বৃহস্পতিবার বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
ভোট শেষ। তবু জোট নিয়েই সরগরম বিধানসভা!
রাজ্যপালের ভাষণের উপরে বিতর্কের মাঝে বাম ও কংগ্রেসের জোটকে কটাক্ষ করে দু’দিন ধরে আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছেন তৃণমূল বিধায়কেরা। বিতর্কের শেষ দিনে জোটের প্রশ্নেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাল্টা আক্রমণে গেলেন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান। জানিয়ে দিলেন, প্রকাশ্যেই তাঁরা জোট করেছেন এবং সেই জোট থাকবে। জোট নিয়ে তরজার চোটে শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে ধুন্ধুমারও বাধল অধিবেশন কক্ষে!
মুখ্যমন্ত্রী মমতা অবশ্য নিজে এ বার ছিলেন অনেক সংযত। তাঁর দলের গোঘাটের বিধায়ক মানস মজুমদার মারমুখী হয়ে সভার ওয়েলে নেমে গিয়েছেন ঠিকই। শাসক বেঞ্চ থেকে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বা বিরোধী আসন থেকে মনোজ চক্রবর্তীরা নেমে এসে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় আবার মান্নানকে ভর্ৎসনা করেছেন রাস্তার কথা বিধানসভায় টেনে আনার জন্য। কিন্তু স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী জোটকে আক্রমণ করেছেন লক্ষ্ণণরেখা মেনে। কংগ্রেসের দলের বোর্ড সিপিএমকে দিয়ে দিতে বলেছেন। অতীতে নিজের বিজেপি-সঙ্গের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে সবই গণ্ডি মেনে! বিরোধীদের উদ্দেশে বৃহস্পতিবার তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘সমালোচনা করলেও সৌজন্য বজায় রাখা উচিত। আমার সমালোচনা করন। কিন্তু রাজ্যের স্বার্থে তা যেন গঠনমূলক হয়।’’
বাংলায় জোটের সিদ্ধান্ত পার্টি লাইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি বলে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি বিবৃতি দেওয়ার পরেই জোটে ফাটল ধরানোর চেষ্টায় নেমেছে শাসক দল। গত দু’দিনে তৃণমূলের উদয়ন গুহ, তাপস রায় প্রমুখ ‘বামেদের হাতে ৩৫ হাজার কংগ্রেস কর্মী খুন’, সিপিএমের মতাদর্শ ভোগে’ এ সব কথার পাশাপাশি কীসের লোভে দু’দল ‘শয্যা-সঙ্গী’ হল, সে প্রশ্নও তুলেছিলেন! এমতাবস্থায় জোটের অন্যতম কারিগর মান্নানের পাল্টা আক্রমণে যাওয়া ছাড়া দ্বিতীয় রাস্তা খোলাও ছিল না। রাজ্যপালের ভাষণ-বির্তকে অংশ নিয়ে এ দিন সেই সুযোগই নেন বিরোধী দলনেতা। অতীতে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কখনও কংগ্রেস, কখনও বিজেপির সঙ্গে জোট করে ভোটে লড়েছে। সেই দৃষ্টান্ত টেনে এবং তিনিও এক সময়ে মমতার নেতৃত্বের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তা জানিয়ে মান্নান বলেন, ‘‘আপনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী! আপনি কখনও বিজেপি, কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করলেও আপনার আদর্শ বজায় থাকে! আর আমরা করলে ঘৃণিত? আমরা প্রকাশ্যে জোট করেছি! জোট থাকবে।’’
মমতা ক্ষমতায় আসার পরে কেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পুত্র চন্দন বসুর সম্পত্তি নিয়ে কোনও তদন্ত করলেন না, কেন রাজ্যে দুর্নীতি বন্ধ হল না, সে প্রশ্নও তোলেন মান্নান। এই পরিপ্রেক্ষিতে কোটি টাকায় মমতার ছবি বিক্রি হলেও এখন কেন তিনি আঁকছেন না, কেন তিন আঁচড়ে ১০ লক্ষ টাকা উঠছে না— মুখ্যমন্ত্রীকেই সরাসরি প্রশ্ন করেন মান্নান। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে তৃণমূল বিধায়ক ও মন্ত্রীরা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকেন। তাঁদের দাবি, মান্নানকে ক্ষমা চাইতে হবে। উত্তেজিত হয়ে গোঘাটের তৃণমূল বিধায়ক মানসবাবু মান্নানের দিকে তেড়ে গেলে তাঁকে আটকান তৃণমূল ও কংগ্রেস বিধায়কেরা। পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীও বিরোধীদের প্রতি কটূক্তি করে এগিয়ে যান। মন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই তাঁকে বিরোধীদের প্রতি এমন আগ্রাসী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে!
এই পরিস্থিতিতে সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী এবং অশোক ভট্টাচার্য কিছু বলতে চাইলে স্পিকার তাঁদের থামিয়ে দেন। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ফের বলতে ওঠেন মান্নান। এ বার তিনি মন্তব্য করেন, ‘‘আমি তো বলিনি, কালীঘাটের ময়না, সত্য কথা কয় না! যেমন এক জন বলেছিলেন। যিনি এখন মন্ত্রী!’’ তাঁর এই মন্তব্যে আবার উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরে মান্নান বিধানসভা শিক্ষা কমিটির একটি রিপোর্ট দেখিয়ে শিক্ষার দুরবস্থার কথাও তোলেন।
পরে জবাব দিতে গিয়ে মমতা যুক্তি দেন, রাজ্যে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বার্থে তিনি কখনও কংগ্রেস, কখনও এনডিএ-র সঙ্গে জোট করেছেন। তাঁর দাবি, তিনি কখনও বিজেপির সঙ্গে জোট করেননি। সাধারণ কর্মসূচির ভিত্তিতে এনডিএ-র শরিক হয়েছিলেন। মমতার কথায়, ‘‘অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রতি শ্রদ্ধা ছিল। তাঁর নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র সঙ্গে জোট করেছিলাম। সিপিএমের সঙ্গে আমার আদর্শগত লড়াই আছে। তা চলবে।’’ জ্যোতিবাবুও যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বাজপেয়ীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে শহিদ মিনার ময়দানে সভা করেছিলেন, মান্নান-সুজনকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মমতা বলেন, ‘‘সিপিএম বাংলায় কংগ্রেসের এত লোক খুন করেছে! তাদের কাছে কংগ্রেসকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।’’ তবে বামেদের মধ্যেও ভাল লোক আছে, জানিয়ে মমতার বক্তব্য, ‘‘পূর্ণেন্দু বসু, রেজ্জাক মোল্লাদের সঙ্গে কাজ করতে আমাদের অসুবিধা নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy