Advertisement
E-Paper

মহাকাব্যিক

‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদলের নাটক ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’। দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় ঞ্চ নয়, যেন কোনও সকার লিগের গ্যালারি! সারাক্ষণ ধরে যেন ‘মেক্সিকান ওয়েভ’ উঠল, নামল। নামল, উঠল।গানের চলনে, সংলাপের গড়নে, শরীরের ভাঙাগড়ায় তরঙ্গায়িত জ্যামিতিক আকারে!আর সেই তরঙ্গের গায়ে কখনও ছবি, কখনও ছায়া হয়ে ফুটে উঠল এক মরা গাঁয়ের গল্প!

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
Pic-নাটকে তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস, কৌশিক কর, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়

Pic-নাটকে তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস, কৌশিক কর, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়

মঞ্চ নয়, যেন কোনও সকার লিগের গ্যালারি!

সারাক্ষণ ধরে যেন ‘মেক্সিকান ওয়েভ’ উঠল, নামল। নামল, উঠল।

গানের চলনে, সংলাপের গড়নে, শরীরের ভাঙাগড়ায় তরঙ্গায়িত জ্যামিতিক আকারে!

আর সেই তরঙ্গের গায়ে কখনও ছবি, কখনও ছায়া হয়ে ফুটে উঠল এক মরা গাঁয়ের গল্প!

বড় উস্তাদের ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর যেমন মন বুঁদ করে, দড় কয়্যারের মিলিত স্বর যেমন শরীরে দোলা লাগায়, মেঠো পালার মিঠে সুর যেমন উচাটন আনে— প্রায় আড়াই দু’ঘণ্টার আসরে সৌমিত্র মিত্রর ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদলের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ এই সব ক’টি রাগ-অনুরাগকে একই তারে বেঁধে দিয়ে গেল।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসটি যাঁরা পড়েছেন, নিদেন তপন সিংহের ছবিটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের আর ধরিয়ে দিতে লাগে না এ কাহিনি বাঁশবাদী আর জাঙল গাঁয়ের গল্প। কোপাই নদীর পারের গল্প।

বাঁশবাদী ছোট গাঁ। যেখানে থাকে কাহার উপজাতির ক’ঘর। জাঙলে থাকে কুমার সদগোপ। গন্ধবণিক। নাপিত। তন্তুবায়। জাঙলের সীমানা বড়। সে-সীমানায় রয়ে গেছে নীলকরদের রক্ততিলক। তাদের পতিত জমি।

জঙ্গলে বাঘ ডাকে। লাঠি, বর্শা নিয়ে শিকারে নামে কাহারের দল। সাপ মারে। ভালুক তাড়ায়। বুনো শুয়োর ভাগায়। আবার রুখাসুখা জমিনে চাষেও খাটে। তাদের মুনিবে ঠকায়, জমিদারে চড়ায়। সেই নীল সাহেবের মতোই। তার মধ্যেই হাভাতে মানুষগুলোর জীবন গড়ায়। সাঙা হয়। পরব আসে। পরব যায়। পিরিতে রং ধরে। তাতে সুখ যত না, অসুখ ঢের। এ জীবন থেকে বেরিয়ে করালী (কৌশিক কর) বেছে নেয় চন্ননপুরের কুলিকামিনের কাজ। তাতে দোসর বানাতে চায় গাঁ-ঘরের কাহারদের। মাতব্বর বনোয়ারির কাছে তা অধম্ম। কাহার-জ্যেষ্ঠা বুড়ি সুচাঁদের কাছে তা গাঁয়ের দেবতা ‘কর্তাবাবা’-কে অমান্যি করা।

লেগে যায় করালী আর বনোয়ারিতে।

একের পর এক দৃশ্য। মহাকাব্যিক কাহিনিতে যেমন চোরাস্রোতের মতো এক কাহিনির আড়ালে আরেক কাহিনির ভ্রূণ আসে, অনেকটা তেমনই। তাকে জড়িয়েই জন্ম নেয় ছবি।

একের পর এক ছবি!

কখনও ভয়াল তার রূপ। তো কখনও সোহাগের। কখনওবা আবার রাগের। ক্ষোভের। অভিমানের। যন্ত্রণার।

প্লোহি, প্লোহি পালকি যায়। লাঠালাঠি যুদ্ধ বাঁধে। পরবের গান আসে। হাতে হাতে কোঠা বাড়ি গড়ে। সে বাড়ি ভাঙাও পড়ে।

একেকটা দৃশ্য শরীরে কামড় বসায়।

কিছুতেই ভোলার নয়, ভেগে যাওয়া বউ পাখিকে (তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস) হারিয়ে হাঁপানি রুগি নয়ানের (বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়) লাঠি হাতে দমফাটা ঘড়ঘড়ে আর্তস্বর।

মেয়ে সেজে এ-পাড়া ও-পাড়া চষে বেড়ানো নসুবালার (গম্ভীরা ভট্টাচার্য) শরীরী বিভঙ্গ। আলাপের চলন।

তাগড়াই শরীরটা নিয়ে চড়কের মানতে বনোয়ারির ভেসে (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়) ওঠা। এক দিকে দানবের মতো তার ছারখার করার চেষ্টা। আবার অন্য দিকে, প্রেমের জোয়ারে ভাসান দেওয়াও।

ভোলার নয়, পাটের শনের মতো চুল, ন্যুব্জ শরীর নিয়ে, লাঠি হাতে, সাদা থান পরা সুচাঁদের (সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত) কখনও বিলাপ, কখনও নাচ। কখনও মহাকালের মতো তার অনাচারের জানান দেওয়া।

ভোলার নয়, শান্ত সমাহিত ভবঘুরে পাগলদাদার (উত্তম চট্টোপাধ্যায়) দমকা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া উদাস করা গান।

গাছতলায় পিদিমের আলোয় পরপুরুষের ঠোঁটে কালো বউয়ের (অঙ্কিতা মাঝি) লীন হওয়া। তার আদুরেপনা, তার খুনসুটি।

ভোলার নয়, বউয়ের কাটা মুণ্ড হাতে পরমের (সমীরণ) জিঘাংসা।

ভোলার নয়, হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো গাঁ-ঘরের লোকগুলোকে করালীর ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়া।

এমন অসংখ্য দৃশ্য। ভোলার নয় কত কিছুই! পাকা তাসুড়ের আসরে যেমন পিঠোপিঠি তাস আছড়ে পড়ে, অনেকটা তেমন করে এ-নাটকে দৃশ্য নামে।

অথচ কোথাও কোনও এলোপাথাড়ি ধাক্কা নেই। জলতরঙ্গের মতো নিরবচ্ছিন্ন বেজে যাওয়া শুধু। ভেসে যাওয়া শুধু। পাগলা ঝোরার মতো নয়, পাহাড়-ঢালে তির তির করে নামতে থাকা ঝর্না ধারার মতো।

শিরিঙ্গি শিরিঙ্গি ঢ্যাঙা ঢ্যাঙা কতগুলো পাতা খসা গাছ, এক পাশে কচি বাঁশের বেড়া, পিছন দিকে আড়া পাটাতন, একটা ধোঁয়াশা জাল। ব্যস, সেট বলতে এইটুকুই। তার ওপর মিঠে আলোর (সুদীপ সান্যাল) খেলা মায়া ধরায়।

রিয়্যালিটির নামগন্ধ নেই।

তাও যে কী জাঁক নিয়ে রাজ করল মঞ্চ আর আলোর জাদু (মঞ্চ পৃথ্বীশ রাণা)!

তরুণ পরিচালক কৌশিক করের নিঃসন্দেহে এ যাবৎ এটিই শ্রেষ্ঠ কাজ।

এ-নাটকে কৌশিকের অজান্তে কিনা জানা নেই, অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। তাঁর চার পূর্বসুরির ছায়া যেন তাঁকে অলক্ষ্যে আগল দিয়ে বেড়ালো।— নাটকের সংলাপ বুননে ব্রাত্য বসু-সুলভ নিপুণতার ঝলক, ছিটকে যাওয়া অভিনয়ে গৌতম হালদারীয় ভাঙাচোরার ঝাঁঝ, মঞ্চভাবনায় দেবেশ চট্টোপাধ্যায়-টাইপ বিমূর্ততার ঘরানা, আর কাহিনি বুননে কৌশিক সেনের রাজনৈতিক বীক্ষার মিশেল দেওয়ার ঝোঁক। এই চার ধারা এত সূক্ষ্মভাবে মিশেছে যে, সব মিলিয়ে ‘হাঁসুলী...’ তীক্ষ্ণ ফলার চেহারা নিয়েছে।

তার সঙ্গে বারবার কোথায় যেন সুরে বেজেছে বাদল সরকারের তৃতীয় ধারা নাটকের সুর। যার চলনে কাপড়ের এক টুকরো ফালি হয়ে গেছে কুকুর, এক খানা রজ্জুই বুঝিয়ে দেয় ওটা সাপ, লাঠি-মানুষে খাড়া হয়ে গড়ে দেয় বাড়ি।

তপন সিংহের ছায়াছবিটি যাঁদের আজও ধাওয়া করে, তাঁদের বলি, এই ‘হাঁসুলী...’ একবারে কাহিনির রসায়ন থেকেই অন্য খাতে বওয়া।

তপনবাবুর করালী যেমন। সে যেন শিল্পের স্বপ্ন দেখায়। লাঙল ফেলে নতুন জীবনের গদ্য চেনায়।

এই করালী কিন্তু পুরোপুরি বেনিয়া। কখনও মনে হয় তাকে দালাল গোছের। গাঁ থেকে লোকগুলো উঠিয়ে নিয়ে চন্ননপুরে জুতে দিলেই যার ষোলো কলা পূর্ণ। চেহারায়, স্বভাবে, কায়দায়, কানুনে সে আলাদা। হঠাৎ বিজাতীয় রঙঢঙ রপ্ত করে চটকাদারি রাংতার মতো চকচকে হয়ে সে গাঁ-ঘরে গান, নাচ, গন্ধ বদলে দিতে চায়।

এখানে পরিচালক উপন্যাসের বাইরে গিয়ে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার অনুষঙ্গটি জুড়ে এক কথায় অনবদ্য ‘টাচ’ দিয়েছেন। তাতে কাহিনিতে গোটা বিশ্ব জুড়ে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের চেহারাটা ধরা পড়েছে।

গোটা পালাটি গড়িয়েছে সাদা আর কালোয়। পোশাক (মালবিকা মিত্র) থেকে গাছগাছালি, কোত্থাও এক টুকরো রং নেই।

এই অদ্ভুত ভাবনার মধ্যে যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে দুটো বিপরীত বিশ্ব। যার একটির রং কালো। অন্যটি সাদা।

রং আসে যখন সাঙা হয়, পরব হয়...! লাল রং! সে কি স্বপ্লের? নাকি চাপানো জীবনের অন্তঃক্ষরণের? নাকি, হাজারো মিথ্যে দিয়ে মোহাচ্ছন্ন করে দেওয়া ভয়ঙ্কর এক উৎসবের, উল্লাসের পরে ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত হয়ে যাওয়া জীবনের?

ধামসা, ঢাক, ঢোল, খোল, বেহালা, কাঁসর, ঘণ্টা নিয়ে মঞ্চের ঠিক বাইরে দর্শক-আসনের পাশেই লাইভ মিউজিক নিয়ে বসেন সঙ্গীতকার অভিজিৎ আচার্য।

শরীরের, মনের গমক ধরাতে এই আয়োজনটা বড় প্রয়োজন ছিল।

তবে বাজনদার যখন সংলাপ বলেন, কোথায় যেন তাঁর ‘পিচ’টা মঞ্চের থেকে একটু হলেও আলাদা হয়ে বাজে। এই মহাকাব্যিক আয়োজনে ওটুকুই যা খাদ!

বাকিটা? শুরুর থেকেই সেই যে দোলা লাগায় মনে, শরীরে, কিছুতেই যেন থামতে চায় না!

নাগাড়ে ‘মেক্সিকান ওয়েভ’-এ থাকলে কি এমনটাই হয়?

epic drama
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy