Advertisement
E-Paper

আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি…

এ ছিল তাঁর ভূতে পাওয়া গান। কাজী নজরুলকে তিনি ফিরিয়েছিলেন বাঙালির ঘরে। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মঙ্গলবার তিনি পঁচাশি। লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়‘‘আপনাকে একটু খারাপ করে গাইতে হবে।’’ ​স্বয়ং ছবির পরিচালকের এমন কথায় আকাশ থেকে পড়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ‘দেয়া নেয়া’ ছবির গান। ‘দোলে দো দুল দোলে ঝুলনা’। তারই রেকর্ডিং-এর আগে রিহার্সাল। সঙ্গীত পরিচালক শ্যামল মিত্র আছেন। ইউনিটের অন্যরাও উপস্থিত। তারই ফাঁকে অমন বজ্রপাত। ‘‘মানে! কেন? কী বলছেন আপনি!’’ পরিচালকের যুক্তি, ‘‘আসলে ছবিতে নায়ক (উত্তমকুমার) গান জানেন। তাঁর বন্ধু (তরুণকুমার) গাইতে পারেন না। গল্পে এমনই বলা আছে। নায়কের গানটা শ্যামলবাবুর (মিত্র)। আপনি গাইছেন বন্ধুর লিপে।’’

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
ছবি: সমর দাস

ছবি: সমর দাস

‘‘আপনাকে একটু খারাপ করে গাইতে হবে।’’

স্বয়ং ছবির পরিচালকের এমন কথায় আকাশ থেকে পড়েছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
‘দেয়া নেয়া’ ছবির গান। ‘দোলে দো দুল দোলে ঝুলনা’। তারই রেকর্ডিং-এর আগে রিহার্সাল।
সঙ্গীত পরিচালক শ্যামল মিত্র আছেন। ইউনিটের অন্যরাও উপস্থিত। তারই ফাঁকে অমন বজ্রপাত।
‘‘মানে! কেন? কী বলছেন আপনি!’’
পরিচালকের যুক্তি, ‘‘আসলে ছবিতে নায়ক (উত্তমকুমার) গান জানেন। তাঁর বন্ধু (তরুণকুমার) গাইতে পারেন না। গল্পে এমনই বলা আছে। নায়কের গানটা শ্যামলবাবুর (মিত্র)। আপনি গাইছেন বন্ধুর লিপে।’’
‘‘তা বলে খারাপ করে গাইতে হবে! তা হলে আমাকে ডেকেছেন কেন? আমায় বরং ছেড়ে দিন।’’
গম্ভীর হয়ে উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন মানবেন্দ্র। তখনই নায়ক উত্তমকুমারের প্রবেশ। কনট্রোল রুমে বসেছিলেন এতক্ষণ। এ ঘরের সব কথাই তাঁর কানে গেছে। ঢুকেই বললেন, ‘‘মানব, তুই উঠিস না।’’
মানবেন্দ্রর মনের অবস্থাটা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন তিনি। আলাপ তো আর এক দিনের নয়। যখন তিনি চলচ্চিত্রেরই ধারেকাছে নেই, তখন থেকেই। টালিগঞ্জের বাঙাল পাড়ায় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে তবলা শিখতে যেতেন সে দিনের অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। সে কত কাল আগে! সেই আলাপ আরওই জমে গিয়েছিল ‘সাড়ে ৭৪’-এ একসঙ্গে অভিনয় করায়।
ইউনিটের লোকজনের দিকে তাকিয়ে উত্তম বললেন, ‘‘দেখুন, গল্পটা তো রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের নয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়েরও নয়। একটু বদলে নিলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। নায়কের বন্ধুকে গায়ক করতে দোষ কী! মানবকে আপনারা ডেকেছেন, ও তো চাইবে ওর একশো ভাগ দিতে। যেমন আমার কাছ থেকেও আপনারা আশা করেন। ওর মতো এক জন গায়ক খারাপ করে কী করে গাইবে?’’

এই কথায় কাজ হল। ভাগ্যিস! নইলে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা দ্বৈত সঙ্গীতের যে কী হত, কে জানে!

সে-যাত্রায় বন্ধু উত্তম পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আবার সেই বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েও এক বার সঙ্গীত পরিচালনার কাজ থেকে সরে আসেন মানবেন্দ্র।

‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবি করবেন উত্তমকুমার। সঙ্গীত পরিচালনার জন্য ডাকলেন তাঁর ‘মানব’কে। প্রথম সিটিঙে গিয়ে মানবেন্দ্র দেখেন, তিনি একা নন। শ্যামল মিত্র সহ আরও জনা তিন-চার সঙ্গীতকার রয়েছেন।

পাশে স্ত্রী বেলাদেবী।

সবাই মিলেই একই ছবিতে একসঙ্গে সঙ্গীত পরিচালনা করবেন। ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি মানবেন্দ্রর। সরে দাঁড়ান। —‘‘এত অ্যামেচারিশ ব্যাপার আমার পোষাবে না।’’

অ্যামেচারিজম পছন্দ নয়। গানের সঙ্গে তাঁর জড়িয়ে পড়ার মধ্যে অদ্ভুত সব কাতরতা। আর তার জন্যই বোধ হয় অমন বিচিত্র ভাবে প্রথম বার সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

‘চাপাডাঙার বউ’। কাহিনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। চিত্রপরিচালক নির্মল দে নিজেই বললেন, ‘‘ছবিতে কাজ হতে পারে। কিন্তু তার আগে পরীক্ষা দিতে হবে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে।’’

তত দিনে প্লে-ব্যাকে অল্পবিস্তর নামধাম হয়েছে। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ ছোট্ট একটু আহির ভৈরো আলাপ গেয়ে পরিচালক নির্মলবাবুর মন ছুঁয়েছেন। তাতেই ওই প্রস্তাব।

যাওয়া হল তারাশঙ্করের টালা পার্কের বাড়ি। ব্যাঘ্রচর্মের ওপর বসে লাল ধুতি পরে লিখছেন তারাশঙ্কর। গলায় উপবীত। রুদ্রাক্ষ। আলাপ করিয়ে কথা পাড়তে মাথা না তুলেই নির্মলবাবুকে বলে দিলেন, ‘‘না, না হবে না। গল্পটা আমার খুব শক্ত। স্ক্রিপ্ট আমিই লিখছি। তুমি কোনও পাকা সঙ্গীত পরিচালককে আনো।’’

এর পর আর কোনও কথা নেই। কিছুক্ষণ বাদে নিজে থেকেই তারাশঙ্কর বললেন, ‘‘আচ্ছা, দু’কলম লিখে দিচ্ছি। সুর করো তো।’’

‘‘কিন্তু সিচ্যুয়েশনটা কী?’’

যুবক-সঙ্গীতকারের এ-কথায় সেই প্রথম বোধ হয় থমকেছিলেন কাহিনিকার। মুখে শুধু বললেন, ‘‘মহাতাপ (উত্তমকুমার) গাজনে শিব সেজে নৃত্য করছে।’’

গানের কথা হাতে নিলেন মানবেন্দ্র। — ‘শিব হে/অশিব শঙ্কর…।’

এর পরই ঢাকের তাল মাথায় রেখে কীর্তনের ঢঙে সুর বেঁধে গাইতে লাগলেন। একেবারে দাঁড়িয়ে উঠে।

কিছুক্ষণ বাদে দেখেন তারাশঙ্করও উঠে পড়েছেন। মুখে তাঁর তৃপ্তির হাসি। গান থামলে নির্মল দে-কে বললেন, ‘‘একদম ঠিক জনকেই এনেছ। এই-ই পারবে। আর কারও খোঁজ লাগবে না।’’

গানের জন্য এক দিকে আবেগী। অন্য দিকে বেপরোয়া। নাছোড়। সে একেবারে ছোট থেকেই।

ইন্টার কলেজিয়েট কম্পিটিশন। সেখানে কীর্তন, টপ্পা, ঠুংরির সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতে হবে। বাকিগুলো নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত?

বাড়ির পরিবেশ ভরপুর গানের, কিন্তু কোনও দিন রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা তেমন করা হয়নি। কাকা রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়। দিকপাল সঙ্গীতজ্ঞ। বললেন, ‘‘জর্জ বিশ্বাসের (দেবব্রত বিশ্বাস) কাছে যা। পারলে ওই তোকে গাইড করতে পারবে।’’

ভোরে লেকে জগিং করার অভ্যাস ছিল মানবেন্দ্রর। জর্জ বিশ্বাস তখন থাকতেন সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এ। দিনভর তাঁর বাড়ির দরজা খোলা। জগিং সেরে ঢুকে গেলেন দরজা ঠেলে। এলোমেলো ঘর। মশারি টাঙানো। ঘুমিয়ে আছেন দেবব্রত বিশ্বাস। সটান মশারি তুলে হাত দিয়ে তাঁকে ঠেলাঠেলি করতেই উনি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বললেন, ‘‘আপনি ভারী অসভ্য ইতর লোক তো! না বলে কয়ে ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত লোককে তুলে দিচ্ছেন!’’

ভয়ে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মানবেন্দ্র। বাড়ির কর্তা বিছানা ছেড়ে উঠে মুখ ধুয়ে জাঁতি হাতে সুপারি কাটতে কাটতে আড়চোখে খানিক চেয়ে দেখতে দেখতে বললেন, ‘‘মশায়ের কী করা হয়?’’

‘‘ছাত্র।’’

‘‘দেখে তো মনে হয় না ভাল কিছু কাজ করেন। তা আগমনের হেতু?’’

‘‘ইন্টার কলেজ কম্পিটিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হবে। আপনার কাছে শিখব।’’

‘‘প্রতিযোগিতা কবে?’’

‘‘আজ বিকেলে।’’

জর্জ বিশ্বাস শুনে বাক্যহারা। এ-ছেলে বলে কী!

‘‘আমার কাকা রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়। উনিই আপনার কাছে পাঠালেন।’’

এর পর সদয় হলেন জর্জ বিশ্বাস। গান শেখাতে বসলেন— ‘ধরা দিয়েছি গো আমি আকাশেরও পাখি’। কিছুক্ষণ বাদে জর্জ অফিসে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর বোনকে বলে গেলেন, ‘‘যতক্ষণ না ওঁর গানটা ঠিক হচ্ছে, ছাড়বি না।’’

সে আর আটকানো যায়নি। একটু বাদেই বোনের নিষেধ সত্ত্বেও চলে এসেছিলেন। কিন্তু বিকেলবেলা প্রতিযোগিতায় গিয়ে চমকে গেলেন। বিচারকদের চেয়ারে শৈলজারঞ্জন মজুমদার, অনাদি দস্তিদারের পাশে স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাস! মানবেন্দ্রকে দেখে উনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। প্রতিযোগিতায় তাঁকে তিনি কোনও নম্বরও দেননি। কিন্তু সবার বিচারে প্রথম হলেন মানবেন্দ্রই।

এর পর আবার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে দেখা করতে যেতেই জর্জ বললেন, ‘‘শুনুন, আপনাকে একটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে। এই আপনার প্রথম আর শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া। এ লাইন আপনার নয়।’’

সেই থেকে পারতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের গানের ধার মাড়াননি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণনের সামনে।

গান নিয়ে ওঁর প্যাশনটা যে কী পর্যায়ের ছিল! কত বার হয়েছে, রেকর্ডিং করতে বসে কখনও সুরের গমকে কেঁদে ফেলেছেন। আবার সুর আসছে না, কথা ভাল লাগছে না বলে উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, এমনও হয়েছে।

এক বার এমনই এক কারণে সুরকার নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে বড়সড় ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যাচ্ছিল প্রায়।

সে বছর পুজোয় বিখ্যাত এক গানের মহলা। ‘বনে নয় মনে মোর’। রেকর্ডিং হবে একটু পরেই। অথচ নচিকেতার তৈরি মুখড়টা কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না।

শেষে তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দীকে মানবেন্দ্র বললেন, ‘‘তুই একটা টুকরো বাজা তো।’’ বাজালেন রাধাকান্ত। সেটাই গানের মুখে লাগালেন।

এ বার মানবেন্দ্র-রাধাকান্ত দু’জনেরই খুব পছন্দ হল। নচিকেতা গেলেন রেগে। তক্কাতক্কি করে উঠেই গেলেন মহলা ছেড়ে।

মহলা কিন্তু থামল না। রেকর্ডিংও হল। এই পুরো সময়টা বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার অলক্ষ্যে গান শুনেছিলেন নচিকেতা। ধীরে ধীরে গানটা ওঁর মনে ধরে গেল। শেষে এসে জড়িয়ে ধরলেন মানবেন্দ্রকে।

*****

‘মায়ামৃগ’র গান বাঁধা হচ্ছে। গীতিকার শ্যামল গুপ্ত। মানবেন্দ্রর বহুকালের বন্ধু। যখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শ্যামলের বিয়ে হয়নি, তখন থেকেই তাঁরা হরিহর আত্মা।

এই বন্ধুতা শুধু দু’জনের নয়, সম্পর্ক ছিল পরিবারে-পরিবারে। তা যে কতটা ঘন, বোঝাতে দুই বাড়ির একটা রীতির কথা বলা যেতে পারে।— প্রত্যেক বছর অক্ষয় তৃতীয়ায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নর্থ রোডে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে যেতেন। এক কুঁজো জল, এক থালা ফল আর মিষ্টি নিয়ে। এ প্রথা কবে শুরু হয়েছিল বলা মুশকিল, কিন্তু চলেছিল মানবেন্দ্রর জীবনের একেবারে প্রান্তবেলা অবধি।

মায়ামৃগ-র সময় শ্যামল গুপ্তকে মানবেন্দ্র বললেন, ‘‘নায়ক বিশ্বজিৎ নায়িকা সন্ধ্যা রায়ের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু নায়কের সব কথাতেই ডাক্তারির প্রসঙ্গ এসে পড়ে। এমনকী প্রেম নিবেদনের সময়ও তাই। এটাকে মাথায় রেখে একটা গান লেখ।’’

মানবেন্দ্র তখন ফার্ন রোডে ‘গীতবীথিকা’ নামে একটি স্কুলে গান শেখান। ক্লাসের পর সেখানে বন্ধু শ্যামলের সঙ্গে গান-আড্ডাও হয়।

তেমনই এক রবিবারের বিকেলে শ্যামল গুপ্ত হাজির হলেন ফার্ন রোডে। সঙ্গে গান— ‘মেটেরিয়া মেডিকার কাব্য’। দেখে বললেন, ‘‘ছ্যা, এ কী লিখেছিস! এ একেবারে চলবে না। গান লেখা টুকরো কাগজটা হাতে নিয়ে মুচড়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন জানলা দিয়ে। বন্ধু আর কী করেন! মুষড়ে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়লেন।

ঘণ্টা দুই গড়াল। গানের ক্লাস শেষ। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে মানবেন্দ্র দেখলেন বন্ধু পাংশুমুখে বসে। বললেন, ‘‘নারে, গানটা তুই মন্দ লিখিসনি। দেখি এক বার!’’

এ বার রাগে-অভিমানে শ্যামল বললেন, ‘‘তুই তো ফেলে দিলি রাস্তায়। আমার কাছে কোনও কপিও নেই। ট্রামে আসতে আসতে হাতে যা ছিল, তার ওপরে লিখেছিলাম…।’’

তা হলে?

তখন সন্ধে নেমে গেছে। রাস্তায় আলো প্রায় নেই। টর্চ হাতে তোলপাড় খোঁজ চলল তার মধ্যেই। শেষে দলা পাকানো টুকরো কাগজটার খোঁজ মিলল নর্দমার পাশে। এর পর ‘মেটেরিয়া মেডিকার’ জনপ্রিয়তা তো আকাশ ছুঁয়ে যায়। যেখানে অনুষ্ঠানে যেতেন, ‘মেটেরিয়া’ না শুনিয়ে রেহাই নেই। গানের লিপ দিতে মঞ্চে ডাক পড়ত বিশ্বজিতের।

এই শ্যামল গুপ্তরই লেখা ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’। মানবেন্দ্র বলতেন, ‘‘ও আমার ভূতে পাওয়া গান।’’

তখন রেডিয়োয় লাইভ ব্রডকাস্টের যুগ। ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেস থেকে ইডেনে আসেনি আকাশবাণী। এক অনুষ্ঠান শেষে পরের অনুষ্ঠানের মাঝে অনেকটা ফাঁকা সময় থাকলে অফিসেই কাটিয়ে দিতেন অনেকেই।

তেমনই এক দিনে ছাদে পায়চারি করতে করতে গুনগুন করে গান গাইছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। নিঝুম সন্ধেবেলা। ঠিক নীচে কবরখানার দিকটা জমাট কালো। ও-বাড়ির সাহেব-ভূতের গল্প বহুশ্রুত। তাতে ভ্রুক্ষেপ ছিল না তাঁর।

হঠাৎ কেউ যেন ডেকে উঠল, ‘‘মানব, মানব।’’ চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখেন দুটো চোখ। জ্বলছে।— ‘‘কে?’’

‘‘আমি শ্যামল। একটা গান লিখে ফেলেছি। শুনবি?’’

একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘‘বল।’’

অন্ধকারে দাঁড়িয়েই শুনতে লাগলেন গানের কলি— ‘‘…তোমার কাজল চোখে যে গভীর ছায়া কেঁপে ওঠে ওই/তোমার অধরে ওগো যে হাসির মধু মায়া ফোটে ওই/তারা এই অভিমান বোঝে না আমার…।’’

সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। শেষ হতেই এক হাতে বন্ধুকে পাকড়ে ধরে সোজা পাঁচ নম্বর স্টুডিয়ো। ওখানে একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো রাখা। সন্ধে পাঁচটার পর সে-ঘরের দরজা তালাবন্ধ থাকে। পিয়ানোর ডালায় চাবি দেওয়া। কিন্তু সে দিন যে কী হল!

দরজার ‘ল্যাচ’ ঘোরাতেই খুলে গেল! ডালায় হাত দিয়ে ওঠাতে উঠে গেল! তাতে বসেই গানের মুখড়াটা করে ফেলেছিলেন মানবেন্দ্র।

পুরো ব্যাপারটা নিয়ে বিস্ময়ের ঘোর জীবনের শেষ দিন অবধি তাঁর কাটেনি। কেবলই বলতেন, ‘‘ও আমার ভূতে পাওয়া গান।’’

মেহদি হাসানের সঙ্গে।

মেহদি হাসানের গজলের পাগল-ভক্ত ছিলেন। উল্টো দিকে মেহদি হাসান?

রবীন্দ্রসদনে গাইতে এসেছেন। তার আগে শুনেছেন কলকাতায় আরেকজন ‘মেহদি হাসান’ আছেন। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে আলাপ করার খুব শখ। সংগঠকরা সে কথা জানতেন।

দর্শকাসনে মানবেন্দ্রকে বসতে দেখে তাঁরা মেহদিকে জানাতেই মঞ্চ থেকে উনি বলে উঠলেন, ‘‘মানবেন্দ্রজি, আপনি একবার উঠে দাঁড়ান। আমি একবার অন্তত আপনাকে দেখতে চাই।’’

প্রায় একই রকম ছিল লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ওঁর পরিচয়-পর্ব। কলকাতায় ‘হোপ এইট্টিসিক্স’। সারা ভারতের বহু নামী শিল্পীদের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরও এসেছেন। গ্রিনরুমে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। হাতজোড় করে প্রণাম করে নাম বলতেই, লতাজি ভ্রু তুলে চমকে উঠে বললেন, ‘‘মানবেন্দ্রজি, আপ উও গানা গায়ে থে! হাম তো কুচভি নেহি গা পায়ে।’’

কী ব্যাপার?

এর আগে সলিল চৌধুরীর সুরে অসম্ভব শক্ত তাল-লয়-সুরের দুটি গানের রেকর্ড করেন মানবেন্দ্র। যার এক পিঠে ‘যদি জানতে গো’। অন্য পিঠে ‘আমি পারিনি বুঝিতে পারিনি’। এর যখন হিন্দি ভার্সান করতে যাবেন, লতা মঙ্গেশকরের কাছে গিয়েছিলেন সলিল। গান শুনে লতাজি বলেছিলেন, ‘‘সলিলদা, এ অসম্ভব। এ কেউ গাইতে পারবে না।’’ উত্তরে সলিল চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘এ গান অলরেডি বাংলায় রেকর্ডেড। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের।’’

সেই বাংলা গান শুনে লতা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন, প্রথম আলাপে তাই ওঁর ওই কথাটাই মনে পড়ে যায়।

মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সুর মানেই জটিল। অথচ তিনি নিজে যখন সেই একই গান গেয়ে ওঠেন মনে হয়, এর চেয়ে সহজ কাজ পৃথিবীতে আর হয় না।

এ কথা স্বীকার করতেন মান্না দেও। ‘ইন্দিরা’ ছায়াছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপে গাইবেন তিনি। দুটি গানের সুর করলেন মানবেন্দ্র। ‘ঝর ঝর বৃষ্টিতে’ আর ‘আজি মলয় মন্দ বহিয়া’।

মানবেন্দ্রর যাদবপুরের নর্থ রোডের বাড়িতে এলেন মান্না দে। গানের মহলা। শুনলেন গান। এর পর যত বারই গাইতে যাচ্ছেন, তত বারই বলছেন, ‘‘মানববাবু, এ আপনার মতো হচ্ছে না।’’

প্রতি বারই আশ্বাস, ‘‘কী বলছেন মান্নাদা! এ গান আপনি অন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছেন।’’— তবু মান্না দে’র কুণ্ঠাবোধ শেষ অবধি যায়নি।

*****

ছোট থেকে এত রকমের গানের মধ্যে দিয়ে গেছেন যে, পরে সেই ভিন্নতার রেশ পড়েছে তাঁর সুরের গড়নেও।

ঠাকুর্দা গজেন্দ্রনাথ ছিলেন অসম্ভব সঙ্গীতরসিক মানুষ। রজনীকান্ত সেনের সঙ্গে একই মেসে থাকতেন। নিজে ভক্তিগীতি, হরিনামের গান গাইতেন। রজনীকান্ত গান লিখে গজেন্দ্রনাথকে দেখাতেন।

বরিশালের উজিরপুরে ওঁদের যে দেশের বাড়ি, তার চণ্ডীমণ্ডপে গান লেগেই থাকত। রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তন, রয়ানী গান, মনসামঙ্গলের আসর…। মাঝিমাল্লারাও গান গাইত। সারিন্দা বাজিয়ে। সারিজারি ভাটিয়ালি।— ‘আর কত দিন রইব দয়াল/নেবানি আমায়’। নমঃশুদ্র মাঝিরা গাইত হরে নামসংকীর্তন।

বাবা অতুলচন্দ্র গানবাজনা না করলেও, তাঁরই উৎসাহে দুই কাকা রত্নেশ্বর আর সিদ্ধেশ্বর গানচর্চা করতেন। ওঁরাই ছিলেন ‘মুখুজ্জে পরিবার’-এ কীর্তন, ধ্রুপদী গানের বাহক। কাকাদের সঙ্গে হরির লুঠের আসরে রূপানুরাগ, মান, মাথুর গাইতে যেতেন ও-বাড়ির পল্টন (মানবেন্দ্রর ডাক নাম)।

কালীঘাটে জন্মেছেন, কিন্তু দেশের টান, তার সুর আমৃত্যু ভোলেননি। বলতেন, ‘‘একটু যখন বড় হইলাম, দ্যাশের জন্য মন ক্যামন করলেই তখনকার বরিশাল এক্সপ্রেসে চাইপ্যা খুলনা হইয়া স্টিমারে ঝালকাঠি দিয়া দ্যাশের বাড়ি যাইতাম।’’

এক দিকে এই মায়াটান, অন্য দিকে বাড়িতে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বড়ে গোলাম আলিদের আনাগোনা। জ্ঞানপ্রকাশের ডিক্সন লেনের বাড়িতে যাতায়াত, বেগম আখতার কলকাতায় এলেই হত্যে দেওয়া, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলি আকবর খান, পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর সংস্পর্শে আসা, সেতারবাদক নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুতা— সব মিলিয়ে সুরের রামধনুতে যাঁর চলাচল, তাঁর রঙের খেলা যে বহুগামী হবে এ আর বিচিত্র কী!

কাকা রত্নেশ্বরের ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধু। কিশোর মানবেন্দ্রর কীর্তনে মুগ্ধ হয়ে নজরুল নিজে দু’টি গান শিখিয়ে দিয়েছিলেন— ‘সখী সাজায়ে রাখ লো পুষ্পবাসর’ আর ‘হে মাধব হে মাধব’।

সেই নজরুলকে এক সময় বাঙালি যেন ভুলতে বসল! এই বিস্মরণ ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের। ঠিক করেছিলেন যেখানেই অনুষ্ঠানে যাবেন, নজরুলের গান গাইবেন।

এ দিকে সবাই তখন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ফিল্মি গান, আধুনিক গান শুনতে চায়। পরের পর অনুষ্ঠানে গিয়ে ঝামেলায় জড়িয়েছেন। উঠে চলেও এসেছেন। তবু ছাড়েননি নজরুলের গান!

গ্রামাফোন কোম্পানিতে রেকর্ডিং অফিসার হয়ে এলেন সন্তোষকুমার সেনগুপ্ত। ডেকে পাঠালেন মানবেন্দ্রকে। নজরুলের প্রতি অবজ্ঞা তাঁকেও বিঁধছিল। ‘বেস্ট লভ সঙ্গস অব নজরুল’ এলপি করবেন তিনি। তাতে দুটি গান গাইলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়— ‘এত জল ও কাজল চোখে’ আর ‘বউ কথা কও’। এত বিক্রি হল যে কোম্পানি স্পেশাল ইপি করতে ডাকলেন। লেবেলে লেখা হল ‘নজরুল গীতি’। সেই প্রথম বার। আগে লেখা থাকত ‘সঙ্গস অব কাজী নজরুল’।

এর পর আবার ডাক। অত গান কোথায় পাবেন নজরুলের! বিস্তর গান লিখেছেন কবি, কিন্তু তার হদিশ কোথায়?

শেষ জীবনে নজরুল তখন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে মানবেন্দ্র এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘‘৭১ সালে বঙ্গবন্ধু (মুজিবর রহমান) এলেন বাংলায়। সে বার ক্রিস্টোফার রোডে গাইতে গেলাম কবির জন্মদিনে। রাধাকান্ত নন্দীকে নিয়ে। সেজেগুজে বসে আছেন নীরব কবি। কী ট্র্যাজিক সেই নীরবতা! ‘কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া’ দিয়ে শুরু করে কত গান গেয়েছিলাম। কবির দু’চোখে জলের ধারা। কোনও কথা নেই মুখে।’’

শেষমেশ ঈশ্বরের পাঠানো দূতের মতো মানবেন্দ্রর গানজীবনে এলেন বিমান মুখোপাধ্যায়। অসংখ্য নজরুলের গানের ভাঁড়ার নিয়ে। নজরুল ভুলে যাওয়া বাঙালিকে ধাক্কা দিয়ে হুঁশে ফেরালেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

*****

কলেজবেলায় আদর্শ ছিলেন গায়ক-অভিনেতা রবীন মজুমদার। মজা করে কবুলও করতেন, ‘‘ওঁর দেখাদেখিই সরু গোঁফ রাখতে শুরু করি। পঞ্চাশের দশকে যখন রবীন মজুমদার পড়তির দিকে, কারা যেন বলেছিল, মানব, জায়গাটা খালি হলে কিন্তু তোর একটা চান্স হবে। সেই আশাতেই সাড়ে ৭৪-এ নামলাম। সেই প্রথম, সেই শেষ।’’

সিনেমায় আর অভিনয় করেননি। কিন্তু খুব শখ ছিল মিউজিক্যাল বায়োস্কোপে। সেই জন্যই বন্ধু শ্যামল গুপ্তকে নিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ‘জলসাঘর’ কাহিনিটি কিনেছিলেন পাঁচশো টাকা দিয়ে। ছবি করবেন। সন্ধ্যা-বেলা প্রোডাকসন্স-এর ব্যানারে (বেলা ওঁর স্ত্রীর নাম)। সে আর কিছুতেই হয় না! হঠাৎ তারাশঙ্করের সঙ্গে কোনও এক অনুষ্ঠানে দেখা।

‘‘ছবির কী হল তোমার?’’

‘‘এখনও স্ক্রিপ্টই লেখা হয়নি। আমরা তো ও-লাইনের নই…।’’

‘‘আসলে মানিক কাহিনিটা চাইছিল। তো আমি তখন তোমাদের কথা বললাম।’’

মানিক, সত্যজিৎ রায় তখন ‘জলসাঘর’-এর জন্য ঝুঁকেছেন। এ কথা জানতে পেরে সাততাড়াতাড়ি বলে উঠেছিলেন, ‘‘না না না, এ তো অতি উত্তম কথা। আপনি ওঁকেই দিন।’’

জলসাঘর স্বপ্নই থেকে গেল।

৯২-এর জানুয়ারির ১৯-এ আচম্বিতে বাংলার জলসাঘরের ঝলমলে মানব-বাতিটা ঝুপ করে নিভে গেল।

তখন তিনি সবে একষট্টি!

ঋণ: মানসী মুখোপাধ্যায় (কন্যা)

ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

85th birth anniversary veteran singer manabendra mukhopadhyay special write up abp patrika patrika cover story debshankar mukhopadhyay shaymal gupta mehedi hasan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy