Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ট্রাম, প্রেম ও আমি

কলকাতায় প্রেম হেঁটে বেড়ায় মাইলের পর মাইল, মনের আনন্দে। কত অজানা মন্দিরের অলিগলি, গুরুদ্বারের শান্ত পাঁচিল অথবা গির্জার নিরালা সেমেট্রি কিংবা জুম্মা পীরের দরগা সাক্ষী থেকে যায় প্রেমের কলকাতার। ভালবাসার-মন্দবাসার কলকাতার। শহুরে হাওয়ায়, নীরব প্রেমের পথচলায় সঙ্গী হয় দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুর, কালীমন্দিরের আরতির ঘণ্টাধ্বনি যুগপত ভাবে। উত্তর কলকাতার হেদুয়ার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় রোজ কত কত প্রেম-অপ্রেম।

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

কলকাতায় প্রেম হেঁটে বেড়ায় মাইলের পর মাইল, মনের আনন্দে।
কত অজানা মন্দিরের অলিগলি, গুরুদ্বারের শান্ত পাঁচিল অথবা গির্জার নিরালা সেমেট্রি কিংবা জুম্মা পীরের দরগা সাক্ষী থেকে যায় প্রেমের কলকাতার। ভালবাসার-মন্দবাসার কলকাতার। শহুরে হাওয়ায়, নীরব প্রেমের পথচলায় সঙ্গী হয় দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুর, কালীমন্দিরের আরতির ঘণ্টাধ্বনি যুগপত ভাবে। উত্তর কলকাতার হেদুয়ার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় রোজ কত কত প্রেম-অপ্রেম। এই প্রেম গিয়ে আছড়ে পড়ে কলেজ স্কোয়্যারে। যার নাম বদলে হয় বিদ্যাসাগর উদ্যান। এই কলেজ স্কোয়্যারের পুরনো নাম গোলদিঘি। গোলপাতা জন্মাত বলে অমন নাম বোধহয়। যাই হোক গোল হোক বা স্কোয়্যার এই পুকুর অনেক প্রেমের দলিল বহন করে চলেছে। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট ধরে কলেজ স্ট্রিট ছাড়িয়ে ওয়েলিংটন মোড়ে গেলে এখনও ধাক্কা খাই গোলগাল ভুটিয়া মাসিদের রংবেরঙের শীত পোশাকের পসরায়। সকলকে জায়গা দেয় আমাদের কলকাতা।
প্রেমের পাতা উল্টে চলে কল্লোলিনী। কত প্রেমের বর্ণপরিচয় হয় গোলদিঘিতে এখনও। ব্রা-ব্রেসিয়ারের কিশোরীর যুগ বদলে যায়। বদলায় না আমাদের প্রেম।
মামারবাড়ি দক্ষিণেশ্বরে। মায়ের ডেলিভারি পেন থেকে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় পেরিয়েই পলাশির যুদ্ধ খ্যাত রাজবল্লভদের বাড়িতে বহু দিনের পুরনো নর্থ ক্যালকাটা নার্সিংহোমে জন্মেই যেন উত্তর কলকাতার সঙ্গে প্রেম হয়ে গেল আমার। আরে তখন কি জানতাম আমার স্কুল কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সিনেমা, থিয়েটার, শপিং— সবকিছু জুড়ে থাকবে এই উত্তর কলকাতা! পুরনো কলকাতার মেয়েদের স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম বরাহনগর রাজকুমারী বালিকা বিদ্যালয়ে টেন প্লাস টু। ওই স্কুলে নাকি প্রথম চালু হয়েছিল বিজ্ঞান শাখা! আর ছিল কেতাদুরস্ত ল্যাবরেটারি। লাইব্রেরিতেও ছিল বিশাল ব‌ইয়ের সম্ভার। ছিল খেলার মাঠ।

তার পর আমরা একপাল মেয়ে জড়ো হয়েছিলাম কলকাতার হেদুয়ার পাড়ে এক ঐতিহ্যবাহী মেয়েদের রক্ষণশীল কলেজে। সেই ছাব্বিশ নম্বর ঘরটা! কাচের সার্শি সরিয়ে, পুরনো গন্ধ বুকে নিয়ে, খড়খড়ির দরজা ঠেলে অন্ধকার ঘরে ঢুকেছিলাম হুড়মুড় করে। কিছুটা উচ্চাশা নিয়ে, আর কিছুটা দুরুদুরু বুকে। ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই পচা ডিমের হাইড্রোজেন সালফাইডের সেই চেনা উচ্চমাধ্যমিক-গন্ধটা অবশ করে দিল সুষুম্না স্নায়ুগুলোকে। বিবেকানন্দের সিমলে স্ট্রিটের পাশে বিডন স্ট্রিটের উপর জন ডিঙ্কওয়াটার বেথুন সাহেবের কলেজে। উল্টো দিকে হেদুয়ার সরোবর আর স্কটিশচার্চ কলেজ। আবারও প্রেম উত্তর কলকাতার সঙ্গে। সে বার সিমলেপাড়ায় স্বামীজির বাড়ি দেখতে গিয়ে ছেলে জিগেস করল, ‘‘মা, হেদো নাম কেন?’’ সত্যি তো ভাবিনি কখনও। তিন বছর পড়েছি হেদুয়ার কাছে বিখ্যাত কলেজে। হেঁটেছি অহোরাত্র। এই কলকাতার বুকেই রচিত অদ্রীশ বর্ধনের ‘আমার মা সব জানে’। অতএব আমার মা বললেন, ‘‘হেদো মানে মজা পুকুর।’’ বাংলায় আটপৌরে নাম হেদো আর পোশাকি নাম হেদুয়া। আর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের উপর অত্ত বড় পুকুরের ইংরেজি নাম কর্নওয়ালিশ স্কোয়্যার। এখন স্কটিশচার্চ কলেজের দর্শনের নাম করা অধ্যাপক আর্কহার্ট-এর নামে আর্কহার্ট স্কোয়্যার বলা হয়।

আমার কলেজবেলায় কলকাতা ছিল ট্রামময়। কি কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, কি সার্কুলার রোড— এই ট্রাম যানের নেটওয়ার্কটি ছিল বড় বন্ধুতায় ভরা, মায়াময়। এখন তো গ্যালিফ স্ট্রিট থেকে চিত্পুরের দিকে হাতে গোনা এই ‘স্ট্রিট কার’ উত্তর কলকাতার বুক চিরে ধুঁকতে ধুঁকতে চলে ঠিক কলকাতার সিনিয়র সিটিজেনদের মতো। সেই সিনিয়র সিটিজেনরাও এই কলকাতার প্রতি তাদের প্রেমটাকে নিয়েই শুধু বেঁচে থাকেন দিনের পর দিন এই শহরে। কি ভাগ্যি গত শতাব্দীর কলকাতার সার্কুলার ও ইস্টার্ন ক্যানাল সমূহের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ও ক্যানালের টোল কালেকটর এই গ্যালিফ সাহেবের রাস্তাটি এখনও টেনেটুনে বাঁচিয়ে চলেছে পুরনো কলকাতার ট্রামলাইনের টুংটাং ঘণ্টি নাড়া। ৯ নম্বর গ্যালিফ স্ট্রিটে তাঁর অফিস বাড়িটি এখনও আছে, যার নাম ক্যানাল ভিলা। আমরা ধরে রাখতে পারি না সেটা আমাদের ধর্ম, কিন্তু গর্ব করে বলতেও ছাড়ি না তার কথা।

কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের ফুটপাথ ধরে আমাদের কলেজের গল্প-পথ আনন্দে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিল রাজাবাজারের দিকে। পুরনো কলকাতার গন্ধ নাকে। উত্তর কলকাতার বনেদি সব গলি ছায়াময় আর রহস্যময়। গল্প ফুরোত না। ধাক্কা খেত আপার সার্কুলার রোডে সায়েন্স কলেজের পাশের রাস্তা পারসিবাগান স্ট্রিটে। কি নিরিবিলি আর নিঝুম ছিল পারসিবাগান স্ট্রিট। রুস্তমজি কাওয়াসজিরা ছিলেন কলকাতার বনেদি এক ব্যবসায়ী পারসি পরিবার। এঁর নামে বরাহনগর কাশীপুরে একটি রাস্তা আছে রুস্তমজি পারসি রোড। দক্ষিণ কলকাতায় বিয়ে হয়ে দেখি গড়িয়াহাট রোড থেকে বেরিয়েছে আর এক রাস্তা যার নাম রুস্তমজি স্ট্রিট। মাঝে মাঝে কলকাতার উদারতা আর ব্যাপ্তি দেখে বিস্মিত হ‌ই আজও। রুস্তমজির পুত্র মানেকজি রুস্তমজি তাঁর পিতার মতো কলকাতার পারসি সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন। শেরিফ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর নামেই মানিকতলার নাম হয়েছিল। পারসিবাগান এখনও অনেক প্রেমের ওঠাপড়া আর অপ্রেমের চোখের জলের ফোঁটায় বেঁচে রয়েছে।

ছুটে চলত আমাদের উচ্ছ্বাসেরা, ফুটে উঠত ছোট ছোট উল্লাস। চাহিদা ছিল কম। প্রেম এখনকার মতো অত দুর্মূল্য ছিল না। আধখানা এগরোল কিম্বা দু’টাকার ফুচকাই সম্বল ছিল বন্ধুতার। কাঠফাটা রোদ্দুর মাথায় করে প্যারামাউন্টের ঠান্ডা রঙিন শরবত নিয়ে আড্ডা জমত কলেজ স্কোয়্যারে। কিন্তু, দাঁড়িয়েই থাকত প্রেম আমাদের। একান্ত মুখোমুখি বসে একটু পড়াশোনার চেষ্টা বা নোট তৈরির অছিলায় কফিহাউস ছিল হাতের পাঁচ... যে ধরত মাথার ওপর বিশাল ছাতা। আমাদের রোদ-বৃষ্টি-ঝড় সব কিছুর থেকে আগলে রাখার ঠেক।

মায়ের মুখে শুনেছি, বেথুন কলেজের তন্বী তনয়ারা ষাটের দশকে সুইমস্যুট পরে হেদোর সুইমিং পুলে সাঁতার কাটত কলেজের পর। কলেজ কেটে প্রেমিকের সঙ্গে মুখ লুকোত সার্কুলার রোডে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পাশের রাস্তা দিয়ে গিয়ে বেপট এক নিরালায় পরেশনাথ জৈন মন্দিরে। তা হলেই বুঝুন, কত আধুনিক ছিল এই কল্লোলিনী! এখনও সেই ট্র্যাডিশন চলেছে একই রকম ভাবে। কত প্রেম, কত কথা আর প্রতিশ্রুতিতে সেই নিস্তব্ধ জৈন মন্দিরের আনাচকানাচ অবিরত মুখর হয় আজও। সে দিন নিজের চোখে গিয়ে দেখে এলাম।

কলকাতার সত্যিকারের লম্বা ও চওড়া রাস্তা হল এই সার্কুলার রোড। আমার রোজের ট্রামচড়ার পথ। শ্যামবাজার থেকে সায়েন্স কলেজ অবধি ১২ নম্বর লেডিজ ট্রাম চলত তখন। আপার সার্কুলার রোডের নাম আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড। বিধান সরণির সঙ্গে সমান্তরাল। এটি নাকি ছিল প্রথম পাকা রাস্তা। আজ সেখানে ওই ১২ নম্বর ট্রামের অভাবটা ভীষণ প্রকট। কলকাতা ট্রাম ওয়েজ কোম্পানির এই বিশাল নেটওয়ার্কের অবনমন আমার কলকাতা প্রেমকে একটু একটু করে কমিয়ে দেয়।

আর সেই অলিগলি, কানাগলি, বাই লেন? আর সাহেবসুবোর নামের রাস্তাগুলো? গ্রে স্ট্রিট মানেই হাতিবাগান আর তার সঙ্গে উঠে আসে ডাইনে বাঁয়ে সিনেমা হল আর থিয়েটারশালা! ঘোষ-কাজিনের গলি থেকে গোলবাড়ির কষামাংস-রুটির প্রেম! আর জলযোগের কি রমরমা তখন! পয়োধিও মিলত জলযোগে, যা খেয়ে রবিঠাকুর স্বয়ং জলযোগের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। মাত্র এক টাকায় মাংসের প্যাটিস। ভাবা যায়! কি অনবদ্য সেই স্বাদ! সেই থেকেই যেন শহরটা সস্তা হয়ে গেল। সকলের কাছে সস্তা। যে আসে সে যেতে চায় না। বাঙালি ব্যবসার পাততাড়ি গোটায়। অবাঙালির শহর হয়ে উঠে ক্রমশ। কেমন যেন রোমান্টিক হয়ে যাই আজও। রাস্তার নামগুলো বদলে যায় আমার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। মানতে পারি না। ভীষণ কষ্ট পাই। আপার সার্কুলার রোড, বিধান সরণি আর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কেমন সুন্দর সমান্তরাল এখনও। কত ভীড়, কত মিছিল তবুও আমার কলকাতা, আমাদের কলকাতা। আজও যখন চৌরঙ্গী থেকে শ্যামবাজার ক্রশ করি... চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ, গিরীশ অ্যাভিনিউ, ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ... ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টকে মনে মনে ধন্যবাদ জানাই।

উত্তর কলকাতায় জন্ম। রসায়নে মাস্টার্স রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে। বিবাহ সূত্রে বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। আদ্যোপান্ত হোমমেকার। শুধু ভ্রমণকাহিনি, ছোটগল্প, প্রবন্ধ লেখায় ঝোঁক। ইতিমধ্যে একাধিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে তাঁর লেখা। নেশা— ঘুরে বেড়ানো ও ব্লগ লেখা। অবসর যাপনের আরও একটি ঠেক হল গান এবং রান্নাবাটি ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE