Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

শিশির ভাদুড়ী আজও তাঁর শিরোধার্য

সত্যজিত্‌ নেই, থাকলে এত দিনে নব্বই (জ. ১৯২১) পেরিয়ে যেতেন, সত্যজিতের সংস্পর্শে আস্তে আস্তে কী ভাবে ‘অপু’ হয়ে উঠলেন, অরুণেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে এক দীর্ঘ সাক্ষাত্‌কারে (পরশ মানিক, অর্কদীপ) শুনিয়েছেন সৌমিত্র।

কলকাতার কড়চা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৪ ১৬:৪৩
Share: Save:

আশি ছোঁবেন সৌমিত্র
সত্যজিত্‌ নেই, থাকলে এত দিনে নব্বই (জ. ১৯২১) পেরিয়ে যেতেন, সত্যজিতের সংস্পর্শে আস্তে আস্তে কী ভাবে ‘অপু’ হয়ে উঠলেন, অরুণেন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে এক দীর্ঘ সাক্ষাত্‌কারে (পরশ মানিক, অর্কদীপ) শুনিয়েছেন সৌমিত্র। নেতারহাটে ‘অপুর সংসার’-এর শুটিং, মধ্যরাতে উঠে সকলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আর অরণ্যের ভিতর ভোর হচ্ছে, “হঠাত্‌ পাশ থেকে মানিকদার গলা পেয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে দেখি ওঁর দু’চোখ জলে ভরে গেছে, উনি বলছেন, ‘উফ্, কী দৃশ্য! কী দৃশ্য!!’ একটু থেমে মানিকদা আবার নিজের মনেই বললেন, ‘এ যেন একেবারে মাস্টারমশাইয়ের (নন্দলাল বসু) আঁকা ছবি!’” সত্যজিত্‌ নেই, কিন্তু প্রতিদিনই তাঁকে মনে পড়ে সৌমিত্রর, সত্যজিত্‌ বা শিশির ভাদুড়ী ছাড়া তাঁর একটা দিনও কাটে না। কিছু দিন পরে ‘কুমার রায় স্মারক বক্তৃতা’ও দেবেন শিশিরকুমারকে নিয়ে। নতুন নাটক? ইবসেনের ‘গোস্টস’-এ অভিনয় করবেন ভাবছেন, অনেক আগে নাটকটা অনুবাদ করেছিলেন, ফের নতুন করে লিখছেন। নাট্যরূপ দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পেরও, ভি জি আয়েঙ্গার-এর ‘হ্যাপেনিংস’-এর তত্ত্বাবধানে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই নাট্যরূপগুলি অনুবাদ করবেন ইংরেজিতে।

‘আসলে সর্বভারতীয় পাঠক-দর্শকের কাছে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে পৌঁছে দেওয়ার একটা প্রয়াস,’ জানালেন শমীক, আর জানালেন, ‘সৌমিত্রদার গদ্য সংগ্রহ (দে’জ) সম্পাদনা করছি, শিগ্গিরই বেরোবে। অভিনেতাদের মধ্যে উনি রেনেসাঁস-ম্যান, ওঁর জ্ঞানভাণ্ডারকে মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান।’ নতুন বছরের ১৯ জানুয়ারি আশি বছরে (জ. ১৯৩৫) পা দেবেন সৌমিত্র। মুখোমুখি-র উদ্যোগে সারাদিন অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠান। সকালে তাঁর একান্ত নিজস্ব রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ‘প্রতিদিন তব গাথা’, পাঠে তাঁর সঙ্গে কন্যা পৌলমী ও অপর্ণা সেন, গানে রূপঙ্কর আর লোপামুদ্রা। দুপুরে তাঁর রচনা ও নির্দেশনায় ‘সবজান্তা’, অভিনয়ে পৌলমী ও দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়। সন্ধেয় তাঁর নির্দেশিত-অভিনীত ‘হোমাপাখি’। অ্যাকাডেমির সাউথ গ্যালারিতে চলবে তাঁর স্থিরচিত্র ও আঁকা ছবির প্রদর্শনী, ১৯-২১ জানুয়ারি। বছর-শেষে একটাই প্রশ্ন: শেষ কোন ছবিতে চ্যালেঞ্জিং চরিত্র করেছেন? ‘রূপকথা নয়’ সৌমিত্রর উত্তর। বাঁ দিকে তাঁর ছোটবেলার ছবি, ডান দিকে সুবর্ণরেখা-য় সৌমিত্র-র ছবিটি সুকুমার রায়ের তোলা।

বাংলাকে তাঁরা মননে-কর্মে বিশ্বজনীন করেছেন। আয়ুর বলিরেখা তাঁদের আচ্ছন্ন করতে পারেনি,
আজও অব্যাহত তাঁদের সংস্কৃতিযাপন। তারুণ্যের নতুন পাঠ নিতে বছর শুরুর আগে তাই তাঁদের কাছেই ফেরা।

তুলি-কলমে সব্যসাচী
কল্পাতি গণপতি সুব্রহ্মণ্যন্‌ (জ. ১৯২৪), তামাম কলাজগতের ‘মানিদা’। সদ্য নব্বই স্পর্শ করলেন, অথচ বিচিত্র মাধ্যমে আজও অফুরান শিল্পসৃষ্টি। স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় মাদ্রাজের সরকারি কলেজ ছেড়ে ১৯৪৪-এ সোজা শান্তিনিকেতনের কলাভবনে। অবনীন্দ্রনাথ তখন বিশ্বভারতীর আচার্য। সে দিনের কলাভবনে আচার্যের আড্ডা বা মন্দিরের ভাষণ আজও তাঁর স্মৃতিধার্য। শিল্পের পাঠ নন্দলাল-বিনোদবিহারী-রামকিঙ্করের কাছে, তবে অন্তরঙ্গতা গাঢ়তর হয় শেষের দুজনের সঙ্গে। বিলেতের স্লেড স্কুল অব আর্ট-এ শিল্পের পাঠ নিয়েছেন। দীর্ঘ দিন যুক্ত ছিলেন অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ড বা ওয়ার্ল্ড ক্রাফ্ট কাউন্সিলে। অবশেষে শিল্পশিক্ষক প্রথমে ভাদোদরা, ফের কলাভবন। তুলি ও কলমে সব্যসাচী এই স্রষ্টা এক সংবেদনশীল শিক্ষকও। পদ্মবিভূষণে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। চিরযুবা, চিরনবীন এই শিল্পী-ভাবুকের এক প্রদর্শনী এখন চলছে কলকাতায় (গ্যালারি ৮৮)।

‘থামতে জানাটাও আর্ট’
চারতলায় থাকেন, নিয়মিত সিঁড়ি ভাঙেন, চলাফেরা দেখে কে বলবে নব্বই পেরিয়েছেন (জ. ১৯২২)! ‘কথা বলায় অক্লান্ত। লেখার পিছনে কী ভাবনা কাজ করে, ব্যক্তি ও লেখকজীবন, আরও কত কী নিয়ে অনায়াস বলে গেলেন ক্যামেরার সামনে’, রমাপদ চৌধুরীকে নিয়ে সাহিত্য অকাদেমি-র তথ্যচিত্র ‘অ্যান অথর স্পিকস’ তৈরির অভিজ্ঞতা বলছিলেন রাজা মিত্র, ‘লেখা ছেড়ে দেওয়া সম্পর্কে বললেন থামতে জানাটাও একটা আর্ট।’
সম্প্রতি খুঁজে পেলেন এমন একটি খাতা যেখানে শৈশব থেকে যৌবনের ছবি ধরা আছে, এ বার সেই ‘হারানো খাতা’ বেরোবে ‘দেশ’-এ। আনন্দ-রবীন্দ্র-অকাদেমি পুরস্কার প্রাপ্তি, কোনও কিছুই যেন স্পর্শ করে না প্রচারবিমুখ মানুষটিকে। এও জানাতে ভোলেন না: ‘আমার পাঠক আমি নিজেই তৈরি করে নিয়েছি।’ তাঁকে নিয়ে ‘উজাগর’-এর (সম্পা: উত্তম পুরকাইত) চমত্‌কার প্রয়াস ‘রমাপদ চৌধুরী সংখ্যা’, প্রকাশ পেয়েছে সম্প্রতি।

‘বুদ্ধ’ নিয়ে ফের মঞ্চে
গাছের পরিচর্যা আর পাখিদের খাওয়ানো এটাই রোজনামচা। মাঝে মাঝে নাচের স্কুলে যাওয়া। নিজেও অনুশীলন করেন, ৯৪ বছরেও (জ. ১৯১৯)। এগারো বছরে হঠাত্‌ বাবার সঙ্গে বিলেত, শংকর পরিবারের সঙ্গে আলাপ, নাচ, তার পর উদয়শংকরের সঙ্গে বিয়ে তাঁর কথায়, ‘জীবনটা ভগবান সাজিয়ে দিয়েছেন।’ এখন স্মৃতিতে শুধু ছোটবেলার বাটাজোড় গ্রাম। ‘মেঝেতে চাল ছড়িয়ে বাবা মানচিত্র বানাতে বলতেন। ঢেঁকি পাড় দিতে গিয়ে তাল-জ্ঞান হল!’ ছবি আঁকা শুরু নখ দিয়ে আঁচড় কেটে। এখনও ‘মুড’ হলে ছবি আঁকেন। গত বছর কান-এ দেখানো হল উদয়শংকর পরিচালিত, অমলাশংকর অভিনীত ছবি ‘কল্পনা’। সেখানে রেড কার্পেটে হেঁটে এলেন। নতুন বছরে আবারও মঞ্চে ওঠার ইচ্ছে, সেই বিখ্যাত ‘বুদ্ধ’ নিয়ে। প্রার্থনা, প্রতি জীবনে যেন নারী হয়েই জন্মাতে পারি।

বদলে দিলেন পাঠ্যসূচিটাই
বরিশালের এই বাঙালের চেষ্টাতেই বদলে গিয়েছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের ইতিহাসের পাঠ্যসূচি। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড এবং ফ্রান্সের সরবোন, দুই প্রতিষ্ঠানেই ভারতের ইতিহাস মানে ছিল ‘ফার ইস্টার্ন স্টাডিজ’। ৮৮ ছুঁতে-চলা তপন রায়চৌধুরী (জ. ১৯২৬) অক্সোনিয়ান পাঠ্যসূচির খোলনলচে বদলে গাঁধী, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে নতুন পাঠক্রম আনেন। সাধারণত, এ দেশে যিনি মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন, তিনি প্রাচীন ভারতের বাণিজ্যপথ নিয়ে ভাবিত নন। যিনি শিলালিপি পড়েন, তাঁর কাছে আধুনিক দক্ষিণ এশিয়া প্রায় গোলকধাঁধা। আর তপন রায়চৌধুরী? কখনও আকবর, জাহাঙ্গিরের আমলের বাংলা, তার পরই করমণ্ডল উপকূল। মাঝে অর্থনৈতিক ইতিহাস। আবার শুরু হল ঔপনিবেশিক বাঙালির মনন, আবেগ নিয়ে চিন্তা। পাশাপাশি বাংলা ভাষায় এনেছেন চমত্‌কার উইট ও হিউমার। তাঁর রোমন্থন থেকে বাঙালনামা-র (আনন্দ) পাতায় পাতায় ছড়িয়ে সেই কৌতুক। সব মিলিয়েই তিনি বাঙালির উজ্জ্বল উদ্ধার।

নাটকে, চলচ্চিত্রে
‘শ্রীমতী শোভা সেনের ছিল টালিগঞ্জে একটি বাড়ি যা তিনি চলচ্চিত্রে প্রাণপাত পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছিলেন। মিনার্ভা গ্রহণের প্রাথমিক ব্যয় বহন করার জন্যে তিনি অবলীলাক্রমে সে বাড়ি বন্ধক রেখে টাকা এনে দিলেন দলের কোষাগারে। স্মর্তব্য, কোনো নিশ্চয়তা ছিল না টাকা ফেরত পাবার, এবং ১৯৫৯ সালের শেষ দিনটি পর্যন্ত একের পর এক নাটক দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়েছিল।’ শোভা সেনের আত্মজীবনীর ভূমিকায় লিখেছিলেন উত্‌পল দত্ত। শোভা সেনের জন্ম ঢাকায়, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯২৩। নাট্য-পরিক্রমার শুরু গত শতকের চল্লিশের দশকে, ‘নবান্ন’ প্রযোজনার মাধ্যমে গণনাট্য সঙ্ঘে জড়িয়ে পড়ার পর। তার পরে লিটল থিয়েটার গ্রুপ, পিপলস লিটল থিয়েটারে অসংখ্য প্রযোজনায় অভিনয়। অভিনয় বহু চলচ্চিত্রেও। কিন্তু, নব্বই পেরোলেও, মননে এখনও সজীব শোভা।

শিল্পের দিকে-দিগন্তরে
অসমের গ্রাম থেকে সিলেট ও শিলঙ হয়ে কলকাতায় ঠাঁই নেন শিল্পশিক্ষার আকুতিতে। আগেই চিরকুমার বা চিররঞ্জন নাম পাল্টে হন খালেদ চৌধুরী। জীবিকার দৈনন্দিনতায় হাজারো বইয়ের প্রচ্ছদ-অলংকরণ, সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটারে গান, পোশাক, বাদ্যযন্ত্রের নব-উদ্ভাবনেও শামিল। শতেক নাটকে তৈরি হল তাঁর মঞ্চবিন্যাস। এরই অভিজ্ঞতায় লিখেছেন থিয়েটারে শিল্পভাবনা, স্মৃতির সরণি। ‘ফোক মিউজিক অ্যান্ড ফোকলোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পেয়েছেন নানা পুরস্কার, পদ্মভূষণ সম্মানও। এখন নার্সিংহোমের ঘেরাটোপে, তবু, ৯৪ বছরেও (জ. ১৯১৯) স্মৃতি অমলিন। সংগৃহীত গান আর বই দিয়েছেন লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্রে। এখান থেকেই পুনর্মুদ্রিত হল তাঁর লোকসংগীতের প্রাসঙ্গিকতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ। বঙ্গসংস্কৃতির বিস্তারী পথ আবিষ্ট অন্তরে ছুঁয়ে আছেন এই সৃজনশীল পথিক।

ভাষাও তাঁর মতোই ঋজু
এ শহরের স্কুলে ভর্তির কথায় ঠাকুরদা বলেছিলেন, ‘ওর বয়স এখনও ছ’বছর পূর্ণ হয়নি। কিন্তু এখনই ও সাঁতার কাটতে পারে, গাছে উঠতে পারে, একটা টাকা দিয়ে হাটে পাঠালে জিনিসপত্র কিনে তারপর বাড়িতে ফিরে বাকি-পয়সার হিসেব বুঝিয়ে দিতে পারে... শুভঙ্করের আর্যা আর খনার বচন মুখস্থ বলতে পারে... তা কলকাতার কোন ইস্কুল এই বয়সে এর চেয়ে ওকে বেশি শেখাতে পারত?’
পরে মত বদলায়, তার ফলেই ১৯৩০-এ কলকাতায় আসেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (জ. ১৯২৪)। সেই থেকে কলকাতার বাসিন্দা এই কবি, গদ্যকার, ভাষাবিদ। দীর্ঘদেহী, ঋজু মানুষটির গদ্যও সরস, ঋজু। কবিতার ক্লাস, কবিতার দিকে ও অন্যান্য রচনা, কবিতার কী ও কেন কবিতা-সমালোচনার বাঁক ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৭৪-এ পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। সদ্য নব্বইয়ে পড়লেন নীরেন্দ্রনাথ।

শিল্প-ঐতিহাসিক
বিশেষ করে এশিয়ার মূর্তি ও লিপিতত্ত্ব বিষয়ে বিশ্ব তাঁকে ‘জীবন্ত অভিধান’ বলে মানে। গৌরীশ্বর ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২৪-এ, মালদহে। সংস্কৃত নিয়ে স্নাতকোত্তর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০-এ, বিশেষ পত্র ছিল লিপিতত্ত্ব। ১৯৫৫-য় উটির ভারতীয় লিপিতত্ত্ব বিভাগে যোগ দেন সহকারী হয়ে, কাজ করেন দীনেশচন্দ্র সরকারের কাছে। পরে শুরু হয় চিত্রকলা চর্চা। তাই নিয়ে প্যারিস। সুইজারল্যান্ডের বাসেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি করে ১৯৬৮-তে যোগ দেন বার্লিনে মিউজিয়াম অব ইন্ডিয়ান আর্ট-এ। আগ্রহী হয়ে ওঠেন মূর্তিতত্ত্বে, চলতে থাকে ছবি আঁকা, লেখা ও ফ্রি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা। আজও পড়ান গ্রীষ্মকালীন পাঠক্রমে। প্রবন্ধ লিখেছেন দুশোটির মতো, কিছু গ্রন্থিত হয়েছে ঢাকা থেকে। হরিকেল লেখ-র ওপরেও বিশেষ কাজ করেছেন। তাঁর সম্মানে ভারত ও বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ পেয়েছে তিনটি মূল্যবান সংকলন। নব্বই ছুঁয়েও তরুণ, ছুটে বেড়াচ্ছেন প্রতি নিয়ত। সম্প্রতি এই শহরে, নানা ব্যস্ততায়। জানালেন, ইচ্ছে আছে মূর্তিতত্ত্ব নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই লেখার।

সিনেমায় নবতরঙ্গ
কোমরের হাড় ভেঙেছেন হালে, তাতেও গোমড়া-মুখে নেই, অপারেশনের পর মেতে উঠেছেন স্বভাবসিদ্ধ হিউমার-এ! নব্বই পেরোলেন এ-বছর, জন্ম ফরিদপুরে, ১৯২৩। কলকাতায় এসে কলেজে পড়ার সময় মন্বন্তর, দাঙ্গা, আজাদ হিন্দ সপ্তাহ, বন্দিমুক্তির মিছিল, শ্রমিক ধর্মঘট, রক্তপাত... শহরের রাজপথে কী নির্মম ঔদাসীন্য! তখন থেকেই চ্যাপলিন-ভক্ত মৃণাল সেন, এ বছরই লিখলেন নতুন বই মাই চ্যাপলিন।
নকশাল আন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থা অবধি তাঁর সাদাকালো ছবিতে দারিদ্র, শোষণ, গণতন্ত্রের বকলমে পুলিশ-প্রশাসন-সরকারের সন্ত্রাস। ভারতীয় ছবিতে তিনিই প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার। আশির দশক থেকে বাঙালি মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্বে আকীর্ণ, রুক্ষ, স্ববিরোধী জীবন ঠাঁই পেত তাঁর ছবিতে। ’৬৯-এ তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি ‘ভুবন সোম’ ভারতীয় সিনেমায় নবতরঙ্গ আন্দোলনের সূত্রপাত করে। আন্তর্জাতিক নানা সম্মান, পদ্মভূষণ-এর সঙ্গে পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে, সাংসদ-ও হয়েছেন। সত্যজিত্‌ রায় আর ঋত্বিক ঘটকের মতোই তিনি বাঙালির তিন শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারের অন্যতম।

‘অকাজেই উত্‌সাহ বেশি’
১৪ জানুয়ারি ৮৮ বছরে পা দেবেন হাজার চুরাশির মা (জ. ১৯২৬)। কিন্তু বয়স আর কবে দমাতে পারল তাঁকে? এখনও নিজেই ইনসুলিন ইঞ্জেকশন ফোটান। লেখার টেবিলে বসার পরমুহূর্তে কেউ পুরুলিয়া থেকে এসে হাজির। পাঁচটা গ্রামে টিউবওয়েল নেই, সরকারি দফতরে চিঠি লিখে দিতে হবে। কেউ বা বাঁকুড়া থেকে, গ্রামে কাজ পাননি, কয়েক দিন থাকা-খাওয়া এখানেই! এখনও মহাশ্বেতা দেবী সমান উত্‌সাহে জড়িয়ে পড়েন, ‘তোমরা যাকে কাজ বল, তার চেয়ে এই সব অকাজে আমার উত্‌সাহ বেশি।’ নইলে কী ভাবেই বা লেখা যেত ‘বিছন’ বা ‘স্তনদায়িনী’র মতো গল্প? কিংবা অরণ্যের অধিকার বা শ্রীশ্রীগণেশমহিমা-র মতো উপন্যাস? একদা শান্তিনিকেতনের ছাত্রীর এই সব লেখাই তো বাংলা ভাষার গণ্ডি বাড়িয়েছে।

বাংলাকে ভালবেসে
তাঁর জীবনের নয় দশকের তথ্যপঞ্জি কেউ যদি করতে বসেন, ফাদার পল দ্যতিয়েন তাঁকে মিষ্টি করে বকে দেবেন নিশ্চয়। কারণ সালতামামি, তথ্যপঞ্জি ইত্যাকার যাবতীয় পণ্ডিতি আলোচনায় তাঁর রুচি নেই, তিনি বরং অনেক অনেক বেশি আগ্রহী মানুষ সম্পর্কে সরস স্মৃতিতে। এই তো সে দিন, তাঁর যে সাম্প্রতিকতম বইটি প্রকাশিত হল, সেই আটপৌরে দিনপঞ্জি-র (আনন্দ) ভূমিকায় সাফ লিখছেন, ‘ডায়েরি বলুন, রোজনামচা বলুন, দিনপঞ্জি বলুন, স্মৃতিচিত্র বলুন, আমার এই যাবতীয় রম্যকাহিনি কল্পনামিশ্রিত আত্মকথা, উত্তমপুরুষে রচিত। এতে রমণীয়তা সাধনার্থে ঐতিহাসিকতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রচিত হয়নি।’ তা না হোক, বাংলা গদ্যের এই আশ্চর্য কবির জীবনচরিত খুঁজলে মিলবে বিচিত্র এক জীবনধারা। ১৯২৪-এর ৩০ ডিসেম্বর বেলজিয়ামের ছোট্ট শহর রশফর-এ জন্ম। এই জেসুইট সন্ন্যাসীর মাতৃভাষা ফরাসি। ধর্মীয় জীবন শুরু ১৯৪২-এ। ১৯৪৯-এ কলকাতায়। বাংলা ভাষা চর্চার শুরু কেরি সাহেবের শ্রীরামপুরেই। ক্রমে তা নিবিড় এক ভালবাসা। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক লিখতে শুরু করলেন ‘ডায়েরির ছেঁড়া পাতা’। প্রকাশমাত্রেই সেই ধ্বনিমধুর, রসময় গদ্য আর বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি গভীর প্রেম উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পায়। দীর্ঘ ব্যবধানে ২০০৭-এ আবার বাংলা ভাষায় লিখতে শুরু করেন। প্রকাশিত হয় গদ্যসংগ্রহ (আনন্দ), নতুন করে প্রকাশিত হয় তাঁর সম্পাদিত কেরির ইতিহাসমালা (গাঙচিল)। এখন থাকেন ব্রাসেলস-এ, তবে ফাদার এই মুহূর্তে কলকাতায়। আজ তাঁর ৯০তম জন্মদিনে বিদেশি ও আধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে একটি আলোচনাসভা সুকান্তপল্লির (কেওড়াপুকুর বাজার) মিলনবীথি সদনে, মিলন-মঞ্জিল-এর উদ্যোগে।

সব বিষয়েই ঘোর নাস্তিক
সমগ্র মানবজাতির পক্ষে মানুষের এই গর্ব প্রকাশের অধিকার রয়েছে যে, ইচ্ছা করা এবং সে ইচ্ছাকে কাজে পরিণত করার শক্তি ও স্বাধীনতা তার আছে।’ নিয়তিবাদ নিয়ে তাঁর পথপ্রবর্তক কাজ ‘নিয়তিবাদের স্বরূপ’-এ উচ্চারিত এই প্রজ্ঞাতেই সুকুমারী ভট্টাচার্য এই সময়ের অগ্রগণ্য চিন্তানুশীলক। জন্ম ১৯২১-এ। পিতামহ বিপিনবিহারী দত্ত আচারের অত্যাচারে শিশুবেলার এক খেলার সাথী-র মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেন। একাদশী বলে জ্বরাক্রান্ত বালবিধবাকে জল পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। আচারাশ্রয়ী ধর্মাচরণের নিষ্ঠুরতা তাঁকে ধর্মান্তরণে প্রণোদিত করে। প্রতিবাদী এই ধারাতেই গড়ে ওঠে সুকুমারী-র নাস্তিক্য। মা-বাবা শান্তিবালা ও সরসীকুমার গড়ে দেন শিক্ষার ভিত্তি। মানবকল্যাণে জ্ঞান চর্চার প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্টতর হয় স্বামী অমল ভট্টাচার্যর সাহচর্যে এবং সুনীতিকুমারের মতো শিক্ষকের প্রেরণায়। মুক্তচিন্তার অনুশীলনে তিনি তুলে ধরেছেন প্রাচীন ভারতের এক বাস্তব এবং সমকালের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক পাঠ। আলোকিত করেছেন বিশ্বের প্রাচীন সাহিত্যসম্ভারের নানা দিক। তুলেছেন বহু নতুন প্রশ্ন। সমাজ ও শ্রেণি, ক্ষুধা, যজ্ঞ, নিয়তি-র জটিলতা, ভারতে কৃষ্ণপ্রাথম্য-র প্রেক্ষাপট, ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ রাম-এর নানা অন্যায়ের মতো প্রসঙ্গের পাশাপাশি অনুসন্ধান করেছেন সংশয়বাদ, নাস্তিক্যবাদের মতো বিকল্প দার্শনিক ধারার শিকড়। ১৯৪৫-এ কর্মজীবন শুরু লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে তুলনামূলক সাহিত্য ও পরে সংস্কৃত বিভাগে। ১৯৮৬-তে অবসর। কিন্তু মন ও মস্তিষ্ক বিরানব্বই বছরেও অনেকটাই সচল। আজও প্রবন্ধ সংগ্রহ পরিমার্জন ও সংশোধন করছেন (গাঙচিল থেকে তিনটি খণ্ড প্রকাশিত, চতুর্থটি অপেক্ষায়)। কাজ করে দিচ্ছেন ফেটালিজম ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া-র নতুন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস সংস্করণের। ধর্ম বা দৈব বিষয়েই শুধু নন, অকর্মণ্যতার ব্যাপারেও তিনি ঘোর নাস্তিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE