদ দিয়ে আমাদের কী জোটে? বোঁদে-মুড়ি আর একশোটা টাকা!’’

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE