Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
মুম্বই-ভাদোদারা ৩৯২ কিলেমিটার

ভাদোদারা— কথা বলে ইতিহাস

সুযোগ পেলেই কত দূর দূর ঘুরতে চলে যাই। অথচ ঘরের কাছে যে কত বিস্ময় অপেক্ষা করে থাকে আমাদের জন্য তার খবর কে রাখে? কেন বললুম এ কথা? কারণ, অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে মুম্বই থেকে একরাতের রেলযাত্রায় ঘুরে আসি গুজরাতের ভাদোদারা থেকে। কত আর দূরত্ব মুম্বই থেকে? রেল পথে ৩৯২ কিলোমিটার। যাব যাব করে যাওয়া হয়ে ওঠে না। অগস্টেই এসেছিল সে সুযোগ। ভাদোদারার বাঙালিদের এক সংগঠন মাতৃভাষা প্রসার সমিতির অনুষ্ঠানে গিয়ে পড়েছিলুম শহরটায়। লিখছেন পারমিতা মুখোপাধ্যায়রাত এগারোটা চল্লিশে ভাদোদারা এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। চড়ে বসা তো নয়, বলা ভাল, ট্রেনে উঠেই শুয়ে পড়লাম। ভোর ছটায় ট্রেন থামল ভাদোদারা স্টেশনে। যেখানে থাকব ঠিক হয়েছিল সেই জায়গাটির ঠিকানা বলে উঠে পড়লাম অটোয়। দেখতে দেখতে চললাম চারপাশ। চওড়া রাস্তাঘাট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর সবথেকে বড় যেটি চোখে পড়ল সেটি হল প্রকৃতি সংরক্ষণ। যেদিকে চোখ যায় সবুজের আলপনা শহর জুড়ে।

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

রাত এগারোটা চল্লিশে ভাদোদারা এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। চড়ে বসা তো নয়, বলা ভাল, ট্রেনে উঠেই শুয়ে পড়লাম। ভোর ছটায় ট্রেন থামল ভাদোদারা স্টেশনে। যেখানে থাকব ঠিক হয়েছিল সেই জায়গাটির ঠিকানা বলে উঠে পড়লাম অটোয়। দেখতে দেখতে চললাম চারপাশ। চওড়া রাস্তাঘাট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর সবথেকে বড় যেটি চোখে পড়ল সেটি হল প্রকৃতি সংরক্ষণ। যেদিকে চোখ যায় সবুজের আলপনা শহর জুড়ে। হতে পারে হয়তো বর্ষাকাল বলে সবুজের আধিক্য। তবে আমাদের গন্তব্যে যখন পৌঁছে দিল অটো, তখন মনে হল এ কোথায় এলাম। এত সবুজ, এত সবুজ, এত সবুজ! কত রঙবেরঙের পাখি। আর কি আশ্চর্য একইসঙ্গে শুনতে পাচ্ছি কোকিল আর ময়ূরের ডাক। এ যে অদ্ভূত সমাপতন! বর্ষা আর বসন্ত একই সাথে! গেস্ট হাউসে মালপত্র রাখা আর একটু বিশ্রাম নেওয়ার অবসরে আসুন ভাদোদারা শহরটার বিবরণ দিয়ে দেওয়া যাক।
ভাদোদারা, যে শহরের পূর্ব পরিচিতি বরোদা হিসেবে, সেটি গুজরাতের তৃতীয় বৃহত্তম শহর আহমেদাবাদ এবং সুরাতের পরেই। এটি ভাদোদারা জেলার সদর শহর। এর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বিশ্বামিত্রি নদী। রেলপথ এবং সড়কপথে ভাদোদারা যুক্ত হয়েছে দিল্লী এবং মুম্বইয়ের সাথে। ভারতের প্রথম দশটি উন্নয়নশীল শহরের মধ্যে বরোদা অন্যতম। বরোদার মহারাজা তৃতীয় সয়াজীরাও গায়কোয়াড়ের সময় থেকেই বরোদা শিল্পকলায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বর্তমানে এটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প, সংস্কৃতি এবং শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল। অনেক বড় বড় শিল্প যেমন – পেট্রোকেমিক্যাল, ইঞ্জিনীয়ারিং, কেমিক্যাল, প্লাস্টিক প্রভৃতি রয়েছে এখানে। বরোদার প্রাথমিক ইতিহাস সম্বন্ধে জানা যায় যে এই অঞ্চলে ৮১২ খ্রীস্টাব্দে বণিক শ্রেণীর লোকেজন বসবাস করতে শুরু করে। সেই সময় অঞ্চলটি হিন্দু রাজাদের অধীন ছিল এবং ১২৯৭ সাল অবধি এই অঞ্চলে পর পর রাজত্ব করেছে গুপ্ত, চালুক্য এবং সোলাংকি রাজারা। তারপর দিল্লীতে সুলতানী আমল শুরু হয়, তখন শাসনভার চলে যায় সুলতানদের হাতে। এরপর দিল্লীতে মুঘল পর্ব শুরু হলে এই অঞ্চলের শাসন নিয়ে মুঘলদের বেগ পেতে হয় কারণ, সে সময় মারাঠারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে ও এই অঞ্চলের দখল নেয়। তৃতীয় সয়াজীরাও গায়কোয়াড়ের আমলে – যিনি ১৮৭৫ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন – তাঁর সময় শাসন সংক্রান্ত প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় এখানে। বৃটীশের প্রতিপত্তি সত্ত্বেও বরোদা প্রিন্সলী স্টেট হিসেবে পরিগণিত হয় এবং স্বাধীনতার পর অন্যান্য প্রিন্সলী স্টেটের মত বরোদাও ১৯৪৭ এ ডোমিনিয়ন অফ ইণ্ডিয়া তে যোগ দেয়।

সয়াজীরাও গায়কোয়াড়ের কথা যখন উঠল, তখন আর একটা কথাও নাবলে পারছি না। বরোদার মহারাজা সয়াজীরাও গায়কোয়াড় একসময় ইংল্যাণ্ডে শিক্ষাগ্রহণ করতে যান এবং ইংল্যাণ্ডে পাঠরত কালীন তাঁর সঙ্গে শ্রী অরবিন্দ ঘোষের সাক্ষাৎ হয়। হ্যাঁ, বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ ঘোষ - মাত্র সাত বছর বয়সেই তাঁর পিতা ডাক্তার কৃষ্ণধন ঘোষের সঙ্গে তিনি ইংল্যাণ্ড পাড়ি দেন এবং তাঁর ছাত্রজীবন ইংল্যাণ্ডেই অতিবাহিত হয়। পিতা কৃষ্ণধন শ্রী অরবিন্দকে পাকা সাহেব তৈরি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিধাতার কি অভিপ্রায়! শ্রী অরবিন্দ হয়ে উঠলেন খাঁটি দেশপ্রমিক, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও। ইংল্যাণ্ডে বরোদার মহারাজার সঙ্গে শ্রী অরবিন্দের আলাপ ক্রমশঃ গভীর সখ্যতায় পরিণত হল। অরবিন্দ বরোদার মহারাজা সয়াজীরাও গায়কোয়াড়ের শিক্ষক ও প্রাইভেট সেক্রেটারি নিযুক্ত হলেন। ১৮৯৩ সালে বরোদার মহারাজার সঙ্গে একত্রে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। চোদ্দো বছর পর দেশে ফিরে তিনি বরোদাতেই রইলেন, তখনও তিনি গায়কোয়াড়ের প্রাইভেট সেক্রেটারি। এই বরোদাতেই সিস্টার নিবেদিতার সংস্পর্শে আসেন শ্রী অরবিন্দ। তাঁদের সাক্ষাৎকার ভারতীয় বিপ্লবের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বরোদার মহারাজার সংগে শ্রী অরবিন্দের ঘনিষ্ঠতা নিঃসন্দেহে আমাদের বঙ্গসন্তানদের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সমৃদ্ধ ঘটনা।

বরোদা অর্থাৎ অধুনা ভাদোদারাও যে বাংলা ও বাঙালির কৃষ্টির কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠবে এতে আর সন্দেহের অবকাশ কোথায়! ইতিহাসের পাতা থেকে এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক বরোদার বর্তমান বাঙালি সমাজের দিকে। বরোদার জীবনযাত্রা মুম্বইয়ের মত এমন দ্রুত ধাবমান নয়।

এই সুন্দর সুপরিকল্পিত শহরটায় বেশিরভাগ মানুষের বসবাস তাদের কর্মস্থলের কাছাকাছি। কাজেই অফিসের কাজকর্ম মিটিয়ে হয়তো তাঁরা একটু সময় বের করতে পারেন মনের রসদ সংগ্রহ করার কাজে। তাই গানবাজনা, নাটক, চারুকলা ইত্যাদি চর্চায় অতিবাহিত হয় কিছু সময়। তাঁরা পিছিয়ে নেই মাতৃভাষা প্রসার বা চর্চার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজেও। আমরা যারা পরবাসে আমাদের জীবন অতিবাহিত করছি – জানি যে, পরবাসে মাতৃভাষাকে সংরক্ষণ করা কি দুরূহ কাজ। প্রবাসে আমাদের চারপাশে অনবরত অন্য ভাষার ভিড়ে মাতৃভাষা ক্রমশঃ কোণঠাসা হয়ে যেতে থাকে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের অবস্থা তো তথৈবচ। তারা ছোট্ট থেকেই ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেই বেড়ে উঠতে থাকে। ফলে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক মিশ্র সংস্কৃতি। মাতৃভাষার প্রতি গড়ে ওঠে না কোনও মমত্ববোধ। অথচ মাতৃভাষা বিশ্বের সকল মানুষের কাছে অপরিহার্য নিজেকে প্রকাশ করার জন্য। যে ভাষা আমার একান্ত নিজের সেই ভাষাকে দূরে সরিয়ে রাখার অর্থ নিজেকেই নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া। মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে মানুষের সাহিত্য সংস্কৃতির ভিত্তি – তার চিরাচরিত ঐতিহ্য, শিল্পকলা, পঠন-পাঠন, আচার ব্যবহার সবকিছুর ওপরেই প্রভাব বিস্তার করে এই মাতৃভাষা। অথচ আমরা যারা নিজভূম ছেড়ে পরবাসী তাদের জীবনে মাতৃভাষাও যেন নির্বাসনে। অনেককে তো বলতে শুনি তারা না কি মাতৃভাষা (বাংলা) লিখতেও বোধহয় ভুলে গেছে! এ কথা যারা বলে তারা সগর্বে তা ঘোষণা করলেও এ যে কত বড় লজ্জার তা মাতৃভাষাপ্রেমী মাত্রেই বুঝবেন! আবার অনেক বঙ্গসন্তানকে নিখাদ নির্ভেজাল বাঙালি আড্ডার মজলিশেও ইংরেজি বাক্যের ফুলঝুরি ফোটাতে দেখেছি! হতে পারে হয়তো তাঁরা বিদেশি ভাষার বাক্যস্ফূরণেই বেশি আনন্দ পান! তা বলে মাতৃভাষাকে কেন ব্রাত্য করে রাখেন তা তো বোধগম্য হয় না।

তা সে যাই হোক, বরোদা বা ভাদোদারার বাঙালিরা মাতৃভাষা প্রসারে যথেষ্ট আগ্রহী এবং পুরোদমে সে কাজ শুরুও করে দিয়েছেন। গত বছর নভেম্বরে এ নিয়ে আলাপ আলোচনার পর এই বছর ১২ই জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিবসে ‘মাতৃভাষা প্রসার সমিতি’র উদ্বোধন হয়। সমিতির চেয়ারম্যান প্রবীণ ব্যক্তি শ্রী অশোক গুপ্ত মাতৃভাষা প্রসারের কাজে একনিষ্ঠ কর্মী। শুধু বাংলা নয়, গুজরাতি এবং হিন্দি ভাষা শেখানোর কাজও এঁরা শুরু করেছেন। শেখার ব্যাপারে কোন বয়ঃসীমা নেই। একটি নির্দিষ্ট পাঠক্রম অনুসারে ভাষাশিক্ষা দেওয়া হয়। আয়োজন করা হয় সেমিনার বা ওয়ার্কশপের। ভাদোদারার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে উৎসাহী ও ইচ্ছুক ব্যক্তিদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পত্র পত্রিকা প্রকাশ ইত্যাদি কর্মসূচিও গ্রহণ করবেন তাঁরা। পথচলা যখন শুরু হয়েছে তখন গন্তব্যে কোনও না কোনও সময় নিশ্চই পৌঁছনো যাবে। বর্তমানে মাতৃভাষা প্রসার সমিতির শিক্ষার্থীর সংখ্যা চৌষট্টি। বাংলা, গুজরাতি এবং হিন্দি এই তিনটি শাখায় শিক্ষকের সংখ্যা আট। এই সংস্থার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা হল অন্য রাজ্যেও মাতৃভাষা প্রসারের কাজে আত্মনিয়োগ করা এবং এ ব্যাপারে তাঁরা আশাবাদী যে, অন্যান্য রাজ্যেও বসবাসকারী বাঙালিরা নিশ্চই তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। ভাদোদারার ‘মাতৃভাষা প্রসার সমিতি’র চলার পথ সুগম হোক এই আমাদের প্রার্থনা।

আসুন সুধিজন, এবার ভাদোদারা শহরটা একটু ঘুরে দেখা যাক। আমাদের হাতে সময় ছিল খুবই কম। তার ওপর সঙ্গে ছিল আমার খুদে দামাল পুত্র। কাজেই তার মেজাজ-মর্জি মাথায় রেখেই ঘোরাঘুরি। নীরস আলোচনা বা সভা সমিতি যে তার ভাল লাগবে না তা বলাই বাহুল্য। তবে অবশ্য মাতৃভাষা প্রসার সমিতির ছোটদের অনুষ্ঠান তিনি বেশ উপভোগ করেছেন আর আনন্দ পেয়েছেন টয়ট্রেনে সওয়ার হয়ে আর চিড়িয়াখানা দেখে। শুনে আপনাদেরও নিশ্চই ইচ্ছে করছে, নিজেদের ঘরের খুদেগুলোকে নিয়ে একবার ঘুরে আসেন বরোদায়। শহরের মধ্যে সয়াজী বাগ এক বিশাল বড় উদ্যান যার মধ্যে রয়েছে চিড়িয়াখানা, টয়ট্রেণ এবং চিত্র সংগ্রহশালা। টয়ট্রেনটি তো ভারী চমৎকার। ছোট্ট স্টেশনটির নাম স্বামী বিবেকানন্দ স্টেশন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি স্বামীজীও কিন্তু পরিব্রাজক হয়ে বরোদায় এসেছিলেন। সেই হিসেবে বরোদা মহাপুরুষদের পদধূলিধন্য পুণ্যভূমি। যাই হোক, যা বলছিলাম। টয়ট্রেনটি ছোটদের তো বটেই, বড়দেরও মনোরঞ্জন করবে। সয়াজীবাগকে গোল হয়ে ঘুরে আসে ট্রেনটি। কত রকমের গাছ গাছালিতে ভর্তি এই উদ্যান। সত্যি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ট্রেন থেকে নেমে চিড়িয়াখানা দেখার পালা। যদিও টয়ট্রেনটি কিছুটা চিড়িয়াখানার মধ্য দিয়েই যায় তবু ছোটদের মন রাখতে আপনাদের আবার চিড়িয়াখানায় ঢুকতেই হবে। তবে চিড়িয়াখানায় ঘুরলে আপনারা নিরাশ হবেন না। নানা দেশের নানা প্রজাতির পাখি দেখতে দেখতেই অনেক সময় চলে যাবে। এছাড়াও কুমির, নানা প্রজাতির হরিণ, নীলগাই, লেপার্ড, চিতা, বাঘ, সিংহ প্রভৃতি বন্যপ্রাণীও রয়েছে। সবথেকে ভাল লাগবে ছোটদের। টেলিভিশনের এ্যানিমাল প্ল্যানেটের লেপার্ড, বাঘ, সিংহকে একেবারে জীবন্ত অবস্থায় চোখের সামনে দেখা তো আর মুখের কথা নয়! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবে ওরা একেবারে। বাঘ দেখার উৎসাহেই দেখবেন দেড় দু কিলোমিটার পথ হেঁটে ফেলছে ওরা। আর একটা কথা আপনাদের বলি, এই চিড়িয়াখানাতেই দেখলাম ময়ূরের পেখম মেলার অনবদ্য দৃশ্য। তাও আবার দুধের মত সাদা ময়ূর। কিন্তু এই চিড়িয়াখানা দেখতে গিয়ে দেখা হল না সংগ্রহশালাটি। এটি দেখা আমার আবশ্যক ছিল। কি আর করা ছোটদের কাছে মাঝে মাঝে নতি স্বীকার তো করতেই হয়। এটা না হয় পরের বারের জন্য তোলা রইল।

তবে হ্যাঁ, যেদিন সয়াজী বাগ দেখেছি তার আগের দিন দেখে নিয়েছিলাম আর একটি সংগ্রহশালা এবং রাজপ্রাসাদ। এইবার আসছি সে কথায়। লক্ষ্মী বিলাস প্যালেস বরোদা শহরের এক বিশেষ আকর্ষণ। এই বিশাল প্রাসাদটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল বারো বছর। মহারাজা তৃতীয় সয়াজীরাও গায়কোয়াড়ের রাজত্বকালে এই নির্মাণ শুরু হয়। ১৮৯০ সালে শেষে হয় এর নির্মাণ কাজ। এই প্রাসাদের প্রধান স্থপতি ছিলেন মেজর চার্লস মন্ট। এর পূর্বে রাজাদের বাসস্থান ছিল নজরবাগ প্যালেস। লক্ষ্মী বিলাস প্যালেস নির্মাণে চার্লস মন্ট ভারতীয় ও পাশ্চাত্য স্থাপত্যশৈলীর মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। এই প্রাসাদ লণ্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের চারগুণ এবং সবথেকে বড় বাসস্থান হিসেবে পরিগণিত হয়। ইন্দো সারাসেনিক পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে প্রাসাদ নির্মাণে। ভারতীয় রীতি অনুসারে প্রাসাদ নির্মাণে যে রীতি অনুসরণ করা হয় তাতে তিনটি ভাগ থাকে। একটি জনগণের জন্য দরবার সভা, দ্বিতীয়টি মহারাজার নিজস্ব বসবাসের স্থান এবং তৃতীয়টি মহিলাদের অন্দরমহল। কিন্তু চার্লস মন্ট এই রীতি কম বেশি মেনেও আরো অনেক সংযোজন করেছিলেন প্রাসাদে। যেমন – ডাইনিং হল, বিলিয়ার্ড রুম, বিশিষ্ট ইউরোপিয়ান অতিথিদের জন্য অতিথিশালা প্রভৃতি। তবে প্রাসাদের স্থাপত্যে ইউরোপিয়ান রীতির সঙ্গে ভারতীয় শিল্পকলাও সুন্দরভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই প্রাসাদটি এত মনোগ্রাহী।

এই বছর প্রাসাদটির একশো পঁচিশ বছর পূর্তি। প্রাসাদে প্রবেশের সময় প্রাসাদের গায়ে চোখে পড়ে একটি দেওয়ালচিত্র। আশ্চর্য, একশো পঁচিশ বছর ধরে চিত্রটি অমলিন রয়ে গেছে। প্রাসাদে প্রবেশের পর অডিও ডিভাইস দিয়ে দেওয়া হয়। একতলার যে কটি ঘর দর্শকদের দেখার জন্য উন্মুক্ত সেই ঘরে রক্ষিত সমস্ত জিনিসের বিবরণ পাওয়া যায় ঐ অডিও ডিভাইস থেকে। এছাড়াও প্রাসাদের ইতিহাস সম্পর্কেও সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। ফিরে আসার সময়ে ঐ অডিও ডিভাইস ফেরত দিয়ে দিতে হয়। প্রাসাদের সামনে সবুজ মনোরম সবুজ চোখ জুড়িয়ে দেয়। সেই সবুজ মখমলে ময়ূরের আনাগোনা। থেকে থেকে ভেসে আসে ময়ূরের কেকাধ্বনি।

প্রাসাদ দেখার পর চলে যাই ফতেসিং মিউজিয়াম দেখতে। এখানে রাখা আছে গায়কোয়াড় রাজবংশের অনেকের চিত্র। রাজা রবি বর্মা এবং অনেক ইউরোপীয় শিল্পীর চিত্রশৈলী মনকে মুগ্ধ করে। মনে হয় শিল্পীরাই সার্থক। তাঁরা অমর হয়ে আছেন তাঁদের শিল্পসৃষ্টির মাধ্যমে।

এখানে একটা কথা উল্লেখ করি। মহারাজা সয়াজীরাও গায়কোয়াড় যিনি ১৮৭৫ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন এবং যাঁর আমলে বরোদা শিল্প সমৃদ্ধিতে ও শাসন ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে – সেই সয়াজীরাও ছিলেন মহারাজা খাণ্ডেরাও গায়কোয়াড়ের বিধবা পত্নী মহারাণী যমনাবাঈ এর দত্তক সন্তান। ১৮৬৩ সালে তাঁর জন্ম। তাঁর পূর্বের নাম ছিল গোপালরাও। ১৮৭৫ সালে মহারাণী তাকে দত্তক নেওয়ার আগে জিগ্যেস করেছিলেন, ‘তুমি জানো তোমাকে এখানে কিজন্য নিয়ে আসা হয়েছে?’ গোপালরাও উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেন, অবশ্যই মহারাজা হওয়ার জন্য’। মর্নিং শোজ দ্য ডে। সত্যিই গোপালরাও এরপর সয়াজীরাও নামে বরোদার রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত হন। একশোবাইশটি গানফায়ার দিয়ে শুরু হয় অভিষেক অনুষ্ঠান। মিঠাই বিতরণ করা হয় সকলকে, দরিদ্রদের ভোজন করানো হয়। তাঁর বহু পদবীর মধ্যে প্রথমটি ছিল, ‘হিজ হাইনেস মহারাজা সয়াজীরাও গায়কোয়াড়, সেনা খাস খেল, শামশের বাহাদুর’।

মহারাজার স্মৃতিধন্য বরোদা – আজকের ভাদোদারা – আজ বিদায়। আবার কখনো সুযোগ পেলে চলে যাব তোমার কাছে ইতিহাসের পাতা ওলটাতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE