Advertisement
E-Paper

কলকাতার সিনেমাওয়ালা

কত অপমান! কত অন্ধকার! দীর্ঘ দিন রোজগার না থাকা! কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের নিজের জীবনও কি সিনেমা? ইন্দ্রনীল রায় লিখছেনসামনে সাদা-কালো নকশা কাটা পার্কার পেনের ছিপিটা লাগিয়ে চুলে হাত বোলান তিনি। সন্ধে সাড়ে ছ’টা, সকাল থেকে স্নান হয়নি, গালে এক মুখ দাড়ি। অ্যাশট্রে ভর্তি সিগারেট।

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৬ ০১:০৪

সামনে সাদা-কালো নকশা কাটা পার্কার পেনের ছিপিটা লাগিয়ে চুলে হাত বোলান তিনি। সন্ধে সাড়ে ছ’টা, সকাল থেকে স্নান হয়নি, গালে এক মুখ দাড়ি। অ্যাশট্রে ভর্তি সিগারেট।

কখন এতটা অগোছালো থাকেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, তা বিলক্ষণ জানেন তাঁর ঘনিষ্ঠ মানুষজন।

এর মানে কোনও একটা গল্প তাঁর মাথায় এসেছে। তিনি তাঁর আউটলাইন লিখছেন আর পাগলের মতো এ ঘর ও ঘর পায়চারি করছেন।

‘‘গল্প মাথায় আসলেই আমার শরীর কেমন করে। গল্পের চরিত্ররা যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে আমার সামনে। দেখতে পাই তাদের। তারা যা যা করে আমি শুধু সেগুলো লিখে রাখি,’’ বলে ডাইনিং রুমের মার্বেল টেবিলের উপর হাত দু’টো নামিয়ে রাখেন কৌশিক।

আসলে গল্প আর কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে যেন এক আত্মিক যোগাযোগ আছে। কখনও তিনি ফলি আর্টিস্টের জীবনের গল্প বলেন (‘শব্দ’), কখনও ‘অপু’ চলে আসে তাঁর গল্পে (‘অপুর পাঁচালি’)।

সৃজিত মুখোপাধ্যায় তাঁকে ভালবেসে সম্বোধন করেন ‘প্রোফেসর’ বলে। শ্রীকান্ত মোহতা, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় থেকে মায়ামিবাসী পরিচালক সুমন ঘোয — টলিউডের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ মানুষজনই বিশ্বাস করেন ঋতুপর্ণ ঘোষের পর বাংলায় অন্য ঘরানার ছবির একমাত্র ধারক ও বাহক আজকে তিনি।

তাঁর ছেলে উজান গঙ্গোপাধ্যায় মাঝে মধ্যে বলেন, ‘‘ডিরেক্টর হতে চাই আমি। কিন্তু কী করে হব, বাবা তো সব গল্পই বলে দিচ্ছে।’ আর তাঁর স্ত্রী তাঁর তুলনা করেন নচিকেতার বিখ্যাত গান ‘পাগলা জগাই’‌য়ের সঙ্গে। ‘‘পাগলা জগাই শুনলেই আমার কেজি-র কথা মনে হয়। সাধারণ, দেখনদারি নেই, বিশেষ চাহিদা নেই, নিজের জগতে থাকে ও,’’ বলেন চূর্ণী।

এবং তাঁকে কাছ থেকে দেখে বুঝেছি, তাঁর দুর্বলতা দু’টি। তাঁর বাড়ি এবং তাঁর সিনেমা।

বাড়িতে ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার — মেনু ঠিক করেন তিনি। বোয়াল মাছ অন্য কেউ কিনলে বিরক্ত হন আর পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন সকাল ছ’টায় গড়িয়ার বাড়িতে ফোন করে ছেলে উজানকে ঘুম থেকে তুলে দেন।

এ ছাড়া রয়েছে তাঁর সিনেমাপ্রেম। তার মানেই যে সারাক্ষণ বাড়িতে গদার আর ফেলিনি দেখছেন, তা কিন্তু নয়। সঙ্গে অবিরত চলে ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে সস্তা গসিপ (যা শুনলেই ওই সংস্কৃতির বিরোধী চূর্ণী অসম্ভব রেগে যান)। চলে ইয়ার্কি, পিএনপিসি। চলে ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা নিয়ে মিটিং। যেন জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে একটাই সম্বল — সিনেমা। এ যেন আক্ষরিক অর্থেই এক ‘সিনেমাওয়ালা’র গল্প।

কলকাতার সিনেমাওয়ালা।

তাঁর পরবর্তী ছবি, ‘সিনেমাওয়ালা‌’ এই মুহূর্তে বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস নিয়ে। গত পাঁচ বছর গোটা পশ্চিমবঙ্গে ৩০০র বেশি সিঙ্গল-স্ক্রিন সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেকেরই আশঙ্কা এই হারে যদি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, তা হলে ইন্ডাস্ট্রিই হয়তো উঠে যাবে।

‘সিনেমাওয়ালা’ ছবিতে এরকমই একটা সিনেমা হলের মালিক পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। যুগের সঙ্গে চলতে না পারার জন্য যাঁর আজকের সঙ্গী মদ ও নিঃসঙ্গতা। ছবিতে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ছেলে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে দূরত্ব আর বিরোধ ঠিক ততটাই, যতটা তফাত সেলুলয়েডের সঙ্গে সস্তার পাইরেটেড ডিভিডি-র। এই নিয়ে ‘সিনেমাওয়ালা’।

তাঁর এই ভিন্নধর্মী মৌলিক গল্প বলার স্টাইলটাই আজকে তাঁকে বসিয়ে দিয়েছে টালিগঞ্জের প্রথম শ্রেণির পরিচালকের আসনে।

‘‘কী জানেন, কৌশিকদা লর্ডসের মোড়ে দাঁড়িয়ে এমন একটা গল্প বলতে পারে যা শুনে আপনি ছিটকে যাবেন। ওটা ওর বিরাট ক্ষমতা। আমার অসম্ভব প্রাউড লাগে এটা ভেবে যে আমি এমন একটা সময়ে সিনেমা বানাচ্ছি যখন কৌশিকদাও সিনেমা তৈরি করছে,’’ একদিন রাতে হোয়াটসঅ্যাপে বলছিলেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়।

কিন্তু এ তো ২০১৬র কথা। কোনও মতেই কিন্তু কৌশিকের জার্নিটা এতটা মসৃণ ছিল না। এক সময় পর পর ছবি ফ্লপ করার পর প্রায় কোনও কাজই ছিল না তাঁর। সেই সময় কুশল চক্রবর্তীর মায়ের রোলে ‘মাইন্ডলেস অভিনয়’ (তাঁর নিজের কথায়) করে দিনের পর দিন সংসার চালাতেন চূর্ণী।

এমন সময় তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন দুটি মানুষ। প্রথম জন অভিনেতা (তখনও পরিচালক হননি) অরিন্দম শীল, যিনি মুম্বইয়ের এক প্রযোজক সংস্থার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন কৌশিকের। অন্যজন পরিচালক মৈনাক ভৌমিক। যিনি রাতের পর সাহস জুগিয়েছিলেন কৌশিককে।

অবস্থা এতই অপমানজনক জায়গায় পৌঁছায় যে কমার্শিয়াল বাংলা ছবির এক চিত্রনাট্যকারকে তাঁর বাড়ি পাঠান এক প্রযোজক এটা বলে যে, সেই চিত্রনাট্যকার কৌশিকের গল্প ‘ওকে’ বললে তবেই তিনি কৌশিককে অফিসে ডাকবেন স্ক্রিপ্ট শুনতে।

এর মধ্যেই তীরে এসে তরী ডোবার মতন অবস্থা হয় ঋতুপর্ণ ঘোষ অভিনীত ‘আর একটি প্রেমের গল্প’য়ের শ্যুটিং এবং তার পরবর্তী সময়টায়। ছবি বার্লিন পৌঁছালেও কৌশিকের ভাগ্যে জোটে শুধুই অপমান। ছবির গল্প কৌশিকের হলেও দিনের পর দিন সেটে নিজের মতো করে নানা ডিমান্ড করতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। নিজের সেটে সবার সামনে প্রায় রোজই অপমানিত হতেন কৌশিক।

‘‘হ্যাঁ হয়েছিল এগুলো। রোজ বাড়ি এসে ভাবতাম কাল থেকে আর যাব না। আমাকে বোঝাত মৈনাক। কিন্তু আজকে আর আমি এ সব নিয়ে ভাবতে চাই না। আমি অনেক কিছু সহ্য করেছিলাম কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে কাজ করার পরেই আমার সিনেমার ঘরানা বদলে যায়। আমার কেরিয়ারে প্রি-ঋতুপর্ণ আর পোস্ট-ঋতুপর্ণের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত রয়েছে,’’ ঘরোয়া আলোচনায় প্রায়ই বলেন কৌশিক।

শুধু তাই নয়, ‘শব্দ’ জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে তিনি প্রণামও করে আসেন ঋতুপর্ণ ঘোষের ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়িতে।

‘‘ওটা ছিল আমার গুরুদক্ষিণা। আমার ওই আশ্রমটা ভাল লাগত না, কিন্তু ওই আশ্রম থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি,’’ একদিন নিজের বাড়িতে দিওয়ালির আলো লাগাতে লাগাতে বলছিলেন কৌশিক।

এর পর পরই শুরু হয় তাঁর সিনেমার হানিমুন পিরিয়ড। ‘শব্দ’, ‘C/O স্যার’, ‘অপুর পাঁচালি’, ‘খাদ’, ‘ছোটদের ছবি’, ‘বাস্তু-শাপ’ ঘুরে ‘সিনেমাওয়ালা’। ‘সিনেমাওয়ালা’ তো গোয়াতে ফেলিনি পুরস্কারও পায়।

‘‘হ্যাঁ, এই অ্যাওয়ার্ডটা ক্লিন্ট ইস্টউডও পেয়েছে। আবার আমিও পেয়েছি। এটা ভেবেই দারুণ লাগছে। কিন্তু আমাদের এখানে তো সব কিছুর মূল্যায়ন পরে হয়, তাই এটা নিয়ে হয়তো ২০ বছর পরে আরও বেশি লেখালিখি হবে,’’ তাঁর প্রিয় পারফিউম অ্যাজ়ারো লাগাতে লাগাতে বলছিলেন কৌশিক।

এটা আসলে তাঁর ব্যক্তিত্বের একটা দিক। তাঁর ঘনিষ্ঠ মানুষজন এটাকে বলেন, কৌশিকের মাথার ‘ব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়া’। খুব আনন্দের কোনও মুহূর্তেও জল ঢেলে দিয়ে তাঁর মাথায় এই ‘ব্যাসিলাস’‌য়ের আবির্ভাব হয়।

তাই জন্যই ‘সিনেমাওয়ালা’তে তাঁর প্রধান চরিত্র এক রাজনৈতিক দাদাকে অনায়াসে বলতে পারেন, ‘‘আপনারা পার্ক করলেন, রাস্তা করলেন, কিন্তু মানুষের মেরুদণ্ড কি তৈরি করতে পারলেন?’’

কে জানে, হয়তো এই ব্যাসিলাসের কারণেই লোকসভা ভোটের সময় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একই মঞ্চে সভা করলেও তার পর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন তিনি।

‘‘আমার এটা হয়। আমার বন্ধুরা বলে আমার মধ্যে একটা নকশাল রয়েছে। কোনও কিছু ভুল হচ্ছে দেখলে সেটা একটা স্টেজ অবধি মেনে নিই কিন্তু তারপর আর কনট্রোল করতে পারি না। এটা আমার নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষা। এটা কেন বলছি শুধু ওই স্কুলের ছাত্ররাই বুঝতে পারবে। কোথাও খুব অন্যায় অবিচার দেখলে গোলপার্কের স্বামী বিবেকানন্দর মূর্তিটা যেন হাত ভাঁজ করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেখান থেকেই ব্যাসিলাসের শুরু। তাই জন্যই হয়তো চূর্ণী আমাকে ‘পাগলা জগাই’ বলে,’’ একদিন রাতে নিজের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলছিলেন কৌশিক।

যাই হোক না কেন, তাঁর মধ্যে যে ‘পাগলা জগাই’ আছে, সেটা তাঁর কাছের মানুষজন একবাক্যে মনে নেন। ‘পাগলা জগাই’ বলেই হয়তো গত তিন বছরে অন্তত তিরিশটা বিদেশি ফেস্টিভ্যালের নেমন্তন্ন তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন লম্বা এয়ার ট্রাভেল করবেন না বলে। সে জন্যই বোধহয় প্রথম সারির পরিচালক হয়েও অনায়াসে তিন লাখ টাকার গাড়িতে উঠতে তাঁর অসুবিধা হয় না।

জিজ্ঞেস করলে মজা করে বলেন, ‘‘গা়ড়ি ফেমাস? না আমি ফেমাস?’’ সেই কারণেই বোধহয় আজ অবধি ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের ব্যবহার করেন না তিনি। সেই জন্যই নিজের কথা সবসময় না বলতে পারার যন্ত্রণা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই আফসোসের কথা বলতে গিয়ে চোখে জল ভরে গলা বুজে আসে তাঁর।

এত কিছুর মধ্যেও নচিকেতার গানের ‘পাগলা জগাই’‌য়ের মতোই তাঁর ট্রাকও সিনেমার হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে। সেই আকাশে তারা নেই, আছে অসংখ্য গল্পের ছটা।

এই সব নিয়েই পরিচালক, গল্পকার কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর সম্বন্ধে আরও কিছু লিখতে পারতাম, কিন্তু সেগুলো একেবারেই ব্যক্তিগত এবং একান্ত।

এবং হলফ করে বলতে পারি, এই লেখাটা বেরোনোর দু’দিন পর তাঁর ছেলের ক্লাস বারোর রেজাল্ট বেরোবে। এই লেখা পড়ে হয়তো তিনি এবং তাঁর স্ত্রী চূর্ণী চলে যাবেন ছেলের সঙ্গে কলেজ জীবন নিয়ে কথা বলতে। তার আগে অবশ্য লেখাটার লিঙ্কটা টুইটারে দিতে ভুলবেন না কৌশিক। কারণ তাতে তাঁর পরবর্তী ছবির প্রচার হবে।

এই দু’টো মানুষের নামই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।

কলকাতার সিনেমাওয়ালা।

Kaushik Ganguly Director cinemawala
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy