Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জমিই কাঁটা, শিল্পবান্ধব তালিকায় রাজ্য একাদশে

কথায় বলে একাদশে বৃহস্পতি। শিল্পবান্ধব রাজ্যগুলির যে তালিকা কেন্দ্রীয় সরকার, কয়েকটি বণিকসভা এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ক মিলে তৈরি করেছে, তা কিন্তু অন্য কথা বলছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

কথায় বলে একাদশে বৃহস্পতি। শিল্পবান্ধব রাজ্যগুলির যে তালিকা কেন্দ্রীয় সরকার, কয়েকটি বণিকসভা এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ক মিলে তৈরি করেছে, তা কিন্তু অন্য কথা বলছে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের জায়গা হয়েছে ১১ নম্বরে। আর সেটা থেকে পরিষ্কার, এই রাজ্যের প্রতি আপাতত বিনিয়োগ তথা বৃহস্পতির কৃপাদৃষ্টি যথেষ্টই কম।

কেন এই অবস্থা, তার পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, কারখানা তৈরির জন্য জমির ব্যবস্থা, আইনের প্রয়োগ, পরিকাঠামোগত সুবিধা, ছাড়পত্রের ব্যবস্থা, কর আদায়, শ্রম আইন— বিনিয়োগের দরজা খুলতে যে সব সংস্কার প্রয়োজন, তার কোনও মাপকাঠিতেই পশ্চিমবঙ্গ প্রথম পাঁচের মধ্যে নেই।

শিল্পায়নের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে কোন রাজ্য কী ধরনের সংস্কারের পদক্ষেপ করেছে, তা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রক, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, কেপিএমজি এবং বণিকসভা সিআইআই ও ফিকি। উদ্দেশ্য, ভারতে ব্যবসার পথ আরও সহজ করা। ‘অ্যাসেসমেন্ট অব স্টেট ইমপ্লিমেন্টেশন অব বিজনেস রিফর্মস’ শীর্ষক ওই রিপোর্টে ৩২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ‘র‌্যাঙ্কিং’-এ প্রথম নামটি প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য গুজরাতের। মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, রাজস্থান, অন্ধ্র বা কর্নাটকের সঙ্গেও যে পশ্চিমবঙ্গ এঁটে উঠতে পারবে না, তা-ও বলাই বাহুল্য। কিন্তু রিপোর্ট বলছে, প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশাও পিছনে ফেলে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গকে।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

অথচ, এই পরীক্ষার আগে ‘মক টেস্ট’ পর্যন্ত সেরে রেখেছিল রাজ্য প্রশাসন। গত জুন মাসে কলকাতার টাউন হলে রাজ্যের সব বণিকসভার সদস্য ও শিল্পপতিকে নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী জানান, ২০১১ সালে ১৭ নম্বরে ছিল রাজ্য। এই অবস্থা থেকে রাজ্যকে এগিয়ে আনতে কয়েকটি পদক্ষেপের কথাও বলেছিলেন। বৈঠকে হাজির বিভিন্ন দফতরের সচিবরা সহজে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে রাজ্যের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরেন। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রথম দশে ঢুকতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ। কেন?

উত্তর সেই জমি। কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে— তার বিচার করতে গিয়ে জমির বন্দোবস্তের বিষয়টিকেই সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। অথচ পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে গেলে জমি কোথায় মিলবে, তার স্পষ্ট কোনও উত্তর প্রশাসনের কেউ দিতে পারেন না। জমি অধিগ্রহণ করা হবে না— এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ঘোষিত নীতি। জমির ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত আইনটিও খারিজ করেনি সরকার। মমতা থেকে অমিত মিত্র, সকলেই মুখে বারবার বলেছেন, জমি কোনও সমস্যা হবে না। ‘কেস টু কেস’ দেখে সরকার ছাড়পত্র দেবে। একই সঙ্গে জমি ব্যাঙ্ক তৈরির দাবিও করেন প্রশাসনের শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু শিল্পমহলের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, শিল্পের জন্য জমি পাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন। মমতা ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজ্য সরকার ষোড়শোপচারে এবং বিভিন্ন নামে যে সব শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করেছে, তার প্রায় সব ক’টিতেই শিল্পমহলের মূল প্রশ্ন ছিল এই জমি নিয়েই।

আর এখানেই বাজি মেরে দিয়েছে গুজরাত। সেখানে শিল্পের জন্য কোথায় কতখানি জমি রয়েছে, তার ভৌগোলিক তথ্য অনলাইনেই পাওয়া যায়। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের ল্যান্ড ব্যাঙ্কের জমি কোথায় কতটা রয়েছে, তার কোনও নির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া হয় না।

রাজ্যগুলির মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আর একটি মাপকাঠি ছিল ব্যবসায়িক চুক্তির আইনি প্রয়োগ। সেখানেও যে প্রশাসনিক শিথিলতা রয়েছে, তা-ও মানছে শিল্পমহল। যার বড় উদাহরণ রবিবারের তারাতলার ঘটনা। ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের জবরদখল করা জমি উদ্ধার করতে পারেননি বন্দর কর্তৃপক্ষ। ভেঙ্কটেশের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতা শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিশেষ ঘনিষ্ঠ বলে পুলিশের সাহায্যও মেলেনি বলে অভিযোগ। একই ভাবে আইনের শাসনের অভাবেই যে এবিজি হলদিয়া তথা রাজ্য থেকে ব্যবসা গুটিয়েছে, তা-ও প্রতিষ্ঠিত সত্য। শাসক দলের মদতপুষ্ট সিন্ডিকেটের উৎপাতে রাজ্য জুড়ে নির্মাণ শিল্পের নাভিশ্বাস উঠেছে। সেখানেও আইনের শিথিলতা স্পষ্ট। শিল্পমহল বলছে, এমন চলতে থাকলে রাজ্যে ব্যবসা শুরুর আগে সব শিল্পপতিই দু’বার ভাববেন।

বিশ্ব ব্যাঙ্কের ভারতীয় প্রধান ওনো রুহলের যুক্তি, শিল্প বা ব্যবসার ক্ষেত্রে সংস্কারের সঙ্গে রাজনীতির বিরোধ নেই। তিনি বলেন, ‘‘শিল্প হলে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। মানুষের আয় বাড়বে। যে সরকার সেই ব্যবস্থা করবে, মানুষ তাকেই ভোট দেবে।’’ যে রাজ্য ভাল ফল করেছে, সেখানেই যে বিনিয়োগ যাবে, তা স্পষ্ট করে দিয়ে শিল্পপতি সুনীলকান্ত মুঞ্জল বলেন, ‘‘কেন্দ্রের থেকেও অধিকাংশ সংস্কার কিন্তু এখন রাজ্যের এক্তিয়ারে পড়ছে। কেউ ভারতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেও আসলে কিন্তু একটি বিশেষ রাজ্যে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’’ মুঞ্জলের কথা যে ভুল নয়, তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। লগ্নি টানার হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের ঠাঁই হয়েছে শেষ পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে।

আজ রিপোর্ট প্রকাশের পর কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব শত্রুঘ্ন সিংহ বলেন, মোট আটটি ক্ষেত্রে ৯৮টি মাপকাঠিতে কোন রাজ্য কোথায় এগিয়ে বা পিছিয়ে রয়েছে, তার বিচার হয়েছে রাজ্যগুলির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই। এই আটটি ক্ষেত্র হল— নতুন ব্যবসা শুরু, জমি বরাদ্দ ও নির্মাণের অনুমতি, শ্রম নীতি, পরিবেশ নীতি, পরিকাঠামো, কর আদায় এবং ব্যবসায়িক চুক্তির আইনি প্রয়োগ। ৩০ জুন পর্যন্ত রাজ্যগুলি কতখানি কাজ করেছে, তার শতকরা হারের ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছে মার্কশিট। প্রথম স্থানে থাকা গুজরাত পেয়েছে ৭১.১৪%। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্তি মোটে ৪৬.৯%।

আজকের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার আগেই পশ্চিমবঙ্গের অর্থ ও শিল্প দফতরের কর্তারা ঘরোয়া আলোচনায় বলেছিলেন, একমাত্র কর আদায়ের ক্ষেত্রে যে সংস্কারের কাজ হয়েছে, তাতেই পশ্চিমবঙ্গ ভাল ফল করতে পারে। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের বাণিজ্য কর দফতরের ভ্যাট, কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর, বিনোদন কর, প্রবেশ কর জমা বা রিটার্নের ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যবস্থাই একমাত্র সাধুবাদ কুড়িয়েছে। শিল্পের ছাড়পত্রের জন্য এক জানলা ব্যবস্থা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জল বা বিদ্যুতের সংযোগের মতো কিছু পদক্ষেপের উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গ প্রথম পাঁচটি সেরা রাজ্যের তালিকায় জায়গা পায়নি। বিশ্ব ব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ শিহাব আনসারি আজহার বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ অনেকগুলি ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। সেখানে ভাল করতে হবে। সামগ্রিক ভাবেই সংস্কারে গতি আনতে হবে।’’ শিল্পমহলের বক্তব্য, ছাড়পত্রের জন্য শুধু সময় বেঁধে দিলেই হবে না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছাড়পত্র না পেলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জবাবদিহির ব্যবস্থাও থাকা জরুরি। নীতি তৈরি করেই কাজ শেষ হয় না। তা কার্যকর করার সদিচ্ছা না থাকলে বিনিয়োগের পথে কাঁটা থেকেই যাবে। সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই মূল্যায়নকে ইতিবাচক ভাবে দেখা জরুরি। রাজ্যগুলি বুঝতে পারবে তারা কোথায় অন্যদের থেকে পিছিয়ে। সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করলে আগামী বছরের মূল্যায়নে ছবিটা পাল্টে যেতে পারে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE