Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

গোহ পালোয়ান

পুরো নাম গোবর গোহ। সাহেব মহলে পরিচয় ‘দ্য জেন্টল জায়ান্ট’। প্রবাদপ্রতিম এই মল্লবীরকে নিয়ে অবাক করা গল্পের অন্ত নেই। ১৩ মার্চ তিনি ১২৫। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য পুরো নাম গোবর গোহ। সাহেব মহলে পরিচয় ‘দ্য জেন্টল জায়ান্ট’। প্রবাদপ্রতিম এই মল্লবীরকে নিয়ে অবাক করা গল্পের অন্ত নেই। ১৩ মার্চ তিনি ১২৫। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

শোনা যেত, দেহের শক্তি বাড়ানোর জন্য তাঁর খাবারে মেশানো হত সোনা-রুপো!

শরীরচর্চা করতেন গলায় ১৬০ পাউন্ডের পাথর ঝুলিয়ে!

দশাসই পালোয়ান। অথচ অতি বিনয়ী, সুবক্তা। ভালবাসতেন সেতার বাজাতে!

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আর ষাটের দশকের বেশ ক’বছর দেদার পেশাদার দঙ্গল বসত রনজি স্টেডিয়ামে।

যে কুস্তিকে ডাকা হত আমেরিকান ফ্রি-স্টাইল বা শুধুই ফ্রি-স্টাইল। আর বালক, কিশোর, নব্য যুবার ঠোঁটে ঠোঁটে ঘুরত রুস্তম-এ-হিন্দ, দারা সিংহ, কিং কং, ওয়াদি আইয়ুব, সৈয়দ সৈফ শাহ গোছের সব পালোয়ানের নাম।

অথচ হাজার চেষ্টাতেও আমরা টলাতে পারিনি আমাদের জ্যাঠা-খুড়োর প্রজন্মকে। হরিনামের মতো তাঁদের জিভে লেগে ছিল একটাই নাম— গোবর গোহ।

তখন শোনা যেত, পেশাদার কুস্তির চ্যাম্পিয়ন লু-থেজ-এর সঙ্গে নাকি দু’বার ড্র করেছিলেন দারা সিংহ। তবে এই পর্যন্তই। কোথায় কী বৃত্তান্ত কিছুই জানতাম না। আমাদের সব আমোদ-আস্ফালন ছিল দারা-কিং কং মোকাবিলা নিয়ে।

কিন্তু আমাদের কাকা-জ্যাঠারা কাগজপত্তর বের করে দেখিয়ে দিতেন, গোবর গোহ ১৯২১-এর ২৩ অগস্ট সান ফ্রানসিসকোর কলিসিয়াম স্টেডিয়ামে জার্মান কুস্তিগির আড সান্টালকে চিৎ করে বিশ্ব পেশাদার লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। তার আগে, ১৯১৩-য় রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ ঘোষণার সামান্য আগে, ৩ সেপ্টেম্বর এডিনবরায় বিশালদেহী জিমি এসনকে ৩৯ মিনিটে চিৎ করে ব্রিটিশ এম্পায়ার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন। খেতাব সহ পেয়েছিলেন দেড় হাজার পাউন্ড ছাড়াও টিকিট বিক্রির সত্তর শতাংশ টাকা।

কাকা-জ্যাঠাদের মুখে যখন এই সব চাঞ্চল্যকর তথ্যের চর্চা চলত, তখনও কিন্তু উত্তর কলকাতার ১৯ নং গোয়াবাগান স্ট্রিটে একটা চৌচালা টালির চালার নীচে গোবরবাবু তাঁর প্রসিদ্ধ কুস্তির আখড়ায় নিজের কাঠের চেয়ারে স্বমহিমায় আসীন। বলা উচিত, স্বরাজ্যে স্বরাট।

কত গল্প তাঁকে নিয়ে বয়স্ক বাঙালির মুখে তখন। তাঁর ভাল নাম যতীন্দ্রচরণ গোহ আর ক’জন উচ্চারণ করে! গোবর গোহ তো গোবর গোহই। শক্তির প্রসঙ্গ উঠলে যেমন চলে আসে স্যান্ডোর নাম, বড় ও ছোট গামা, গোলাম পালোয়ান, করিম বখশের কথা, তেমনই বাঙালির গৌরব এক ও অদ্বিতীয় গোবরবাবুর লীলাকীর্তন। বড় বাঙালির নাম করতে হলে তাঁরা কর গুনে বলতে থাকেন সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা, উদয়শঙ্কর, যামিনী রায়, আলাউদ্দিন খান, ভীষ্মদেব, গোবর গোহ...

গোবরবাবুর আখড়ার থেকে দু’গলি পেরিয়ে ৪নং ঈশ্বর মিল লেন। সেখানে নিবাস বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথের, যিনি মাঝেমধ্যেই আখড়ায় চলে আসেন, চা নিয়ে আড্ডায় বসতে। তা নিয়েও গপ্পো কিছু কম না। আসলে ফ্যাকড়া, এলেই গোবরবাবু ছেলে রতনকে দেখিয়ে বলেন, ‘‘ওর মগজে একটু অঙ্ক কষে দিন তো।’’ তখন সত্যেন বোসে আচ্ছন্ন রতন পালায় কোথায়!

গোবর গোহ মানেই কিন্তু গল্প, গল্প আর গল্প। সে-সবে যাওায়ার আগে মার্ক্সবাদী নেতা হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের একটা ছোট্ট স্মৃতি তুলে দিই। হীরেনবাবু লিখছেন: ‘‘১৯২৭-২৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ইউনিয়নের সম্পাদক রূপে আমি তাঁকে নিমন্ত্রণ করে কলেজে আনি। তিনি এলেন— ‘ব্যূঢ়োরস্ক বৃষস্কন্ধ শালপ্রাংশু মহাভুজ’— বিরাট তাঁর মূর্তি ও ব্যক্তিত্ব, পরনে বাঙালির ধুতি পাঞ্জাবি শাল (এটা এমন সময় যখন কলেজের অধ্যাপকরাও প্রায় সকলে ‘সাহেবি’ পোশাক পরতেন!) বাঙালি জীবনে গর্বের একটা বিস্মৃত অধ্যায়...।’’

তবে গোবর গোহ বলতে যে-চেহারাটা সব বাঙালির চোখে ভাসে, সেটা ১৯২১-এ স্যান্ডো গেঞ্জি আর শর্টস পরে আমেরিকায় তোলা কুস্তির পোজের ছবি। ছ’ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার ঊনত্রিশ বছর বয়সি দৈত্যাকার গোবরবাবুর ওজন তখন ২৩০ পাউন্ড। গলা ২০ ইঞ্চি, হাতের গোছা ১৫ ইঞ্চি, কব্‌জি পৌনে ৯ ইঞ্চি, বুক ৫০ ইঞ্চি, বুক (ফোলালে) ৫২ ইঞ্চি, ঊরু ৩৩ ইঞ্চি, পায়ের ডিম সাড়ে ১৮ ইঞ্চি। এই দশাসই চেহারার মধ্যেও যা চোখ ও মন কাড়ে তা মুখমণ্ডলের প্রশান্তি, চোখের চাহনির সৌন্দর্য। অবাক লাগে, এহেন মানুষটিকে নিয়েই সে-সময় আমেরিকায় মস্ত স্টোরি বেরোল ক্যানসাস সিটি পোস্ট পত্রিকায় এই হেডিং-সহ: “Invasion of ‘Hindu Menace’ breeds fear among matmen.” হিন্দু আক্রমণে কুস্তিগিররা থরহরি কম্প।

সদ্য খেতাব হারানো মার্কিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এড ‘স্ট্র্যাংগলার’ লুইসের সঙ্গে গোবরের লড়াইয়ের আগে দেশ জুড়ে একটা তুমুল উত্তেজনা। তত দিনে অপরাজিত গোবরকে নিয়ে একটা আতঙ্কই প্রায় ছড়িয়ে গেছে দঙ্গল মহলে। সমানে লেখালেখি হচ্ছে বহিরাগত হিন্দু কুস্তিগিরের গুপ্ত প্যাঁচপয়জার নিয়ে। তাঁর আহারে সোনা ও রুপোর চূর্ণ মেশানো নিয়ে। সব কিছুর মধ্যেই একটা গেল-গেল ভাব! এতটাই যে, শেষ অবধি এক যুবতী মার্কিন কুস্তি বিশেষজ্ঞ লোরি প্র্যাটকে গোবরের পক্ষ নিয়ে কলম ধরতে হল গোবর-লুইস লড়াইয়ের আগে।

তাঁর বক্তব্য: ‘গোবর কোনও ভাঁওতা নয়। শুধু সোনার গুঁড়োর খেল নয়। ওঁর আসল শক্তি শ্বাস নিয়ন্ত্রণে।’ লোরি প্র্যাটের সেই রচনা থেকে একটু উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি না। লিখছেন:

‘‘গোবর গোহকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় যা চলছে, তা এক কথায় ভয়ঙ্কর। আর তার একটাই কারণ— মানুষটা বড়ই বিনয়ী। কাগজে কাগজে তাঁর জমকালো পোশাক নিয়ে ছবি বেরোচ্ছে, তাঁর জেতার অভ্যাস নিয়ে লেখা হচ্ছে, তাঁর রোজকার খাওয়ার মধ্যে সোনা রুপোর গুঁড়োর কথা থাকছে, আর থাকছে তাঁর গলায় মস্ত পাথরের ভার চাপিয়ে ব্যায়ামের কেত্তন। অথচ গোবর মানুষটা বাস্তবত এক লজ্জাবতী লতার মতো। আমি এই গোবরকে নিয়েই লিখতে চাই।’’

সে-লড়াইয়ে বলা বাহুল্য, গোবর পা ধরে লুইসকে এক ঘণ্টার মধ্যে আছড়ে ফেললেন রিংয়ে। তার পর দুটো কাঁধ চেপে ধরলেন জমিতে। গোটা লড়াই ধরে গোবরই আগ্রাসী ছিলেন, এবং যে-সাবলীল কেতায় তিনি লুইসকে পা ধরে লটকালেন তা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সিবিস্কোর প্রয়োগ করা টো-হোল্ড প্যাঁচের চেয়েও চটকদার ছিল। ওই টো-হোল্ডেই কয়েক মাস আগে লুইসকে কাত করে বিশ্ব খেতাব জিতে নিয়েছিলেন সিবিস্কো।

এই শক্তিশালী সিবিস্কোকেও হারতে হয়েছিল গোবরের কাছে। এ ছাড়া ছোট গামার সঙ্গেও ওঁর লড়াইয়ের বৃত্তান্তে যেতে হবে। তার আগে অবশ্য ওঁর বংশ পরিচয় ও নানা বিষয়ে ওঁর অদ্ভুত প্রতিভার কথা একটু শোনালে মন্দ হয় না।

গোবর গোহোর বংশ লতিকায় যাঁর প্রথম উল্লেখ পাচ্ছি আমরা, তিনি ব্রজরাম গুহ (ইংরেজরা মিঃ গোহো ডেকে তাঁর পদবি গোহো করে দেন)। বুদ্ধিমান ও উচ্চাভিলাষী ব্রজরাম যশোহর জেলার ইটিন্ডাঘাটে তাঁর পিত্রালয় ছেড়ে কলকাতায় এসে সাহেবদের মুৎসুদ্দির কাজ ধরেন। এবং অনতিকালে প্রভূত অর্থোপার্জন করে উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়ায় প্রচুর সম্পত্তি কিনে স্থায়ী বাসিন্দা হন।

ব্রজরাম গোহো (১৭৬৩-১৮০০) বেশি দিন বাঁচেননি, কিন্তু তাঁর বংশধরেরা জমিদারি ও সম্পদ সুরক্ষিত রেখেছিলেন। বিশেষত পুত্র শিবচরণও (১৭৯৩-১৮৭৪) মুৎসুদ্দির কাজে পর্যাপ্ত অর্থ করেছিলেন। এই শিবচরণের নাতি অম্বিকাচরণের (১৮৪২-১৯০১) হাত ধরেই ডন-কুস্তির নেশা ঢোকে গোহো পরিবারে। নাতির নতুন নেশায় শিবচরণের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় ও বিপুল অর্থব্যয় ডন-কুস্তিকে কালে কালে সম্ভ্রান্ত গোহো বাড়ির এক কালচারে পরিণত করে।

মথুরা থেকে বীর হনুমানের এক পাথরের মূর্তি আনিয়ে ৬৫ মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে আখড়া বসালেন শিবচরণ, আর ওই মথুরারই বড় পালোয়ান কালী চৌবেকে আখড়ার গুরু করলেন।

গোহোদের এই আখড়ার চালচলন কলকাতার অবাঙালি আখড়ার থেকে বেশ স্বতন্ত্র ছিল। চল্লিশটা গরু ও তিরিশটা ছাগলের এক খাটালও তৈরি হয়েছিল শিক্ষার্থীদের দুধ জোগাতে। ডন-কুস্তির নেশাটা ক্রমে উত্তর কলকাতার ভদ্র ও অভিজাত পরিবারে চারিয়ে যায়।

অম্বিকাচরণ চমৎকার তালিম নিয়ে, রেওয়াজ করে আঠারো-বিশ বছর বয়সের মধ্যেই প্রথম শ্রেণির পালোয়ান হিসেবে সমাদর পান। বড় পালোয়ান হয়েও কুস্তিকে পেশা করেননি বলে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের পালোয়ান মহলে ওঁর বেশ সম্মান ছিল। এক সময়কার মল্লসম্রাট বুটা তাঁর নওজোয়ান শিষ্য করিম বখশ্‌কে নিয়ে অম্বিকাচরণের আখড়ায় এসেছিলেন।

কুস্তিতে তাঁর অবদানের জন্য পালোয়ান মহলে তত দিনে তাঁকে ডাকা শুরু হয়েছে ‘রাজাবাবু’।

এই ‘রাজাবাবু’-র চতুর্থ পুত্র ক্ষেত্রচরণ (ক্ষেতুবাবু ডাকনামেই প্রসিদ্ধ) গোহো ঘরানার কুস্তিকে ক্রমপ্রসারিত করেন।

ডাকসাইটে পালোয়ান গোলামের শিষ্য কাদরা-কে কুড়ি মিনিটের লড়াইয়ে চিৎ করেছিলেন।

যদিও কুস্তিতে ক্ষেতুবাবুর সেরা স্বাক্ষর থেকে গেল ভাইপো বিশ্ববিশ্রুত গোবর ছাড়াও বিপ্লবী মহানায়ক যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভীম ভবানীর মতো পালোয়ান
তৈরি করায়।

ক্ষেতুবাবু গোবরকে তৈরি করতে গিয়ে দেখেন যে, পনেরো বছর বয়সেই দু’ঘণ্টার কুস্তিতে ওঁর কোনও দমই খরচ হয় না।

কাজে কাজেই রেওয়াজের জন্য অমৃতসর থেকে রহমান ওস্তাদকে আনা হল। তাতেও পাঁচ-ছ’ঘণ্টার কোস্তাকুস্তির সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তখন বিখ্যাত মল্ল কল্লুর শাগরেদ গুর্তা সিংহকে আনানো হল। আর পুরো ব্যাপারটার তদারকির জন্য নিয়োগ করা হল লাহোরের ওস্তাদ বগলা খলিফাকে।

সতেরো-আঠারো বছরেই গোবরের ব্যায়াম-কুস্তির চেহারাটা অদ্ভুত দাঁড়িয়ে গেল। রোজ ছ’ঘণ্টা ডন-কুস্তি করেও ক্লান্তির নামগন্ধ নেই। দু’আড়াই হাজার বৈঠকেও কিছু হয় না। তাই গলায় একটা ১৬০ পাউন্ড ওজনের পাথরের হাঁসুলি পরতে হয়। তখন তাঁর দু’জোড়া মুগুরের এক জোড়ার প্রতিটির ওজন ২৫ সের। অন্য জোড়ার প্রত্যেকটার ওজন এক মণ দশ সের করে।

এই শক্তিচর্চার দীর্ঘপ্রসারী সুফল কী দাঁড়াতে পারে তা নিয়ে আমার কাকার মুখে শোনা একটা গল্প এখানে শোনাতে পারি। গোবরবাবুর তখন পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি বছর বয়স। গোয়াবাগানের আখড়ায় নিত্যদিন চেয়ারে বসে ছেলেদের ডন-কুস্তির ওপর চোখ রাখেন। তো এক দিন এক সুঠামদেহী ছোকরা এসে প্রণাম করে বলল, ‘‘স্যার, একটু কুস্তি শিখতে পারি?’’ গোবরবাবু মুখের মোটা লম্বা চুরুটটা (শেষ বয়সে এটাই ওঁর আরাম আর বিলাসিতা ছিল) বাঁ হাতে নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘‘আলবৎ শিখবি! তার আগে আমার ডান পাশে একটু দাঁড়া।’’

ছেলেটি ওঁর ডান পাশে ঘেঁষে দাঁড়াতে গোবরবাবু বসে বসেই নিজের ডান হাতটা ওর বাঁ কাঁধে রেখে আস্তে আস্তে চাপ দিতে লাগলেন। সেই চাপে ছেলেটি দেখতে দেখতেই বসে পড়ল।

গোবরবাবু হেসে বললেন, ‘‘বডি ঠিক আছে, তবে জোর বাড়াতে হবে। সময় করে ঠিকঠাক আয়, ডনবৈঠক কর। তার পর কুস্তি ধরে নিবি।’’

গোবর গোহর কিংবদন্তি গড়ে দিয়েছিল যে-সব লড়াই, তার প্রায় সবই সে কালের সেরা মার্কিন ও ইউরোপীয় কুস্তিগিরদের সঙ্গে লড়ে। জীবনের দশ-দশটা বছর তিনি বিদেশে লড়ে কাটিয়েছিলেন, যার শুরু ১৯১০-এ, বয়স যখন নিতান্ত আঠারো।

বড় বংশের ছেলে হয়েও গোবর কুস্তিকে পেশা করতে পিছ-পা হননি। তবে ভারতীয় মল্লমহলের প্রথানুযায়ী গুরু-শিষ্যে, শিষ্যে-শিষ্যে কি একই ঘরানার একজনের সঙ্গে আরেক জনের লড়া বারণ। তাতে অনেক বড় পালোয়ানের সঙ্গে ওঁর মোকাবিলায় বাধা পড়ছিল। তখন রাস্তা বার করার জন্য ভগ্নিপতি শরৎকুমার মিত্রকে নিয়ে গোবর লাহোর রওনা হলেন রহিম ওস্তাদ ও গামা পালোয়ানের তিন নম্বর মোলাকাত দেখার জন্য। সেটা ১৯৯০-এর ফেব্রুয়ারিতে। আগের দুটির মতো সেটিও ড্র হল।

কুস্তি দেখে শরৎবাবু ফিরে এলেন, কিন্তু গোবরবাবু এলেন না। তিনি আহমদ, গামা, ইমাম এবং গামু জলন্ধরিয়াকে নিয়ে একটা দল গড়ে ওখান থেকে লন্ডন পাড়ি দিলেন। এবং লন্ডন পৌঁছেই সাহেব ম্যানেজার নিয়োগ করলেন। এবং সরকারি ভাবে ঘোষণা করলেন যে, এই দল যে-কোনও চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত।

এই প্রথম সফরে দারুণ ছাপ ফেলে দিয়েছিল ভারতীয় দল। দাঁড়ানো মাত্র লটকে পড়েছিল সাহেব পালোয়ানরা। কপাল মন্দ সে বার গোবরবাবুর। শ্বেতাঙ্গরা যখন কালোদের ভয়ে কাঁপছে, এবং নতুন নতুন লড়াইয়ের চুক্তি সই হচ্ছে তখনই টেলিগ্রাম গেল কলকাতা থেকে,‘‘ফিরে এসো, মা অসুস্থ।’’

গোবরের অনুপস্থিতিতে অবশ্য গামা, ইমাম আর আহমদ বখশ দুর্ধর্ষ লড়েছিলেন সে বার ইংল্যান্ডে। সুন্দর, ফর্সা চেহারার জন্য গামা বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন। আমেরিকা থেকে বেনজামিন রোলার ইংল্যান্ড চলে আসেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে দু’-দু’বার চিৎ হন গামার প্যাঁচে। তখন শ্বেতাঙ্গদের মান বাঁচাতে লড়াই ডাকা হয় গামার সঙ্গে পোল্যান্ডের স্তানিস্‌লস্ সিবিস্কোর। প্রথম বার পরাস্ত হয়ে দ্বিতীয় বার গা ঢাকা দিলেন সিবিস্কো। তাই দ্বিতীয় বার যখন গোবরবাবু লন্ডন এলেন ১৯৬২-তে তত দিনে ওখানে একটা রহস্যের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়ে গেছে ভারতীয় মল্লদের ঘিরে। গোবরের দ্বিতীয় আবির্ভাবে সেই রহস্য বহু গুণ ঘনীভূত হল।

ইউরোপ ও মার্কিন মল্লমহল দেখল প্রবল শক্তি ও জটিল প্যাঁচের পাশাপাশি এই বিনয়ী, ভদ্র মানুষটি দারুণ বক্তৃতা করেন নিখুঁত উচ্চারণে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে। প্রিয় লেখকদের মধ্যে উল্লেখ করেন রবীন্দ্রনাথ, বার্নার্ড শ’, অস্কার ওয়াইল্ডের নাম। ‘নিউ ইয়র্কের মডার্ন আর্টস অ্যান্ড লেটার্স-এ তো দীর্ঘ বক্তৃতাই দিলেন রবীন্দ্রনাথের জীবন ও বাণী নিয়ে। সেই ভাষণের বিষয়-গুরুত্ব ছাড়াও ওঁর ভাষাও প্রশংসা পায় পত্রপত্রিকায়। একটা নতুন নামও জোটে ভারতীয় পালোয়ানের— ‘দ্য জেন্টল জায়ান্ট’।

এই দৈত্যের পাল্লায় পড়ে এক সময় পাশ্চাত্যের সব বড় পালোয়ানকেই নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে। এড ‘স্ট্র্যাংগলার’ লুইসের কথা আগেই বলেছি। সেই লুইসকে হারিয়ে যিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন, সেই জো স্ট্রেখারকেও হারালেন গোবর। অবশ্য তত দিনে স্ট্রেখারও আর চ্যাম্পিয়ন নেই, তিনি খেতাব হারিয়েছেন স্তানিস্‌লাস্ সিবিস্কোর কাছে। এই সিবিস্কোর সঙ্গে দুই মোলাকাতে একবার হেরে একবার জিতেছিলেন গোবরবাবু।

বস্তুত কাকেই বা হারাননি গোবর? স্কটল্যান্ডের জিমি ক্যাম্বেল, গ্রিসের বিল দেমেত্রালস, জার্মানির কার্ল সাফ্‌ট, বোহেমিয়ার জো শুল্‌জ, বেলজিয়ামের জ্যানসন, সুইডেনের লুনডিন, বুলগেরিয়ার গ্রানোভিচ, তুরস্কের মেহমুত...।

১৯২১-এর ১৮ অক্টোবরে শিকাগোর এক পত্রিকায় হেডলাইন দেখছি সেই প্রবাদপ্রতিম স্যান্ডো (১৮৬৭-১৯২৫) গোবরের লড়াই দেখে মন্তব্য করছেন ‘‘গোবর ইজ অ্যানাদার মেহমুত।’’ মসৃণ প্যাঁচ ও প্রবল ঝটকার জন্য মেহমুতের বেজায় নাম তখন বিশ্ব কুস্তিতে।

তবে যে-ছোট গামা ও গোবরের কুস্তি নিয়ে দীর্ঘকাল চর্চা শুনে আসছি আমরা, তার ফলাফল নিয়েও বিশেষ কৌতূহল থাকার কথা নয়। তিন ভাই গোলাম, কল্লু ও রহমানের মধ্যে মধ্যম জন কল্লুর পুত্র ছোট গামা (জন্ম ১৮৯৯) মারপিট ও জঙ্গিপনাতেও অভ্যস্ত ছিলেন। গোবরবাবুর ঘনিষ্ঠ ও তাঁর জীবনীকার সমর বসু মনে করেন না, ছোট গামা গোবরের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।

মুর্শিদাবাদের নবাব স্যার ওয়াশিক আলি মির্জা খাঁ সাহেবই ছোট গামার সঙ্গে গোবরের কুস্তির প্রস্তাব দেন, অথচ সে-কুস্তিতে না রাখা হল রেফারি, না টাইমকিপার। বস্তুত নিয়মের বালাই রইল না। গোবরবাবু হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়াতেই ছোট গামা ওঁকে ধাক্কা মেরে মেরে দড়ির
ওপর নিয়ে ফেললেন এবং নিজেও দড়ির ওপর গিয়ে পড়লেন। তার পর ‘জিত গয়া!’ হুঙ্কার দিয়ে রিং থেকে নেমে গেলেন। বাঁশি বাজিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হলে অন্য দিকে
মুখ করে দাঁড়ানো গোবরকে ধাক্কা মেরে ছোট গামার দিক থেকে চিৎকার ‘জিত গ্যয়া!’

কুস্তির এই প্রহসন দিয়ে গোবরবাবুর গুরুত্ব মাপা যায় না। সত্যিই তো, এত বড় মল্ল বাংলায় তো আর হল না। শেষ বয়সে এটাই বড় আফসোস রয়ে গেল তাঁর। জুডো, ক্যারাটের শখ হল, বাঙালি ছেলে-ছোকরাদের (কুংফু-র নাম তখনও ছড়ায়নি অতটা) মধ্যে, কিন্তু ডন-কুস্তির হাল ধরল না কেউ। ডন-কুস্তি করেও যে সেতার বাজানো যায় এ তো তিনি নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়েছিলেন।

সে কথাটিই তাঁর শ্রাদ্ধবাসরে ‘গোবরস্মরণে’ স্মৃতিগ্রন্থ প্রকাশ করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বন্ধু বিজ্ঞানী ও এস্রাজ বাজিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gobar Guha The Gentle Giant
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE