Advertisement
E-Paper

শহুরে রূপকথা

‘বাবার নাম গান্ধীজী’। খুদে অভিনেতা সুরজিৎ মুখোপাধ্যায় আর পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে চমকে দিলেন তরুণ পরিচালক পাভেল। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়‘বাবার নাম গান্ধীজী’। খুদে অভিনেতা সুরজিৎ মুখোপাধ্যায় আর পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে চমকে দিলেন তরুণ পরিচালক পাভেল। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১

ময়দানে গাঁধীমূর্তির নীচে যেখানে মাঝে মাঝে পলিটিকাল জমায়েত আর ২ অক্টোবর রুটিনমাফিক মাল্যদান হয়, আকাশ ভাঙা বৃষ্টি মাথায় করে বছর বারোর একটি ছেলে এক দিন সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছিল। একা। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জাতির জনককে তার সমস্ত রাগ, অভিমান, অপমান আর জেদ চোখের জলে উগরে দিয়ে বলে এসেছিল, তোমাকে চাপ নিতে হবে না। নিজের ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নেব।

ছেলেটির ডাকনাম কেঁচো। ভাল নাম, কেঁচোদাস মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী।

শহরের দেয়ালে দেয়ালে ‘বাবার নাম গাঁধীজি’ বলে একটা সিনেমার পোস্টার এ ক’দিনে চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই। কেঁচোই সেই বাবার ছেলে। বাপু কা বেটা। কেঁচোর গল্প নিয়েই টালিগঞ্জে পরিচালকের টুপি মাথায় গলাচ্ছেন আরও একটি নতুন মুখ, পাভেল। এ বছরটা যেন বাংলায় প্রথম ছবি করিয়েদের বছর। একসঙ্গে অনেক নবীন পরিচালক তাঁদের খাতা খুলেছেন। ভাগ্যদেবী তাঁদের অনেকের প্রতি প্রসন্নও হয়েছেন। সেই লিগে পাভেলের নামটাও ঢুকবে কি না, সেটা আর ক’দিনের মধ্যেই বোঝা যাবে। তবে নেহাতই সাদামাঠা চেহারার এই যুবক মাত্র ২৬ বছর বয়সে যে চমকে দেওয়ার মতো কাজ করেছেন, সেটা এখনই বলে দেওয়া যায়। এই ২৬ বছর বয়সেই ‘ওয়েক আপ সিড’ বানিয়ে বলিউডে হইহই ফেলে দিয়েছিলেন অয়ন মুখোপাধ্যায়। কিন্তু তিনি ছিলেন আদ্যন্ত ফিল্মি পরিবারের সন্তান। পাভেল শূন্য থেকে শুরু করে নিজের জায়গাটা বানিয়েছেন। স্পট বয় হিসেবে ঢুকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, স্ক্রিপ্টরাইটার হয়ে আজ তিনি নিজের ছবি নিয়ে হাজির। এবং গতে বাঁধা রাস্তায় হাঁটার বান্দা যে নন, সেটা প্রথম কাজেই পরিষ্কার।

কেঁচো, পেঁদো, ছিপি, পুক্কি- কেতাবি ভাষায় যাদের নাম পথশিশু— তারা একটা আস্ত সিনেমার দখল নিচ্ছে, শহুরে বাংলা ছবিতে এমন বড় একটা দেখা যায় না আজকাল। রাজ কপূরের বুট পলিশ, বা বাংলায় মানিক-এর মতো ছবি তাই বলে সব্বার মন থেকে মুছে গেছে, এমন নয়। অত যুগ আগে পিছিয়ে যেতে যদি না-ও চান, তা হলে ‘আই অ্যাম কালাম’ ছবিটির কথা মনে করুন। টিভিতে এ পি জে আব্দুল কালামের ছবি দেখে দোকানে কাজ করা ছোটু ঠিক করে নেয়, সে-ও কালাম হবে। টাই পরে ঘুরবে, বড় স্কুলে পড়বে। বাবার নাম...এ সেই ম্যাজিকটা ঘটান গাঁধী। এর আগে তিনি মুন্নাভাইয়ের জীবন বদলে দিয়েছিলেন, এ বার কেঁচোর পালা।

দীর্ঘদিন অবধি কেঁচো জানতই না, তার বাবা-মা কারা। এক বুড়ো মাতাল ভিখিরি তাকে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ক’বছরের মধ্যে মুখ দিয়ে রক্ত তুলে বুড়োর এন্তেকাল হল। কেঁচো নিষিদ্ধ পল্লির আরও সব বাচ্চা-বুড়ো, ভিখিরি, তোলাবাজ মস্তানদের বৃহৎ পরিবারে মিশে গেল। কালে-দিনে খুচরো ভিক্ষে করা ছেড়ে বিভিন্ন লোকজনকে তাদের বেসামাল মুহূর্তে পুলিশের ভয় দেখিয়ে, কখনও ব্ল্যাকে মোবাইল রিচার্জ বেচে দিব্যি দু’পয়সা কামাতেও শিখে গেল। গলিতে ইস্কুল খোলা এনজিও-দাকে বলে দিল, রোজগারের জন্যই তো লেখাপড়া! তা সে রোজগার তার এমনিই আছে।

কী ভাবে এই কেঁচো এক দিন গাঁধী-পুত্রের তকমা পেল, আর কী ভাবেই বা তার জীবনটা বদলাতে শুরু করল, সেই কাহিনি হল-এ গিয়ে দেখাই ভাল। কাহিনি তো নয়, নিটোল রূপকথা। সেখানে সব সময় সব কিছু লজিক মেনেই হতে হবে, এমন নিয়ম নেই। ঘোড়ার ডানা নেই, কে না জানে! তা বলে কি পক্ষিরাজ মিথ্যে? রূপকথা দাবি করে বিশ্বাস, দাবি করে বিস্ময়।

ভালবাসার উষ্ণতা না থাকলে রূপকথারা প্রাণ পায় না। পাভেলের সৌভাগ্য, সেই উষ্ণতা তিনি তাঁর ইউনিটের কাছে পেয়েছেন। সেটা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের একেবারে অন্য রকম একটা অভিনয়ই হোক, সুপ্রিয় দত্তের ক্যামেরাই হোক বা সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা বা রাজা নারায়ণ দেবের সঙ্গীত। ছোট থেকে মাঝারি অন্য সব চরিত্রেও যাঁরাই অভিনয় করেছেন—অরুণ মুখোপাধ্যায়, সায়নী ঘোষ, মিশকা হালিম, শঙ্কর দেবনাথ, সঞ্জয় বিশ্বাস, দেবদূত ঘোষ— দেখে বোঝা যায়, বড় ভালবেসে করেছেন। পাভেলের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে তাঁর ইউনিট রাস্তায় পোস্টার সাঁটতে নেমেছে। পরমব্রতর মতো ব্যস্ত নায়ক যে ভাবে এই ছবির জন্য জান লড়িয়ে দিয়েছেন, তার জন্য তাঁর বাড়তি কুর্নিশ প্রাপ্য। পাশে দাঁড়িয়ে যথাসাধ্য সাহায্য করে গিয়েছেন কৌশিক সে‌নও।

কিন্তু এঁরা তো কেউ রাজা, কেউ মন্ত্রী, কেউ কোটাল, কেউ সওদাগর...। আসল গল্পটা তো রাজপুত্তুরের। বাস্তবে যার নাম সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়। ‘তারে জমিন পর’-এ দর্শিল সাফারি যদি একটা ‘ঘটনা’ হয়ে থাকে, ‘চিল্লার পার্টি’তে নমন জৈন বা হালের ‘ওপেন টি’-তে ঋদ্ধি সেন— তা হলে ‘বাবার নাম..’এ সুরজিৎ আর একটা ‘ঘটনা’। শুধু সুরজিৎকে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই এই ছবিটি স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে।

কোথায় পেলেন সুরজিৎকে? সে আর এক আশ্চর্য গল্প। পাভেল প্রথমে যোগাযোগ করেছিলেন ছোটদের নিয়ে কাজ করা নাটকের দলগুলোর সঙ্গে। অডিশনও হয়েছিল। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের নিশ্চিন্দিতে বড় হওয়া বাচ্চাদের দিয়ে পথশিশুর অভিনয় জমছিল না একেবারেই। মেকি লাগছিল। সেই সময় এক দিন পাভেলের নজরে আসে ইউটিউবে ‘ইন্ডিয়া হ্যাজ গট ট্যালেন্ট’য়ের কিছু পুরনো ক্লিপ। সঞ্জয় মন্ডল আর তাঁর ট্রুপের গানবাজনা। ট্যাংরা অঞ্চলের একটি বস্তির বাচ্চাদের নিয়ে সঞ্জয়ের এই দল। ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে বাজনা বাজান, সুর তোলেন ওঁরা। শিশিবোতল, ড্রাম, পাইপের টুকরো…এই সবই ওঁদের সম্বল। সঞ্জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই সুরজিতের হদিস মিলল। কেঁচোর বন্ধুরা বাস্তবেও সুরজিতেরই খেলার সাথি। এই বাচ্চাদের নিয়ে গলি থেকে রাজপথে আসার যে লড়াইটা এত দিন সঞ্জয় চালিয়ে আসছিলেন, নবারুণ ভট্টাচার্যের ভক্ত পাভেলের ছবি সেটাকেই আর এক ধাপ এগিয়ে দিল। ছবির এন্ড টাইটলে সঞ্জয়রা সবাই মিলে যে ভাবে ‘রঘুপতি রাঘব’ গেয়ে ওঠেন, সেই কোরাস অন্য কোনও ভাবে সৃষ্টি হতে পারত না। ঠিক যেমন ভিক্ষাজীবী নির্মলচন্দ্র দে যে ভাবে ‘গুরু ভজ রে’ গেয়ে দেন, সেটা আর কারও দ্বারা সম্ভব হত না।
হ্যাঁ, এই ছবিতে ভিক্ষাজীবীদের ভূমিকায় যাঁদের দেখা যায়, তাঁরা, বাস্তবের সেই ভিক্ষাজীবীরা এই ছবির পেড আর্টিস্ট। ইন্ডাস্ট্রির কেউ কেউ ‘সিটি অব জয় বানাচ্ছ নাকি’, বলে ফুট কেটেছিলেন অবশ্য।

সে সব থাক। আপাতত আজ গাঁধীর জন্মদিনেই একসঙ্গে কলকাতা আর লন্ডনে মুক্তি পাচ্ছে ‘বাবার নাম গাঁধীজি’। প্রমাণ করে দিচ্ছে, এ শহরে আজও রূপকথার জন্ম হয়।

jagari bandyopadhyay babar nam gandhiji pavel Movie Reviews
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy