Advertisement
E-Paper

মাথায় ভারী বই নিয়ে হাঁটতাম

পরামর্শ দিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তাই। বললেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। সামনে দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ছোটবেলায় ভাবতেন ফুটবলার হবেন। বেকহ্যাম, বেবেতো, রোনাল্ডো মাথায় গিজগিজ করত। সানি দেওলের ‘বর্ডার’ দেখে ভেবে বসে ছিলেন জওয়ান না হলে জীবন বৃথা। কোনওটাই হননি। বদলে তিনি এখন বাংলা মঞ্চের উঠতি অভিনেতাদের তালিকায় পয়লা নম্বর। অনির্বাণ ভট্টাচার্য।

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৫ ০০:০৩
ছবি: সুব্রতকুমার মণ্ডল।

ছবি: সুব্রতকুমার মণ্ডল।

ছোটবেলায় ভাবতেন ফুটবলার হবেন। বেকহ্যাম, বেবেতো, রোনাল্ডো মাথায় গিজগিজ করত।

সানি দেওলের ‘বর্ডার’ দেখে ভেবে বসে ছিলেন জওয়ান না হলে জীবন বৃথা।

কোনওটাই হননি। বদলে তিনি এখন বাংলা মঞ্চের উঠতি অভিনেতাদের তালিকায় পয়লা নম্বর।

অনির্বাণ ভট্টাচার্য।

রাহুল দ্রাবিড়ের পর কে?

চেতেশ্বর পুজারা, না অজিঙ্কে রাহানে?

বাইশ গজে ভারতীয় দলের মতোই, বাংলা থিয়েটারেও এমনই একটি সওয়াল ইদানীং ভেসে বেড়াচ্ছে।

দেবশঙ্কর হালদারের পর কে?

দেবশঙ্করের তিন দশকেরও বেশি থিয়েটার-কেরিয়ারের ধারেপাশে নেই, তবু নেক্সট-জেন অভিনেতা হিসেবে পাল্লাটা ঝুঁকে অনির্বাণের দিকে। ২০১০ থেকে নামী পরিচালকদের বহু জনপ্রিয় নাটকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তিনি।— ‘রাজা লিয়ার’, ‘দেবী সর্পমস্তা’, ‘বিসর্জন’, ‘অ্যান্টনি সৌদামিনী’, ‘ট্রয়’, ‘নাগমণ্ডলা’, ‘মেফিস্টো’ হয়ে ‘যারা আগুন লাগায়’, ‘ছায়াবাজি’...। দিনে দিনে তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। ব্যস্ততা বাড়ছে। চাইলেই তাঁকে দিয়ে নাটক করানো এখন অত সহজ নয়।

ডাক আসছে বড় পর্দা থেকেও। অপর্ণা সেন ‘আরশিনগর’-এ অনির্বাণকে নিয়েছেন। নিজের পরের ছবির জন্য তাঁকে পেতে চাইছেন অঞ্জন দত্ত, সুদেষ্ণা রায়ও।

২০১০। মিনার্ভা রেপার্টরিতে অনির্বাণের প্রথম বছর। প্রথম প্রোডাকশন ‘রাজা লিয়ার’। নাম ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

সহ-অভিনেতাদের মধ্যে এক গাদা শিক্ষানবিশ তরুণ-তরুণীদের ভিড়ে অনির্বাণ। চরিত্রের নাম এডমন্ড।

দিনের পর দিন তাঁর অভিনয় দেখে খুশি হয়ে তাঁকে পরামর্শ দিতে গ্রিনরুমে ডেকে নিয়েছিলেন সৌমিত্রবাবু।

‘‘তত দিনে ৩২-৩৩টা শো হয়ে গেছে। অভিনয় ছাড়া আমি ব্যাকস্টেজের কাজটা দেখতাম। তাই-ই করছিলাম। হঠাৎ ওঁর ডাক। প্রায় কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে জবুথবু হয়ে দাঁড়ালাম। বসতে বললেন। তার পর নিজে থেকেই অ্যাক্টিং এক্সারসাইজ নিয়ে বেশ কিছু উদাহরণ দিলেন,’’ মধ্য কলকাতার এক স্ন্যাকস-বারে আড্ডায় বসে বলছিলেন অনির্বাণ।

কী বলেছিলেন সৌমিত্রবাবু?

‘‘খুব বেশি করে কবিতা পড়তে। বিড়বিড় করে নয়। গলা ছেড়ে। সেই থেকে আমি এখনও রোজ নিয়ম করে ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ পড়ি। আর একটা বলেছিলেন, মাথায় ভারী বই নিয়ে, হাত ঝুলিয়ে সোজা হাঁটা প্র্যাকটিস করতে। কেন, জানতে চাইনি, কিন্তু জুলভার্নের গাবদা একটা রচনাবলি মাথায় নিয়ে রোজ হাঁটতাম,’’ বললেন অনির্বাণ।

দিন কতক আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে এ নিয়ে জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘‘কোথায় যেন পড়েছিলাম অমন একটা প্র্যাকটিসের কথা। ছোটবেলায় খুব রাজস্থানে যেতে হত। বাবা পোস্টেড ছিলেন। দেখতাম, জলের ঘড়া মাথায় নিয়ে মেয়েরা বহু দূর দূর থেকে জল আনছে। পরে আমার মনে হয়েছে, ওঁরা যতটা ভাল হাঁটেন, তা বোধ হয় অনেক ভাল অ্যাথলেটও পারবেন না। এটা আমার থিয়েটারের এক্সারসাইজের মধ্যে পড়ে। অনির্বাণকে দেখে আমার ভাল লেগেছিল, তাই ওকেও বলছিলাম।’’

তিরিশ পেরনোর আগেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রশংসা। কিন্তু অনির্বাণের থিয়েটারে আসার নেপথ্য-কাহিনি অনেকটা যেন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’র আধুনিক চিত্রনাট্য।

ওষুধ ব্যবসায়ী বাবা। গৃহবধূ মা। এক বোন। ভাড়াবাড়িতে যেমন-তেমন করে চালিয়ে নেওয়া এক খুশিয়াল পরিবার। মেদিনীপুরের বিধাননগর-শরৎপল্লির এ বাড়ির বড় ছেলে অনির্বাণ বলতে গেলে ছোট থেকেই পাড়ার খুদে ‘গ্যাংস্টার’। দলবল নিয়ে মারপিট। এর-তার বাগানের ফল সাফা। কারও কাচের জানলা চুরমার।

বাড়িতে পুলিশ ধরতে এসেছে। ভ্রুক্ষেপ নেই। ক্লাস বাঙ্ক মেরে সিনেমা—‘মা তুঝে সালাম’, ‘মুঝে কুছ কহেনা হ্যায়’..., কাঁসাই নদীর ধারে তাস, আড্ডা, বিড়ি। সাইকেল চালিয়ে মেয়েদের পিছু নেওয়া। প্রেমে পড়া। সব চলছিল।

সেখান থেকে থিয়েটার কী করে?

‘‘পড়াশুনো ভাল্লাগতো না। ছোট থেকে স্কুলের প্রোগ্রামে অ্যাঙ্কারিং করতাম। গান করতাম। বন্ধুরা বলত, ওটাই তোর লাইন।’’

হায়ার সেকেন্ডারির পরই ঠিক করে ফেলেন সোজা পালাবেন কলকাতা। রবীন্দ্রভারতীতে নাটক নিয়ে পড়বেন। শেষে মায়ের জোরাজুরিতে মেদিনীপুর কলেজে ফিলোজফি অনার্সের ফর্ম তুলেও ইউ-টার্ন। ট্রেনে চেপে এ শহর। কোলে মার্কেটের মেস। ক্রিকেটার অশোক দিন্দার সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকা শুরু।

‘‘দিন্দা অস্ট্রেলিয়া চলে গেল ট্রেনিং-এ। আমি পড়া চালিয়ে যেতে লাগলাম রবীন্দ্রভারতীতে। তখন খুব টানাটানি। বাবার ব্যবসা বন্ধ। সংসার চালাতে আমার স্কলারশিপের টাকা, মায়ের গয়না গেল। ২০০৫-এ কলেজে আমার ব্যাচ-মেট তথাগত চৌধুরী আমাকে অদ্রিজাদির (দাশগুপ্ত) কাছে নিয়ে যায়। ওঁর দল ‘ঊহিনী কলকাতা’য় ঢুকে গেলাম,’’ বলছিলেন অনির্বাণ।

বলতে গেলে অদ্রিজার কাছে গিয়েই অনির্বাণের ব্রেখট, স্তানিস্লাভস্কি জানতে পারা। সফদর হাশমির ‘জাগা জেগে থাকা জাগানো’ পড়া। জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় ঢোকা। তলস্তয়, দস্তয়ভেস্কি থেকে লি শাউচি কি জন রীড-এ মুগ্ধ হওয়া। প্রথম ইংরেজি সিনেমা দেখা। ‘গানস অব ন্যাভারন’, ‘সাউন্ড অব মিউজিক’...।

থিয়েটার, থিয়েটারের প্র্যাকটিসের পাশাপাশি মাথায় বাসা বাঁধল গল্পের পোকা— শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্য, স্বপ্নময় চক্রবর্তী...।

আর সিনেমার জগতে?— চার্লস লোটন, অ্যাল পাচিনো, মার্লোন ব্রান্ডো...। বলছিলেন, ‘‘উত্তমকুমারও। ‘নায়ক’ যে কত বার দেখি! আর চ্যাপলিন। সপ্তায় এক দিন অন্তত ‘সিটি লাইটস’ দেখতামই।’’

২০১০, ২ অগস্ট থেকে মিনার্ভা রেপার্টরি। তার মাস কয়েক বাদেই ‘রাজা লিয়ার’।

‘রাজা লিয়র’-এর পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়েরও প্রবল আস্থা অনির্বাণের ওপর।

সুমনের পরের পর নাটকে ডাক পড়ছে তাঁর। ওঁর ‘যারা আগুন লাগায়’-এ অনির্বাণ এক প্রৌঢ় গৃহকর্তা। বি়ডারম্যান।

সাতাশ-আঠাশ বছরের অনির্বাণকে দিয়ে এ নাটকে প্রৌঢ়ের অভিনয় করাতে অদ্ভুত এক ধরা-চাপা-খসখসে গলার ব্যবহার করান পরিচালক। যা দেখে অনেকেরই মধ্য আশির নান্দীকারের নাটক ‘শেষ সাক্ষাৎকার’-এর কথা মনে পড়ে। গৌতম বা দেবশঙ্কর হালদার তখন বছর কুড়ি-বাইশের যুবক। সে-নাটকে তাঁরা অভিনয় করতেন মাঝবয়েসির।

‘‘মিনার্ভা রেপার্টরিতে একটা ওয়ার্কশপ করাতে গিয়ে ওঁকে প্রথম দেখি। তখন থেকেই মনে হত, অনির্বাণ মেধাবী। ডিসিপ্লিনড। লিখতে পারে। নাচতে, গাইতেও পারে। তখনই ওকে আমার ভাল লেগেছিল,’’ বলছিলেন দেবশঙ্কর স্বয়ং।

লিয়র-এর পরে ‘দেবী সর্পমস্তা’। মনোজ মিত্রর মিউজিক্যাল ড্রামা। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনা। অনির্বাণের ডাবল কাস্টিং। রাজা লোকেন্দ্রপ্রতাপ আর কথক। লোকেন্দ্র যৌন অক্ষমতায় ভোগে। অবসাদগ্রস্ত। সুবিধেবাদী। ব্রিটি‌শদের ক্রীড়নক।

লোকেন্দ্রর অভিনয় করেই অনির্বাণ প্রথম বার ভাল মাত্রায় চোখে পড়ে গেলেন থিয়েটার-প্রেমীদের। বিশেষ করে তাঁর যে গানের গলাটা মোক্ষম, টের পেয়ে গেল মঞ্চের দুনিয়া।— ‘ও লো সন্ধ্যাতারা দেখলি তো তুই মন আকাশে কখন কী যে রঙ লেগে যায়...’। বহু নাট্যপ্রেমীর কানে আজও বাজে ওঁর গান।

এর পর ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদলে অনির্বাণের ‘অ্যান্টনি সৌদামিনী’-তে ডাক, অনেকটা এই কারণেই। তরজা, টপ্পাঙ্গের গানেও নজর কাড়লেন তিনি।

এক মাস কথাকলি শিখলেও এক দিনও কিন্তু গান শেখেননি। শোনেন, পাগলের মতো— শচীন কর্তা থেকে হার্ড রক, জ্যাজ, স্নেহা খানওয়ালকার, অমিত ত্রিবেদী।

দেবেশ চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘গান গাওয়া, নাচতে পারা তো ছিলই। সেই সঙ্গে ‘দেবী সর্পমস্তা’-য় বেশ কয়েকটা গান লিখে সুরও দিয়েছিল অনির্বাণ। আর প্রথম থেকেই মঞ্চে ওর অভিনয়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটাও ভাল।’’

এর পর চার বছর পেরিয়ে গেছে। অনির্বাণ-তথাগত মিলে ছোট্ট একটা নাটকের দলও গড়েছেন— ‘সঙ্ঘারাম’।

অনির্বাণের খুব ইচ্ছে, এক বার যদি অরুণ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় কোনও কাজ করতে পারতেন। কিংবা বিভাস চক্রবর্তীর পরিচালনায় সুযোগ পেতেন ব্রেখটের কোনও নাটকে।

কাজ করা হয়নি ব্রাত্য বসু বা কৌশিক সেনের সঙ্গেও। বলছিলেন, ‘‘ব্রাত্যদার উইঙ্কল টুইঙ্কল-এ ইন্দ্র হতে পারলে... যেটা রজতাভদা (দত্ত) করত...। কিংবা কৌশিকদার ‘মাল্যবান’-এ সুযোগ পেলে ভাল লাগত।’’

সদ্য ‘বিসর্জন’ আবার করে মঞ্চে এল। তাতে একসঙ্গে অভিনয় করলেন কৌশিক-অনির্বাণ। কৌশিক বলছিলেন, ‘‘মঞ্চে অভিনয় না থাকলে দেখছিলাম, উইংসের পাশে বাবু হয়ে বসে মন দিয়ে অন্যদের অভিনয় দেখছে। এটা যত দিন থাকবে...।’’

অভিনেতা গৌতম হালদারের পাঁড় ভক্ত অনির্বাণ বিলক্ষণ জানেন, থিয়েটারে ‘বাবু’ হতে নেই, বাবু হয়ে বসে থাকতে হয়।

anirban bhattacharya grooming actor anirban bhattacharya saumitro chattopadhayay minarva repartory debshankar mukhopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy