Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিষাণ ভট্টাচার্য

তাঁকে নিয়ে তোলপাড় টালিগঞ্জ। মেয়েদের বেড়ে যাচ্ছে হার্টবিট। আবার কারও চোখ ঈর্ষায় সবুজ। নেশা-পরকীয়া-সিনেমা সব নিয়ে খুল্লমখুল্লা সেই অনির্বাণ ভট্টাচার্য। মুখোমুখি দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়তাঁকে নিয়ে তোলপাড় টালিগঞ্জ। মেয়েদের বেড়ে যাচ্ছে হার্টবিট। আবার কারও চোখ ঈর্ষায় সবুজ। নেশা-পরকীয়া-সিনেমা সব নিয়ে খুল্লমখুল্লা সেই অনির্বাণ ভট্টাচার্য।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

• আপনাকে যাঁরা চেনেন, তাঁদের কেউ কেউ ‘ঈগলের চোখ’ দেখে বলছেন, আপনার মধ্যে একজন ‘বিষাণ রায়’ বাস করে। আপনিও যথেষ্ট রমণীমোহন।

(আড়চোখে চেয়ে) তাই? তা হলে বলি। আমার মধ্যেও একটা খারাপ মানুষ বাস করে। ওই নাছোড়-অগোছালো জীবনটা আমি জানি। অতি আগ্রহ দেখানো নারীকে প্রত্যাখ্যান করার পর তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, আমার দেখা। অনিয়ন্ত্রিত নেশায় আদর করার চেহারাটা আমার যাচাই করা। আমিও মনে করি শরীরটা একটা যন্ত্র। যৌনতা একটা প্রয়োজন। প্রেম বলে আসলে কিছু হয় না।

• সে কী? এই অনির্বাণের কিন্তু এক সময় স্টেডি অ্যাফেয়ার ছিল।

ছিল। দুর্ধর্ষ উদ্‌যাপনের ছ’-সাত বছর বাদে সেটা ভেঙে যাওয়ার পর প্রেম সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি হয়েছে।

• থিয়েটার আর সিনেমা। আপনার কাছে কোনটা বিয়ে, কোনটা পরকীয়া?

এ দুটোর একটাও নয়। বরং বলা যেতে পারে, আমার কাছে দুটোই পছন্দের নারী। যারা দু’ধরনের ফসল দেয়।

• ভাবের কথা বাদ দিন। স্পষ্টাস্পষ্টি বলুন...

বুঝতে পারছি আপনি কী বলাতে চাইছেন। থিয়েটারে অভিনেতাকে অভিনয় ছাড়াও অনেক দায়, কর্তব্য সামলাতে হয়, তাই সেটা বিবাহিত জীবনের মতো। আর সিনেমায় যেহেতু সেই দায় নেই, তাই সেটা... কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি ও ভাবে সিনেমা করতে চাই না। সিনেমা তৈরির সব বিভাগে আমি থাকতে চাই। এমনকী ট্রলিটা ঠেলতে দেখলেও হাত নিশপিশ করে। বেণুদার (সব্যসাচী চক্রবর্তী) মতো আর্টিস্টও ‘ট্রয়’ নাটক করার সময় দেখেছি, সেট বয়ে মঞ্চে নিয়ে যাচ্ছেন। নাট-বল্টু আটকাতে সাহায্য করছেন। সিনেমায় এ সব সম্ভব নয়। তার যুক্তিযুক্ত কারণও অবশ্য আছে।

• লোকে বলছে, বহু দিন বাদে মঞ্চ থেকে একজন নায়ক-অভিনেতা উঠে এল।

হঠাৎ একটা মাতামাতির অংশ হয়ে পড়লাম। ব্যাপারটা আমি এনজয় করছি। কিন্তু ভাল জানি না ঠিক কেন এটা হচ্ছে... সিনেমাটা জোড়ায় জোড়ায় চোখ দেখছে, তার প্রথম দুটো কারণ কিন্তু অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, নির্দেশক অরিন্দম শীল। আমি ভাগ্যবান, ওঁদের কাছে থেকে কাজ করতে পেরেছি, একটা ‘গ্লোরি’র অংশ হতে পেরেছি। ওঁরা আমায় যে ভাবে আগলেছেন, আমার খামতি যে ভাবে ঢেকেছেন...

• খামতি? যেমন...

(হেসে ফেলে) সেটা বললে তো আপনারা রে-রে করে তেড়ে আসবেন। ওটা আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং।

• কেউ কেউ বলছেন, আপনাকে পর্দায় একটু কম থিয়েট্রিকাল হতে হবে...

যাঁরা এ সব বলছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান জানিয়েই বলছি, ‘থিয়েট্রিকাল’ বলতে ওঁরা কী বোঝাচ্ছেন, জানি না। তবে আমার মনে হয়, আমার চরিত্রকে আরও সূক্ষ্ম ভাবে তুলে ধরতে আমার অবজারভেশন পাওয়ারটা বাড়াতে হবে। আর একটা কথা, আমি কিন্তু না-অভিনয় কনসেপ্টটায় বিশ্বাসী নই। ইরফান, নওয়াজউদ্দিনরা যে অভিনয়টা করেন, তার জন্য একটা শারীরিক গড়ন লাগে। সেটা না মেনে শুধু না-অভিনয় করলে অভিনয়ের আত্মাটা মারা যায়। আর একটা কথা, বাঙালি কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রেও বেসিকালি মেলোড্রামাটিক, উচ্চকিত...। যেমনটা বলতেন ঋত্বিক ঘটক। একদম তাই। আর দেখুন, অভিনয়টা অভিনয়ই। সে থিয়েটারই হোক, বা সিনেমা...

• ‘রাজা লিয়ার’ করার সময় মঞ্চে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আপনাকে রোজ মাথায় ভারী বই নিয়ে, হাত পাশে রেখে হাঁটতে বলেছিলেন। সিনেমার ক্ষেত্রে এমন কোনও চর্চার কথা কেউ বলেননি?

না, অমন বৈঠকী পরামর্শ কেউ দেননি। কিন্তু ‘আরশিনগর’-এর সময় রীনাদি (অপর্ণা সেন) বলতেন, ‘তোর জ-লাইনটা ভাল, ওটা ব্যবহার কর।’ অরিন্দমদা যেমন চোখের এক্সপ্রেশন নিয়ে কিছু কিছু বলেছেন, ডেকে ডেকে মনিটর-এ দেখিয়ে দিয়েছেন।

• তা হলে সিনেমার চর্চা বলতে আপনার এখনও সেই বাড়িতে বসে বারবার চার্লস লোটন, অ্যাল পাচিনো, মার্লন ব্রান্ডো, কী উত্তমকুমার দেখা, ব্যস?

তা কেন, ইদানীং ভয়েস-এক্সারসাইজ করছি। হাম্পিতে অবন্তীদির (চক্রবর্তী) ওয়ার্কশপে গিয়ে ঝর্নার কাছে, পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে নানা রকম আওয়াজ করা প্র্যাকটিস করেছি। সেগুলো এখানেও আউটডোরে করছি। পরের বছর ভেবেছি, বাইকে করে পুরুলিয়ার জঙ্গলে গিয়ে কিছু অভ্যাস করব। এ ভাবে শিকড়ে গিয়ে, প্রকৃতির কাছাকাছি গিয়ে চর্চা করলে ভেতরকার ‘ইন্সটিঙ্কট’টা ঠিকঠাক বেরিয়ে আসে। এছাড়া কিছু কিছু চরিত্র করতে, একটা প্রস্তুতি আমি নিই। বাঁচার ধরনটাই তখন পাল্টে দিই।

• যেমন?

যেমন ধরুন, ‘আরশিনগর’-এর সময় মাস দুই গাঁজা খেয়েছি। গাঁজা খেয়ে নিজেকে কেমন দেখতে লাগে দেখেছি। ‘ঈগলের চোখ’-এ এক পেগ হুইস্কি খেয়েও শট দিয়েছি। এক পেগ-এ আর কী নেশা হয়, কতক্ষণই বা! কিন্তু একটা অনুভূতি তো তৈরি হয়, সেটাকেই শট-এর প্রয়োজনে বয়ে বেড়িয়েছি।

• ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নায়ক হবেন, অথচ ইনস্টাগ্রাম, টুইটার দূরে থাক, ফেসবুক অ্যাকাউন্টও নেই। পিআর বলতে গেলে শূন্য...

ও সব আমার পোষায় না। সকালবেলা জ্বালাময়ী একটা কমেন্ট, তার পর তিনশো চৌষট্টিটা রিপ্লাই... তা হলে অভিনয়ের চর্চাটা কখন করব? পিআর? তবে শুনুন, থিয়েটার করতে করতেই বুঝেছি, অভিনেতা প্রাণীটি, তার কাজটি ক্ষণিক সময়-পুঞ্জের মধ্যেই উদ্‌যাপিত হবে। তার পর নয়। ‘মিথ’ হয়ে গেলে আলাদা কথা। আমার অত প্রতিভা নেই। আর আমি একটু গ্রাম্যও বটে।


‘ঈগলের চোখ’ ছবিতে অনির্বাণ ও পায়েল।

• গ্রাম্য? অনির্বাণ ভট্টাচার্য? যে কিনা পর্দায় স্মার্টলি লিপ-টু-লিপ চুমু খায়, শয্যাদৃশ্যেও...

ওটা হয়ে যায়। আর এখানে জয়া (এহসান), পায়েল (সরকার) যে ভাবে কোঅপারেট করেছে...

• কার সঙ্গে কেমিস্ট্রিটা বেশি জমল?

দু’জনের সঙ্গেই সমান।

• এটা ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর। আচ্ছা, বাদ দিন, বাংলার কোন নায়িকার সঙ্গে বারবার অভিনয় করতে ইচ্ছে করে?

জয়া এহসান।

• পায়েল নয়?

আরে... (সোজা হয়ে বসে)! আপনারা পারেনও। ঠিক কথার ফাঁক খুঁজে নেন। তা হলে বলি, দু’জনের সঙ্গেই।

• ‘ঈগলের চোখ’ দেখে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কিছু বললেন? বা আপনি কিছু জানতে চাইলেন?

(ছিটকে উঠে) ওরে বাব্বা! না। একে ওঁর গল্প নিয়ে দুটো নাটক করছি, ওঁর মেয়ে দেবলীনাদি’র কাছে মৌখিক পারমিশন নিয়ে। ভয়ে ভয়ে আছি। প্রিমিয়ার-এ দেখা হল। কত ইচ্ছে ছিল বলি, নাটক দেখতে আসতে। তার পর ভাবলাম, পাগল!

• দু’জন বড় পরিচালকের সঙ্গে কাজ হয়ে গেল। কোনও ফারাক?

রীনাদি, অরিন্দমদা দু’জনের কাছেই প্রচণ্ড অপত্যস্নেহ পেয়েছি। তবে রীনাদির ফ্লোর একটু গম্ভীর-গম্ভীর। যদিও আমার তাতে কোনও অসুবিধে হয়নি। অরিন্দমদার ফ্লোর, ইউনিট, তুলনায় অনেক ফ্রেন্ডলি।

• থিয়েটারে যেমন অরুণ মুখোপাধ্যায় বা বিভাস চক্রবর্তীর সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছের কথা বলেন, সিনেমায় তেমন...

‘ফড়িং’য়ের পরিচালক ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী বা ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’র প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য। এবং অবশ্যই লালদা (সুমন মুখোপাধ্যায়)। কিংবা কমলদার (কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়) ‘মেঘে ঢাকা তারা’র কোনও একটা চরিত্র পেলে বর্তে যেতাম। ওঁর ‘ক্ষত’-তে ছোট্ট একটা চরিত্র করার সময় কাজের কথা বলেওছি।

• শিবপ্রসাদ-সৃজিত বা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজের ইচ্ছে?

অবশ্যই। তবে সৃজিতদার সঙ্গে আলাপ নেই। কৌশিকদা যখন ‘অদ্য শেষ রজনী’র রিভিউ করেন ‘পত্রিকা’য়, তখন কথা হয়েছিল। তার পর ওঁকে আমার অন্য নাটক দেখার জন্য টেক্সট করেছি বারকয়েক, উত্তর পাইনি। তবে দেখুন, দেব বা অঙ্কুশ যে কাজটা করে, ওটা আমার দ্বারা হবে না।

• ‘চাঁদের পাহাড়’ হলেও না?

না। আমি সিংহ-র সামনে দৌড়চ্ছি, সিংহকে ‘বিট’ করে বেরিয়ে যাচ্ছি, এই যদি হয়, সে-ছবি দু’দিনও চলবে না। তবে শুধু বাংলা নয়, একবার এক জার্মান পরিচালক থমাস ওস্টারমেয়ারকেও মেল করে বসেছিলাম। উত্তর পাইনি।

• বলিউড-এ ডাক পেলে কী করবেন?

ধেই ধেই করে চলে যাব। বিশেষ করে যদি বিশাল ভরদ্বাজ বা দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় হয়। আর নায়িকা যদি সোনাক্ষী সিংহ হয় তো... (চোখ মুড়িয়ে হেসে ফেললেন)

• নাটকের জন্য গান লিখেছেন। সুর করেছেন। কোনও দিন সিনেমায়...

করছি তো। প্রমিতা সেনগুপ্ত একটা ছবি করছেন, সেটার।

• এত দৌড়াদৌড়ির মধ্যে মেদিনীপুরের বিধাননগর-শরৎপল্লিটা কী ভাবে মনে জেগে আছে?

(অল্প থেমে, কিছুটা অন্যমনস্ক) মা-বাবা-বোন... এখন ন’মাসে ছ’মাসে যেতে পারি। ওরা অভিমান করে। কষ্ট পায়। যখন যাই, দেখি মায়ের চুলে পাক ধরাটা একটু একটু করে বাড়ছে। বিধাননগরের মাঠে আটটা পিলার বসেছে, সাদা সাদা আলো...। আমার বন্ধু শুভাশিসকে নিয়ে মাঠে গিয়ে দাঁড়াই। দুটো বিড়ি খাই।... মনে হয়, আজও ওখানে যা কিছু পুরনো, সেটাই আমি...

• কলেজ বেলায় শিয়ালদার মেস, পাইস মিল, তখনকার উঠতি ক্রিকেটার অশোক দিন্দার সঙ্গে রুম শেয়ারিং..

(শিশুর মতো হাসি) কোলে মার্কেট! উফ্ কী জীবন ছিল! দিন্দার সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই। তবে ওর ব্রেকফাস্ট খাওয়াটা আজও ভুলিনি। দু’হাতে গপাগপ করে খেত। চারটে ডিম, দশটা পাঁউরুটি...

• শেষ প্রশ্ন। শোনা যাচ্ছে, সামনের বছর অনির্বাণ ভট্টাচার্য পাটুলির ভাড়া বাড়ি ছেড়ে ফ্ল্যাট কিনছেন। গাড়িও। তার পর বিয়ে।

(ভ্রু তুলে) এ সব কারা বলে বলুন তো!

• এমনি বললাম। সত্যিটা তো আপনি বলবেন।

(প্রচণ্ড হেসে) তাই বলুন, মিস্টার শবর দাশগুপ্ত! ‘ঈগলের চোখ’ বটে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anirban Bhattacharya Interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE