মোদীর সঙ্গে দেখা করে রাজভবন থেকে বেরিয়ে আসছেন বাবুল সুপ্রিয়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
পঁচিশে বৈশাখের শহর দেখল, সতর্ক পুলিশ দেখল, ছুটি কাটাতে আসা বাঙালি দেখল, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে পসরা সাজিয়ে বসা ভেলপুরি-এগরোল বিক্রেতারাও দেখলেন।
এবং বিলক্ষণ চমকালেন!
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তো! আর তাঁরই সঙ্গে তাঁরই গাড়ির পিছনের সিট থেকে নেমে আসছেন ‘কহো না প্যার হ্যায়’ খ্যাত গায়ক, বর্তমানে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়!
খোশমেজাজে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন দু’জনে ওই খাবারের স্টলগুলোর দিকেই। কেনা হল ভেলপুরি, রোল। আড্ডার সঙ্গে মুখও চলছে।
যাঁরা শুধু দেখলেন, তাঁরা শুধুই চমকালেন। আর যাঁরা এই দুই চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের উত্থান-পতনের সাম্প্রতিক ইতিহাসটা জানেন, তাঁরা সম্ভবত দ্বিগুণ চমকালেন!
কারণ, গত এক বছর ধরে এই দু’জন পরস্পরকে কী তোপটাই না দাগছেন! এই সে দিনও নাম না করে বাবুলের সঙ্গে ‘রোজ ভ্যালি’র যোগাযোগ খুঁচিয়ে তুলেছিলেন মমতা। বাবুল উল্টে মমতাকে মোক্ষম ‘সারদা-খোঁচা’ দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ছবি বিক্রি নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন।’’ কখনও মমতা, কখনও তাঁর দলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিষয়ে চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন বাবুল। উল্টো দিকে, রাজ্যের মন্ত্রী-অফিসারদের জন্য একটা সময়ে রীতিমতো ফরমান জারি হয়েছিল— ‘বাবুলের সঙ্গে বৈঠক নৈব নৈব চ!’ কেন? রাজ্য নাকি ‘হাফ-মন্ত্রী’র সঙ্গে মিটিংয়ে আগ্রহী নয়! এমনকী লোকসভা ভোটে বাবুলের প্রার্থী হওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন মমতা।
সেটা ছিল ২০১৪-র মার্চ। তার পাশে রাখা যাক এ দিনের শনিবাসরীয় সন্ধ্যা।
নজরুল মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অনুষ্ঠান শেষে বেরোনোর সময়ে মমতা দেখেন, বাবুল বাইরে দাঁড়িয়ে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কী ব্যাপার? তুমি এখানে দাঁড়িয়ে?’’
বাবুল জানান, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার বেড়াজালে তাঁর গাড়ি কোথায় রয়েছে, বুঝতেই পারছেন না। মমতা বলেন, ‘‘রাজভবনে যাবে তো? আমার গাড়িতে উঠে এসো।’’
উঠে পড়েন বাবুল। গাড়ি রওনা হয় রাজভবনের উদ্দেশে। কিন্তু মোদীর তো রাজভবনে যাওয়ার আগে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রেসিডেন্ট-মহারাজ, অসুস্থ স্বামী আত্মস্থানন্দকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার কথা। এই বাড়তি সময়টুকুর অবসরেই ‘ভিক্টোরিয়া-হল্ট’!
কনভয় থামলে গাড়ি থেকে বাবুলকে নিয়ে নেমে পড়েন মমতা। সঙ্গে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা। পথের ধারে ভিআইপি-দের ভেলপুরি খাওয়ার দৃশ্য তখন অনেক উৎসাহীই দেখছেন উঁকিঝুঁকি মেরে! পরে বাবুল বললেন, ‘‘আসলে সবাই হয়তো ভাবছিল, এ আবার কী হচ্ছে?’’ পকেট থেকে মানিব্যাগটাও বের করে ফেলেছিলেন বাবুল। ‘দিদি’র ধমক খেয়ে আর ভেলপুরির দাম দেওয়া হয়নি। বাবুলের কথায়, ‘‘দিদি তো আমাকে পয়সাটাও দিতে দিলেন না।’’ আর মমতা বলছেন, ‘‘ও ওই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির জন্য। আমি দেখে পাশ দিয়ে চলে আসতে পারি? ভালই হল, এক সঙ্গে গল্প করতে করতে এলাম। ভিক্টোরিয়ায় দাঁড়িয়ে টুকটাক খেলাম।’’
আসলে খাওয়াদাওয়ার প্রসঙ্গটা গাড়িতে তুলেছিলেন বাবুলই। মন্ত্রীমশাই বলছেন, ‘‘দিদিকে বললাম, কলকাতা এলেই মাংসের চপটা না খেয়ে পারি না। (বলে রাখা যাক, বাবুলের মতো মুখ্যমন্ত্রীও চপ-ভক্ত।) দক্ষিণ কলকাতার চেনা চপের দোকানটা সচরাচর এড়িয়ে যেতে পারি না। শুনেই দিদি বললেন, চপ তো এখানে দেখছি না, ভেলপুরি চলবে?’’ এবং এর পরেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গাড়ি থেমে যায় ভিক্টোরিয়ার সামনে।
সব শুনে কেউ কেউ বলছেন, এ তো শুধু সৌজন্য নয়, দিদি-ভাইয়ের স্নেহের পরশ! এ কোথায় ছিল এত দিন! আর বাবুল বলছেন, ‘‘এর মধ্যে কোনও জটিল অঙ্ক খুঁজবেন না। আমি তো এখানকারই লোক। দিদি তো আমার অপরিচিত নন। আমিও দিদির কাছে নতুন কেউ নই।’’
গাড়িতে উঠে কথোপকথনটা নাকি শুরু করেছিলেন বাবুলই। চপ-ভেলপুরি পর্বের আগে, রাস্তায় ট্র্যাফিক কনস্টেবল দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আচ্ছা দিদি, এই যে রাস্তায় পুলিশরা ট্রাক থামিয়ে ঘুষ নেয়, আপনার চোখে পড়েছে কখনও?’’
শুনে হেসেই কুটোপুটি মমতা। বাবুল তখন জানান, উত্তরপাড়া থেকে বালি ব্রিজ পেরিয়ে কলকাতায় আসার সময়ে ঘুষ-নেওয়া পুলিশ ধরাটা একটা নেশার মতো ছিল তাঁর। সে কথাও বলা হল দিদিকে। শুনে আবার দিদির হাসি।
ভেলপুরি-ফুচকা-হাফ-রোলের আড্ডা সেরে গাড়ি পৌঁছল রাজভবনে। পিছনের দরজা খুলে নেমে বাবুল বললেন, ‘‘আসি দিদি, থ্যাঙ্ক ইউ।’’
উত্তর এল, ‘‘হ্যাঁ, আবার দেখা হবে।’’
মেলালেন। (হয়তো) মোদীই মেলালেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy