Advertisement
E-Paper

অদ্ভুত আঁধারের গল্প

‘পঞ্চম বৈদিক’-এর নতুন নাটক ‘কারুবাসনা’। মহলা দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়একই মঞ্চে জীবনানন্দ দাশ ও জয় গোস্বামী! এবং এই ২০১৫-তে।— বাংলা থিয়েটারে এমনই এক কাণ্ড ঘটতে চলেছে আসছে শনিবার। জীবনানন্দের উপন্যাস ‘কারুবাসনা’র কাহিনি নিয়ে তৈরি ‘পঞ্চম বৈদিক’-এর নতুন নাটকে এই প্রথম বার অভিনয় করতে দেখা যাবে কবি জয় গোস্বামীকে (প্রথম শো ২২ অগস্ট, ৬ টা ৪৫, একাডেমি)।

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
সে দিন মহলায় অনির্বাণ, জয়, নীল। ছবি: প্রণব বসু

সে দিন মহলায় অনির্বাণ, জয়, নীল। ছবি: প্রণব বসু

একই মঞ্চে জীবনানন্দ দাশ ও জয় গোস্বামী!
এবং এই ২০১৫-তে।— বাংলা থিয়েটারে এমনই এক কাণ্ড ঘটতে চলেছে আসছে শনিবার।
জীবনানন্দের উপন্যাস ‘কারুবাসনা’র কাহিনি নিয়ে তৈরি ‘পঞ্চম বৈদিক’-এর নতুন নাটকে এই প্রথম বার অভিনয় করতে দেখা যাবে কবি জয় গোস্বামীকে (প্রথম শো ২২ অগস্ট, ৬ টা ৪৫, একাডেমি)।
আলো-অন্ধকারে যাই— মাথার ভিতরে/ স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে;/ স্বপ্ন নয়— শান্তি নয়— ভালবাসা নয়,/ হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
ততক্ষণে সরোদে চারুকেশী-র আলাপ জুড়িয়ে গেছে। টিং টিং টিং টিং করা ট্রামের ঘণ্টি মিলিয়েছে। মঞ্চের ম্লান আলো ফুটতে চেয়েও থমকে। আর তখনই স্বর ভেসে আসে … ‘‘সব কাজ তুচ্ছ হয়— পণ্ড মনে হয়…।’’
মুখড়াতে সদ্য জারিয়ে ওঠা আবেশে হানা দিয়ে যায় একের পর এক শব্দ-তির— ‘‘সব চিন্তা— প্রার্থনার সকল সময়/ শূন্য মনে হয়,/ শূন্য মনে হয়…।’’
হানা— কেননা এ নাটকের পরিচালক অর্পিতা ঘোষ। জীবনানন্দের সঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামীর কবিতা, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের থিয়েটার জুড়ে যে নাট্যরূপ, সেটিও তাঁর।
এর মধ্যেই মঞ্চে ছোট্ট ছোট্ট বাক্সো চোখে পড়ছে। আয়তাকার। বর্গাকার। ধূসর। সে সবের এক পিঠে এলোমেলো লাল, নীল, সাদা আঁচড় শিরা-উপশিরার মতো পাকানো, জড়ানো। সেট বলতে এটুকুই। নাটকের সিনোগ্রাফি যেহেতু দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের, বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না, তাঁর থিয়েটারি স্টাইলেই এই বাক্সোগুলো হাতে হাতে নড়েচড়ে, উল্টেপাল্টে গিয়ে আকার বদলাবে, আসবাব-ঘর বদলে বদলে যাবে।
এই নাটকের সূত্রে প্রথম বার বাংলা থিয়েটারে মিউজিক করছেন বড় পর্দার ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত।

‘কারুবাসনা’ হেম-এর গল্প। হেম কবি। কল্যাণী হেমের তিন বছরের বিয়ে করা বউ। হেমের বাবা আছেন। মা, পিসিমা আছেন।

অভাব হামলে ওঠা এ পরিবারে রোজগেরে বলতে বাহাত্তর বছরের বুড়ো ওই বাবাই। হেমের চাকরি নেই, সন্তান আছে— খুকি।

কলকাতায় মেসে থেকে হেম মাঝে মাঝে চাকরি খোঁজে। টিউশন করে। বাকি সময়টা ফুটপাথে ঘোরে। পুরনো বইয়ের দোকানে বই নেড়েচেড়ে দেখে। চুপচাপ বসে থাকে খবরের কাগজ হাতে। আবার পালিয়ে আসে বাড়িতে। ছ’-সাত দিনের জন্য থাকতে এসে তিন মাস কাটিয়ে দেয়। এ জীবনে তার অরুচি। সে চায় মস্ত একটা মাঠের মধ্যে কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকতে। পাশে মেঘনা, কিংবা কর্ণফুলি বা ইছামতী। সে শুধু লিখবে, আর লিখবে। দিগন্তবিস্তৃত সোনালি মাঠের কিনারে ঘুরে বেড়াবে। লাল আকাশ ভেঙে সন্ধের দাঁড়কাকগুলোকে ঘরে ফিরে যেতে দেখবে।

পরমুহূর্তেই তার মনে হয়, সেটা তো পলায়ন হয়ে যেত। জীবন মানে যে ভিড়ের মধ্যে মিশে, যা করতে ইচ্ছে করে না, যা ভাবতে ভাল লাগে না, সেই অপ্রেমটাকেই টানতে টানতে হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে বয়ে চলা!

মাঝে মাঝে হেম কবিতার প্রতিও শ্রদ্ধা, বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। সে হিজিবিজি আঁক কাটে। গুটিসুটি মারে। হামাগুড়ি দিয়ে পালায়। বাতাসে সাঁতার দেয়। পাখি হয়ে উড়ে যেতে চায়। তার পারা-না পারার মধ্যে দ্বিতীয় এক হেম জেগে ওঠে। দু’জনে (অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও নীল মুখোপাধ্যায়) ষাঁড়াষাঁড়ি লড়ে। আবার পিঠোপিঠি বসে। ক্রমশ সমাজ-সংসারে নিরাশ্রয়, বাড়তি হয়ে পড়ার যন্ত্রণা নিয়ে লোপাট হয়ে যেতে চায়।

দমবন্ধ হয়ে আসা সময়ে দাঁড়িয়ে, সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কর খেলায় পিছলে পড়ে হেমের এক সময় মনে হয় কবিতাই তাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সংসারকে ভরে দিয়েছে ছাই-কালি-ধূলির শূন্যতায়।— ‘‘একটা জীবন পোড়ে কেবল পোড়ে/ আর যেন তার কাজ ছিল না কোনও।’’

এখান থেকেই হেম যেন উড়ান দেয় পৃথিবীর সব অনাশ্রিত কারুপ্রেমীর যন্ত্রণা নিয়ে। সেই উড়ানের গায়ে জেগে ওঠে এ বাড়ি-ও বাড়িতে অন্যতর জীবন কব্জা করতে চেয়েও ছিটকে পড়া গড়-গেরস্থের মুখও।

এর সমান্তরালে চলে আরও জীবন। হেমেরই মেজকাকা, সেজকাকা, বাবার বন্ধু যদুনাথকাকা। প্রতি মুহূর্তে জীবন থেকে যাঁরা পুরস্কার খোঁজেন। উত্তেজনা টের পান। অন্যকে কথা বিলিয়ে বেড়ান। এঁদের কারও কারও জীবনের আপ্তবাক্যই হল— ‘‘পৃথিবীকে যদি উপভোগ করতে চাও, তা হলে সৃষ্টির ভিতরকার অক্লান্ত সুবিধাবাদ ও আত্মপরতাকে মনপ্রাণ দিয়ে গ্রহণ করতে শেখো।’’

ঘটনার ঘনঘটা নেই। আলোর খেলা, সার্কাসি চমক কোনওটাই নেই। কিন্তু এ নাটক প্রতি মুহূর্তে বাসনা আর বাস্তবের লড়াই দেখায়। যে লড়াইয়ে দুমড়ে মুচড়ে ভাঙতে ভাঙতে মৃত্যুর দিকে এলিয়ে পড়ে এক-একটি জীবন। এ নাটক অন্তঃক্ষরণের গল্প শোনায়। অনুভবের যন্ত্রনায় হারিয়ে ফেলা শব্দকে ফিরিয়ে দেয়। সেখানে কাহিনির চলনের মধ্যে এক মস্ত আয়না জেগে ওঠে যেন!

শেষমেশ ‘কারুবাসনা’ অদ্ভুত আঁধারে এনে দাঁড় করায়।— ‘‘যাদের হৃদয়ে কোনও প্রেম নেই— প্রীতি নেই— করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।’’

ট্রামের ঘণ্টি বাজতে বাজতে বাজতে মিলিয়ে যায়...। এক নিঝুম নৈঃশব্দ্যের হাহাকার পড়ে থাকে শুধু...

debshankar mukhopadhyay karubasana pancham vaidaik drama rehearsal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy