Advertisement
E-Paper

কিরীটী-জনক নীহাররঞ্জন গুপ্ত সম্পর্কে কিছু জানা অজানা কথা

পদ্মাপারে ফেলে আসা ভিটের স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত! সেই মানুষটিই কিনা কিরীটী-জনক নীহাররঞ্জন গুপ্ত? স্মৃতিকথায় সেজ মেয়ে করবী সেনপদ্মাপারে ফেলে আসা ভিটের স্মৃতি তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত! সেই মানুষটিই কিনা কিরীটী-জনক নীহাররঞ্জন গুপ্ত? স্মৃতিকথায় সেজ মেয়ে করবী সেন

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৭ ১২:০০
নীহাররঞ্জন গুপ্ত

নীহাররঞ্জন গুপ্ত

মাঝ-আকাশের গনগনে আঁচ ক্রমেই তাপ বাড়াচ্ছে মাটির। কোনারকের সূর্যমন্দির। দর্শনে গিয়েছি আমরা। আমি তখন সদ্য কিশোরী।

সিঁড়ি দিয়ে নামছি সবাই। বাবা, মা, আমরা চার বোন। হঠাৎ দেখি, নীচ থেকে উপরে উঠছেন এক ভদ্রলোক। খুবই চেনা।

স্যুটেড-বুটেড। প্রায় ছ’ফুটের মতো লম্বা। মার্জার গতিতে আমাদেরই দিকে ধেয়ে আসছেন তিনি! দেখে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ভদ্রলোক এসে বাবার সঙ্গে হাত মেলালেন। তার পরই শুরু হল ওঁদের পরস্পরের আলাপ। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে নির্বাক শ্রোতা।

ওঁকে বিলক্ষণ চিনতাম। উনি বলরাজ সাহানি। বাবার সঙ্গে ওঁর চেনাশোনা অনেক কালের।

সময়টা সত্তরের দশকের কাছাকাছি। তত দিনে, বাবার কাহিনি নিয়ে তৈরি সিনেমা ‘লাডলা’য় অভিনয় করে ফেলেছেন বলরাজ ও নিরূপা রায়। মায়ের সঙ্গে বলরাজের পরিচয় করিয়ে দিলেন বাবা, ‘‘জুঁই (মায়ের ডাক নাম, ভাল নাম কনক), ওঁর ছবি তো অনেক দেখেছ! এ বার চাক্ষুষ করলে।’’

কোনারকের সূর্যমন্দির, পুরী আর বারাণসী। বাবার প্রিয় জায়গাগুলোর কয়েকটা। প্রায় প্রতি বছরই এর যে কোনওটায় ঘুরতে যেতাম আমরা। বেড়ানোতে ছিল বাবার প্রবল শখ। আর শখ ছিল আড্ডায়। প্রতি রবিবারের সকালে বাবাকে একবার দেখতে হত! আমরা তখন গোলপার্কে। বাড়ির নাম ‘উল্কা’, বাবারই একটি কাহিনির নামে। সকাল থেকেই আনচান করতেন বাবা। বেলা একটু গড়াতেই চলে আসতেন সর্দারজি। আমাদের বাড়ির বিশ্বস্ত ড্রাইভার। আমাদের একটা কালো রঙের ফিয়েট ছিল। প্রথম দিকে অবশ্য অ্যাম্বাসাডর। গাড়ি করে বাবা যেতেন সোজা উত্তরে, সেই টালা পার্ক। তারাশঙ্করজেঠুর (বন্দ্যোপাধ্যায়) বাড়ি। দুপুর গড়িয়ে যেত ওঁদের আড্ডায়। সঙ্গে শুধু মুড়ি আর চানাচুর।

পরিবারের সঙ্গে

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, কিরীটীর সং‌সারের হীরা সিং‌হকে কেন জানি না আমার মনে হত, সর্দারজির আদলেই গড়েছিলেন বাবা! কোনও দিন অবশ্য যাচাই করা হয়নি বাবার কাছে!

রবিবার ছা়়ড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলো বাবার ব্যস্ততাতেই কেটে যেত। শ্যামবাজার স্ট্রিটে (পরে ধর্মতলা স্ট্রিটে) ডাক্তারি চেম্বার, লেখালেখি, পুজোপাট, পোষ্যের যত্ন নেওয়া, তার সঙ্গে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্পগুজব তো থাকতই!

বাবা-মা দু’জনেই সকাল-সকাল উঠে পড়তেন। স্নান সেরে তিন তলায় গোপালসেবা করা ছিল ওঁদের বাঁধা। ঠাকুরঘরে দু’খানি গোপাল। একটি কষ্টি পাথরের, অন্যটি অষ্ট ধাতুর। কষ্টি পাথরের গোপাল ঠাকুরটি বাড়িতে আসার একটি গল্প রয়েছে। সে-গল্প বাবার মুখেই শোনা।

একদিন নাকি বাবা স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, ‘‘বৃন্দাবন থেকে আমাকে নিয়ে যাও।’’ বাবা গিয়েছিলেন। আর এই গোপালমূর্তিটি তাঁর ওখান থেকেই পাওয়া। কলকাতা ফিরে গোপালকে বাড়িতে এনে প্রতিষ্ঠা করেন বাবা। তার পর তাঁর রোজের সেবা চলত।

ঠাকুরঘর। ধুতিটা লুঙ্গির মতো করে পরতেন বাবা। খালি গা। সদ্য স্নান করে বেরিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। নিষ্ঠা ভরে পুজো করতেন তিনি। পাশে মা।

পুজো শেষ হলে বোতামখোলা জামাটি গায়ে উঠত। এ বার সময় প্রাতঃভ্রমণের। রবীন্দ্র সরোবরের ধারে। সঙ্গে তখন অবশ্যই থাকত বাবার প্রিয় জ্যাকলিন। নামটা বাবারই দেওয়া। জ্যাকলিন অ্যালসেশিয়ান। কোনও এক হিন্দিভাষী বাবাকে উপহার দেন এই সারমেয়-শাবক। বাবা ‌ছিলেন ওঁর চিকিৎসক। পরে বাবা জ্যাকলিনের এক সঙ্গীও নিয়ে আসেন বাড়িতে। তার নাম দেন টাইগার।

প্রাতঃভ্রমণ থেকে ফিরে প্রাতরাশ। শেষে রুপোর সাজি থেকে এক খিলি পান। পানের সঙ্গে ভুরভুরে গন্ধজর্দা। যে-সে জর্দা নয়। নাখোদা মসজিদের কাছে কোনও এক দোকান থেকে নিয়ম করে ‘গুলি জর্দা’ কেনা ছিল বাবার বহু কালের অভ্যাস। মাঝেসাঝেই বাবা বলতেন, ‘‘নাখোদার এই জর্দার যে স্বাদ, সে আর কোথাও পাই না।’’

তবে এই সামান্য ‘জর্দা-বিলাস’টুকু ছাড়া খাওয়াদাওয়া নিয়ে বাবার তেমন বাছবিচার ছিল না। তবে বাঙাল পরিবারের সন্তান তো! মাছের প্রতি ঝোঁকটা ছিল একটু বেশিই। বাংলাদেশের নারাইল জেলার ইটনা গ্রামে আমাদের দেশের বাড়ি। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন কবিরাজ।

তো, যে কথা বলছিলাম, বাবার মৎস্যপ্রীতি। পাতে সর্ষে-ইলিশ দেখলে সে দিনের খাওয়াদাওয়াটা যেন অন্য মাত্রা পেত বাবার! চিংড়ি অবশ্য না-পসন্দ। কিন্তু আমাদের যে পছন্দ, তাই বাজার থেকে বেছে বেছে চিংড়ি আনতেন মাঝেসাঝেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বাবা ছিলেন সেনাদলের ডাক্তার। সে কথা আমি ছোট থেকেই শুনে শুনে বড় হয়েছি। প্রায়ই তার গল্প শুনতে চাইতাম বাবার কাছে। যুদ্ধের গল্প, সিপাইয়ের গল্পে আগ্রহ দেখে বাবা আমার নাম দিয়েছিলেন ‘সিপাই’।

ছোট মেয়েদের প্রতি স্নেহ বাবার চিরকালই খুব বেশি। তা সে নিজের বোন গণ বা কমলির সঙ্গে যেমন, আমাদের বেলাতেও তাই।

বাবা মানেই গল্পের খনি। হাজার ব্যস্ততা থাক, রাতের দিকে আমাদের নিয়ে বাবা গল্পের আসর বসাতেনই বসাতেন। খাওয়ার টেবিলেও বসে বসে আড্ডা জমত।

তেমনই এক গল্প বাবার বিলেতযাত্রা নিয়ে। জাহাজে করে চলেছেন ইংল্যান্ড। উচ্চশিক্ষার জন্য। প্রাতরাশের সময় ভীষণ বিপত্তি। ছুরিতে কেটে কেটে খাবার খেতে হবে। সাহেবি কেতা। পুরোদস্তুর বাঙালি আমার বাবার কাছে সে ছিল বড়ই বিড়ম্বনার। তবু অপটু হাতেই বাবা ছুরি ধরলেন। গোড়াতে বেশ চলছিল। কিন্তু ডিম সেদ্ধটা কাটতে গিয়েই ঝামেলা পাকল। ফস করে ছুরি পিছলে অর্ধেকটা ডিম গিয়ে ছিটকে পড়ল পাশেই বসা এক মেমসাহেবের কোলে। তাতে বাবা তো লজ্জায় এক শেষ! মেমসাহেব অবশ্য পুরো ব্যাপারটি নিজেই সামলে নিয়েছিলেন।

বাবা যত বার গল্পটা বলতেন, আমরা হাসতাম বটে, কিন্তু দেখতাম অত দিন বাদেও বাবার সলজ্জ ভাবটা যেন কাটেনি!

আমাদের নিয়ে বাবা যে কতটা স্পর্শকাতর ছিলেন, বলে বোঝানোর নয়!

আমরা চার বোন। বাবা-মায়ের আদরের চার কন্যা। মেয়েসন্তান তো অনেকেরই পছন্দের নয়! ঠারেঠোরে কেউ কেউ কথা শোনাতেন। কিন্তু সে সব বাবার কানে গেলেই হল, এমন তেড়ে উঠতেন যে, যিনিই বলুন, দ্বিতীয় বার কিছু বলার আগে ভেবে দেখতেন।

তবে বাবার একজন পুত্র-সন্তানও ছিল। মানসপুত্র বলাই ভাল। তিনি গোয়েন্দাপ্রবর কিরীটী রায়। সে পুত্র বাবার এতই প্রিয় ছিল যে, মহানায়ক উত্তমকুমারকেও এক বার বাবা কিরীটী চরিত্রে অভিনয় করার প্রবল ইচ্ছে থেকে বিরত করেন। সে কাণ্ডও শুনেছি
বাবার কাছেই।

ফিয়েট গাড়ি থেকে নামলেন উত্তমকুমার। ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি। হাতে কিং সাইজ সিগারেট। বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে শেষ সুখটানটা দিয়ে পায়ে সিগারেট পিষে দিলেন রাস্তায়।

বাড়িতে ঢুকে বাবার ঘরে গিয়ে এ-কথা সে-কথার পর সটান ওঁর আর্জি, ‘‘কিরীটী করতে চাই, সিনেমায়।’’

কিরীটীতে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন উত্তমকুমার! কিন্তু বাবাকে সে দিন টলাতে পারেননি স্বয়ং মহানায়কও! অতিথিকে খাতির-যত্নের ত্রুটি করলেন না বাবা। কিন্তু যথাসময়ে বিনীত ভাবে জানিয়ে দিলেন, ‘‘না। আপনি ‘কিরীটী রায়’ হলে কিছুতেই মানাবে না!’’

অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কিরীটীর জন্ম-বৃত্তান্ত আর বাবার রহস্যকাহিনি লিখতে যাওয়া নিয়ে দু’চার কথা বলি।

বাবা লিখেছিলেন, ‘‘আমি অনেক রহস্যকাহিনি রচনা করেছি। এর মূলে আছে আমার জীবনে দেখা দুটি ঘটনা। যা, বিশেষ করে দ্বিতীয়টি, মনকে নাড়া দিয়েছিল সাঙ্ঘাতিক ভাবে। এবং সেটা আমার প্রথম যৌবনকাল।’’

এ কাহিনি আমাদেরই পাড়ার। এক পোড়ো জমিদারবাড়ির সত্যিকারের ঘটনা। ও বাড়িতে এক নিঝুম দুপুরে খুন হয়ে যান বাড়ির বউমা। অন্তঃস্বত্ত্বা বিধবা সেই রমণীকে গুলি করে খুন করে তার সুপুরুষ দেওর। সে আবার যক্ষ্মায় আক্রান্ত। বউদিকে খুন করে নিজেকেও রেওয়াত করেনি। ওই বন্দুকেরই গুলিতে শেষ করে দেয় নিজেকেও।

বাবা লিখেছেন, ‘‘ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালাম। শ্বেতপাথরের মেঝের ওপর পড়ে আছে দুটি দেহ। চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে আছে। কে বুঝি সাদা পাথরের মেঝের ওপর মুঠো মুঠো রক্তগোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছে। পাশে পড়ে দোনলা বন্দুকটা।’’

প্রথম ঘটনা এটিই। দ্বিতীয়টি বাবার বাল্যকালের সময়। বাবা লিখেছেন, ‘‘সেটি মর্মন্তুদ হলেও তার মধ্যে তেমন রহস্যের ইশারা ছিল না। সেটি ছিল গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা।’’

দুটি ঘটনারই কেন্দ্রে অসামান্যা রূপসী দুই যুবতী নারী, অবৈধ ত্রিকোণ প্রেম, পরিণতিতে অস্বাভাবিক মৃত্যু।

দ্বিতীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে বাবা লিখেছিলেন, ‘‘কেউ জানতেও পারল না, মেয়েটি তার গোপন ভালবাসার জন্যই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিল।’’

সকলের অজ্ঞাতে সেই মৃত্যুর কারণ বহু দিন বাবার মনের মধ্যে অস্বস্তির একটা বাতাবরণ তৈরি করত। বাবা লিখছেন, ‘‘পরবর্তী কালে আমার প্রথম যৌবনে জমিদারিবাড়ির নিষ্ঠুর হত্যা-রহস্যের সঙ্গে একাকার হয়ে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ‘জোড়া খুন’ রহস্য কাহিনি রচনা করতে।’’

এই কাহিনি রচনা থেকেই জন্ম নিয়েছিল কিরীটী রায়ের ভ্রূণ।

প্রভুর পাহারায় তাঁর আদরের জ্যাকলিন

কিরীটী-জন্মের পূর্বশর্ত হিসেবে যদি কাজ করে থাকে এ দু’টি কাহিনি, দ্বিতীয় কারণটি অবশ্যই গোয়েন্দা কাহিনি-লেখক পাঁচকড়ি দে। বাবার কথাতেই বলি, ‘‘ইতিপূর্বে পাঁচকড়ি দে’র খানকয়েক রহস্য উপন্যাস পড়েও ক্রাইমজগতের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ঘটেছিল। কেবল পরিচয়ই নয়, মনের মধ্যে কিছুটা রোমাঞ্চও সৃষ্টি করেছিল। ... গোয়েন্দা-চরিত্রটির মধ্যে রীতিমতো যেন একটা রোমাঞ্চকর আকর্ষণ অনুভব করতাম।’’

তো, এই হল কিরীটীর জন্ম-বৃত্তান্ত। বাবা যে কিরীটীকে সেলুলয়েডে আনতে চাননি, তা নয়। কিন্তু বাবা ভাবতেন, কেউ যদি এই চরিত্র করতে পারেন, তবে তিনি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়! অজিতেশবাবু অবশ্য জানতে পারেননি বাবার এই ইচ্ছের কথা!

বাবার বর্ণনায় কিরীটী রায় যেমন, বাবা নিজেও অনেকটা ছিলেন তেমনই। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, ব্যাকব্রাশ করা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার চুল আঁচড়ানোটা ছিল দেখার মতো। কিরীটীর চোখে পুরু লেন্সের সেলুলয়েড চশমা। বাবারও তাই।

উল্কাবাড়ির ‘মেজানাইন ফ্লোরে’ এক চিলতে একটা ঘর ছিল। বাড়িতে থাকলে, দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে বাবা ঘুমোতে যেতেন না। ওটাই বাবার লেখার সময়। খাওয়াদাওয়া সেরে মোজাইকের মেঝেতে শোনা যেত বাবার পায়ের খসখস শব্দ।

সুইং ডোর ঠেলে বাবা ঢুকতেন সেই ঘরে। গায়ে গোল গলা গেঞ্জি, নয় বোতাম খোলা শার্ট।

ও ঘরের তিন দিকের দেওয়ালে কাঠের বুক সেল্ফ। ঠাসা বইপত্র। এক কোণে আমার মায়ের সেতারটি রাখা। খড়খড়িওয়ালা জানালাও ছিল। তার ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ত একটি কলেজের গার্লস হস্টেল। বাবার ‘বেলাভূমি’ কাহিনিতে যে হস্টেলের কথা আছে, এই হস্টেল সেটিই। চেয়ারটা টেনে বাবা বসতেন লেখার টেবিলে। ততক্ষণে ঘরের মেঝেয় আমরা চার বোন হয়তো শুয়ে পড়েছি।

বাবা লিখতে বসতেন। এমনিতে যে মানুষ গল্পগাছা করে কাটাতেন, লেখার সময় আশেপাশে কোনও কথা তাঁর সইত না। চাপা স্বরে দু’একটা কথা বললেও বিরক্ত হতেন। বকা দিতেন। তার পরে অবশ্য ফের লেখা।

কিরীটীর সঙ্গে বাবার যেমন মিল, তেমন আবার ছিল অমিলও। কিরীটী গৌরবর্ণ। বাবার গায়ের রং খানিক তামাটে। কিরীটীর উচ্চতা প্রায় সাড়ে ছ’ফুট। বাবা কমবেশি পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি।

এমনিতে অসম্ভব রসিক মানুষ আমার বাবা। একটা ঘটনা বলি।

আমার দুই মেয়ে চন্দ্রিকা আর মন্দিরা তখন খুবই ছোট। বাবা এক দিন আদর করে দুই নাতনির জন্য শাড়ি কিনে আনলেন। মন্দিরা তা নিয়ে ভীষণ খুশি। কিন্তু কী ভাবে শাড়ি পরা হয়, তখনও সে জানত না। অগত্যা গেল, দাদুর কাছেই। আধো আধো গলায় তার আবদার, ‘‘পরিয়ে দাও।’’

পান চিবোতে চিবোতে বাবা মজা করে বললেন, ‘‘তার থেকে বল, নিজেই পরে নিই।’’

তখন তো কথাটা শুনে খুব হেসেছি। আর বিশেষ কিছু মনে হত না। কিন্তু এখন, যখন চাইলেও বাবাকে আর পাব না, ওই টুকরো স্মৃতিগুলোই কেমন একটা ভরাট আকাশের জন্ম দেয় মনে। ভাবি, অমন একজন মাপের মানুষ ভিতরে ভিতরে কতটা সোজাসাপটা সরল হলে তবে ছোটদের সঙ্গেও ও ভাবে মিশে যেতে পারে।

আরেকটি ব্যাপার বাবার মধ্যে ছিল প্রবল। ফেলে আসা পৈতৃক ভিটে নিয়ে অসম্ভব টান। বাবা প্রায়ই সে কথা আমাদের বলতেন। সত্তর শতকের মতো জায়গার ওপর আমাদের দেশের দোতলা বাড়ি, পুকুর, বাগান। প্রবেশপথ দুটি। তিরিশের দশকে সেই বাড়ি ছেড়ে এ পার বাংলায় চলে আসেন বাবা। তখন বয়স মোটে চোদ্দো-পনেরো। কোন্নগর, কৃষ্ণনগরে কিছু কাল পড়াশোনার পর ভর্তি হয়ে যান কারমাইকেলে। এখন যার পরিচয়, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ। তার পর তো নানা খাতে বয়েছে বাবার জীবন, কিন্তু ভিটের টান তাঁর কোনও দিনই ফিকে হয়নি।

এমনকী বাংলাদেশ নিয়েও বাবা খুব কাতর থাকতেন। সত্তরের দশকের কথা মনে পড়ে। তখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ। প্রায় প্রতি দিন বাবা খবর শুনছেন মন দিয়ে। যুদ্ধ শুরু হলে রোজ সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধব, সাংবাদিকদের কাছে খবর নিচ্ছেন, কত দূর সফল হলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তখন বাবার আদর্শ হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবর রহমান। বাবার মধ্যে মুজিবর ও বাংলাদেশ-প্রীতি কতটা নিবিড় ছিল, বুঝেছি আরও পরে। বাবার ‘লালুভুলু’ উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে ছবি হল। পরিচালনায় অগ্রদূত। সেই ছবি দুই বাংলাতেই বেশ জনপ্রিয় হয়। এর অনেক পরে উপন্যাসটিকে সম্মান জানাতে ঢাকা থেকে সপরিবার নিমন্ত্রণ আসে বাবার কাছে।

আমরা গেলাম বাংলাদেশ। এর কিছু কাল আগে মারা গিয়েছেন মুজিবর। দেখতাম বাবা যেখানেই যাচ্ছেন, মুজিবরের স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন। একদিন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা বাবার কাছে এলেন, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। কথায় কথায় হাসিনা গভীর শোকের সঙ্গে দেখালেন, ঠিক কোথায় বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা হয়। আমি দেখলাম, হাসিনার মুখে তাঁর পিতৃহত্যার নৃশংস কাহিনি শুনতে শুনতে বাবার দু’চোখের কোণ চিকচিক করে উঠছে
বাধ-না-মানা জলে।

বিড়বিড় করে বাবাকে আওড়াতে শুনলাম, ‘‘জয় বাংলা।’’

আদ্যন্ত বাঙালি এই মানুষটিই কিন্তু আমার বাবা। লোকে যাঁকে শুধুই কিরীটী-জনক বলে চেনে!

অনুলিখন: অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

ঋণ: চন্দ্রিকা সেন

Nihar Ranjan Gupta Novelist
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy