Advertisement
E-Paper

মেঘে ঢাকা ঋত্বিক

এই প্রথম বাংলা সিনেমা অবলম্বনে থিয়েটার। ‘মেঘে ঢাকা তারা’। নির্দেশক ব্রাত্য বসু। মহলা দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়‘‘ফিল্মের প্রেমে আমি পড়িনি মশাই! আমি মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে চাই। কাল যদি এর চেয়ে বেটার মিডিয়াম পাই, সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাব।’’ বলে দিতে লাগে না, বক্তাটি কে! হ্যাঁ, অবশ্যই ঋত্বিককুমার ঘটক। অনেকেই বলেন, ঋত্বিকের সব কিছুর মধ্যেই একটা প্রি-ফিক্সড এজেন্ডা কাজ করে গেছে। সে গল্পই লিখুন, কী থিয়েটার বা সিনেমাই করুন।

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০৩
মহলায় শুভাশিস ও পৌলমী

মহলায় শুভাশিস ও পৌলমী

‘‘ফিল্মের প্রেমে আমি পড়িনি মশাই! আমি মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে চাই। কাল যদি এর চেয়ে বেটার মিডিয়াম পাই, সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাব।’’

বলে দিতে লাগে না, বক্তাটি কে! হ্যাঁ, অবশ্যই ঋত্বিককুমার ঘটক।

অনেকেই বলেন, ঋত্বিকের সব কিছুর মধ্যেই একটা প্রি-ফিক্সড এজেন্ডা কাজ করে গেছে। সে গল্পই লিখুন, কী থিয়েটার বা সিনেমাই করুন।

তাঁরই ছবি অবলম্বনে তৈরি থিয়েটার ব্রাত্য বসুর নির্দেশনায় নৈহাটি ব্রাত্যজন-এর ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মহলা দেখতে দেখতে আবার ওই কথাগুলোই মনে পড়ে গেল (প্রথম শো আজ, ২ জানুয়ারি, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল, সন্ধে সাড়ে ছ’টা)!

নির্দেশক ব্রাত্যও কি এ বার কোনও পূর্ব-নির্ধারিত মোড-এ নিজেকে বেঁধে ফেলেছেন?

•••

নিজের পঞ্চাশ বছরে পৌঁছে নির্দেশনায় ‘ফুলস্টপ’ দেওয়ার ঘোষণা করা ব্রাত্য এখন অনেকটাই স্লগওভারের মেজাজে।

অল্প কয়েক মাসের ব্যবধানে পর পর তিনটি নাটকের নির্দেশক তিনি। তিনটি নাটক। তিন ঘরানা। — এর মধ্যেই নেমে গিয়েছে শেক্সপিয়র-মুম্বই-বলিউড মিশেলে ‘মুম্বাই নাইটস’। আজ থেকে শুরু ঋত্বিক-ছবি ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মঞ্চায়ন। তিন নম্বরটি অপেক্ষায়— ‘অশ্লীল’ ছাপ্পা পড়ে যাওয়া ‘বারবধূ’খ্যাত নাট্যকর্মী অসীম চক্রবর্তীকে নিয়ে— ‘অদ্য শেষ রজনী’।

‘মেঘে ঢাকা তারা’ নাটকটি মঞ্চায়নের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো’বা বাংলা থিয়েটারে একটি নতুন ‘খাতা’ খুলতে চলেছে।— সিনেমা অবলম্বনে বাংলা নাটক।

এর আগে নান্দীকার যখন ‘মাননীয় বিচারকমণ্ডলী’ করেছে, তখন তার মধ্যে আকিরা কুরোসওয়ার ‘রশোমন’-এর ছায়া ছিল, কিন্তু পুরোদস্তুর সিনেমার কাহিনি, আদল, তার গড়ন মঞ্চে আনা বোধ হয় বাংলায় এই প্রথম।

শোনা গেল, এর পর থেকে লাগাতার এমনটা ঘটতেই থাকবে ‘নৈহাটি ব্রাত্যজন’-এ। এর মধ্যেই যেমন প্রস্তুতি চলছে তপন সিংহর ‘গল্প হলেও সত্যি’-কে নিয়ে।

•••

‘মেঘে ঢাকা তারা’। এই লিজেন্ডটির সঙ্গে বাঙালি-মনে আষ্টেপৃষ্ঠে জুড়ে আছে কতগুলো ছবি, এক-একটা আর্তস্বর, নাগাড়ে বয়ে চলা সুরেলা ধ্বনি। এক বার যা শুরু হলেই হয়, চট করে থামে না। কেবলই বাজে, বেজেই চলে।

সময়টা পঞ্চাশের দশক। উদ্বাস্তু কলোনি। ঝিলের ধার। বিস্তীর্ণ উঁচুনিচু পাড়। তার এক ধারে গায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে খোলা গলায় মাথা ঝাঁকিয়ে আলাপ করে চলেছে শঙ্কর। অনিল চট্টোপাধ্যায়।— ‘লাগি লাগানা…’। হংসধ্বনি। এ টি কানন-এর। কখনও ঝামরে উঠছে বাহাদুর খানের সরোদ। নিশুত রাতে হা হা করে ভেসে বেড়াচ্ছে ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’। দেবব্রত বিশ্বাস। রাগ বাগেশ্রী।

কখনও ঝাঁকড়া মাথাওয়ালা গাছটার নীচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নীতা! সুপ্রিয়া চৌধুরী। হুশ হুশ করে ধোঁয়া ছেড়ে যেন বুকের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে কয়লা-ইঞ্জিনের রেলগাড়িটা। দাওয়ায় একতারা হাতে বাউলের ভাটিয়ার, ‘মাঝি তর নাম জানি না, আমি ডাক দিমু কারে…’। ছাতা হাতে পথ ভাঙছেন মাধব মাস্টার। বিজন ভট্টাচার্য। অনাচার দেখলেই মুখে আওড়াচ্ছেন, ‘দেখো কাণ্ড দেখো কাণ্ড’। ...শুকিয়ে যাওয়া বোনকে আদর বুলিয়ে দাদার ডাক, ‘তোমার খুকি কিচ্ছু বোঝে না মা, তোমার খুকি ভারী ছেলেমানুষ’।

শিলং পাহাড়। শঙ্করের বুকে আছড়ে পড়ে ডুকরে উঠছে যক্ষ্মাগ্রস্থ নীতা— ‘দাদা, আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম’। গোটা পাহাড়টা তখন যেন দুলছে!

আরও আরও কত ছবি, স্বর, ধ্বনি! তার প্রত্যেকটি বুকে হাপর টানে। গলার কাছে কান্না ঠেলে। সারা শরীর স্থবির করে দেয়।

ঋত্বিককুমার ঘটক

এত দিনের এই মায়া সরিয়ে তাকে ‘রি-ক্রিয়েট’ করা কম ঝুঁকির নয়। কিন্তু কাহিনির চলন প্রায় এক রেখেও অদ্ভুত এক ‘ডিপারচার’-এ গেছেন নির্দেশক ব্রাত্য। নিটোল, নিপুণ স্ক্রিপ্ট নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের। তাতে সিনেমার আদল স্পষ্ট। কিন্তু মঞ্চে তাকে নামিয়ে চেনা-চেনা সেই ছবি, চরিত্রগুলোকে ভাঙতে ভাঙতে এগিয়েছেন নির্দেশক।

বিনির্মাণ! এ বার ঋত্বিকেরও।

ব্যাকস্টেজে প্রজেক্টর দিয়ে ছবি ফেলাটা ব্রাত্যর নাটকে নতুন নয়। কিন্তু এই ধারায় যোগ হল থিয়েটার-সিনেমার এক অদ্ভুত যুগলবন্দি খেলা। মঞ্চের পর্দায় ফুটে উঠল কখনও ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’। কখনও এ-নাটকেরই কুশীলবদের নিয়ে তৈরি টুকরো টুকরো ভিডিয়োগ্রাফি (দেবারতি গুপ্ত)। চলমান ছবির সঙ্গে মঞ্চের অভিনেতাদের আদানপ্রদান।

বিনির্মাণের প্রথম খেলাটা কিন্তু এটি নয়। এর অনেক আগেই ভাঙাচোরার সেই দায়টি নিয়ে হাজির হয়ে পড়ে সেট।

সাদাকালো মেজাজটা সরিয়ে, রং চড়িয়ে বাঁ ধারে আদুল গায়ে দাঁড়ায় মাধবমাস্টারের ঘর। টেবিল, চেয়ার, মিটসেফ। চৌপায়া। খোলা জানলা। হতকুচ্ছিত দারিদ্রে লাট খেলে যতটা মলিন হওয়ার কথা, এ-ঘর, তার মানুষজন ততটা যেন নয়।

মাঝে আড়াআড়ি পাটাতন। তার গা ধরে ধরে টানা ফুল গাছ। গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া। পাটাতন শেষে ডান ধারে সাঁকো। ও দিকে সূর্যমুখী উঁকি দেয়। সব ফুল নকল, প্লাস্টিকের! ওপর থেকে তারা ঝোলে। চড়া আলো নামে। সব মিলিয়ে আস্ত একটা কলোনি বাড়ি যেন সুখের ধরতাই পেতে রূপকথা হয়ে জেগে থাকে। —এ কি সুখ? নাকি মিথ্যে সুখ? মিথ? ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো আশমানে হারিয়ে যাওয়া কোটি কোটি ভাললাগা, না-পাওয়া, কামনা ফিরে পাওয়ার কল্পলোক?

গল্পের ধাঁচাটা (মূল কাহিনি শক্তিপদ রাজগুরু) প্রায় একই। মাধবমাস্টার (শুভাশিস মুখোপাধ্যায়), তাঁর স্ত্রী রমলার (সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত) অভাবের সংসার। তাঁদের দুই ছেলে শঙ্কর (পার্থ ভৌমিক), মন্টু (দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়)। দুই মেয়ে নীতা (পৌলমী বসু), গীতা (কথাকলি দেব)। শঙ্কর বড় গাইয়ে হবার স্বপ্ন দেখে। মন্টু ফুটবলার হতে চায়। গীতা সাজগোজ, আহ্লাদ নিয়ে বাঁচে। নীতার কাঁধেই শুধু সংসারের জোয়াল। এই অভাবের আঁস্তাকুড়ে পাশাপাশি ঘর করে স্বার্থপরতা-ত্যাগ, প্রেম-অপ্রেম, আত্মসুখ-সহমর্মিতা, ঘৃণা-আকুতি।

গল্পটা সিনেমার সঙ্গে মিলতে মিলতে এগোলেও চরিত্রগুলো যেন ছোট্ট ছোট্ট আঁচড়ে বাঁক নিয়ে কিছুটা হলেও দূরে সরে যায় কাহিনির মেয়াদ অল্প গড়়ালেই।

পর্দায় অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্যর ‘মাধব’ যেমন, এক-এক সময় অনেকটা মহাকালের মতো, কিংবা ত্রিকালদর্শী। শোক, হতাশা, অক্ষমতাকে তিনি যখন প্রকাশ করেন, কিংবা ভাবালু হয়ে যখন এই দেশ-এই সময়ের পরিণতির কথা বলেন, মনে হয় কোনও তরঙ্গে ভাসান দিচ্ছেন! তাঁকে আর ধরা যাবে না। অনুভবের অভিঘাতে চেনা যেতে পারে শুধু। কিন্তু মঞ্চের মাধব যেন পাশের ঘরের অভাবী বৃদ্ধ। পোড়া সময়ের ক্ষয়ের ফসল। শুভাশিসের ‘মাধব’ একবার দেখলে নড়েচড়ে বসতেই হয়। প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে অভিনয় করছেন তিনি। বাংলা সিনেমা, সিরিয়াল তাঁকে ‘ভাঁড়’ সাজিয়েই হাত ধুয়ে ফেলেছে বারবার। ব্যতিক্রম হাতে গোনা। বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শিল্পান্তর’, সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘হারবার্ট’, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (সেখানেও বিজন ভট্টাচার্যর চরিত্রে)।

ছায়াছবির শঙ্কর-নীতা

এর পর এ বারের ‘মাধব’। নিশ্চিত করে ঘাড় ধরে ঝাঁকিয়ে শুভাশিসের জাত স্মরণ করিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় এই নাটক— ‘মেঘে ঢাকা তারা’।

মাধব-এর মতো অন্য চরিত্রগুলোতেও সিনেমা-মঞ্চ ফারাকের ছবিটা স্পষ্ট।

ছবির গীতা যেমন গোপনে ছলনাময়ী, মঞ্চের গীতা তেমন নয়। সে বরং প্রকাশ্যেই আগ্রাসী। তাঁর প্রেমিক সনৎ ছবিতে যতটা শান্ত অথচ কুটিল, মঞ্চের সনৎ (অনির্বাণ ঘোষ) স্বার্থান্বেষী হয়েও তুলনায় অনেক রূঢ়। কলোনি উচ্ছেদ আন্দোলনের নেতা যতীন সে-ভাবে প্রকট নয় ছবিতে, যতটা আছেন মঞ্চে (তরঙ্গ সরকার)।

কেন্দ্রীয় চরিত্র নীতাও যেমন। ছবির সেই অভিজাত-ব্যক্তিত্বময়ী মোড়ক থেকে বেরিয়ে এই নীতা অনেকটাই যেন ঘরেলু। দিনে দিনে পরিণত হয়ে ওঠা অভিনেত্রী পৌলমী বসু তাঁকে গড়ছেন উচ্ছ্বাসে, আবেগে, কোমলতার গমকে গমকে।

চরিত্রের এই অদলবদল, কাহিনির ধারাতেও সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বদলাবদলি এনেছে। তার অনেকটাই ধরা পড়েছে প্রকাশভঙ্গিতে। ঋত্বিকের সিনেমা যেন একটা গোটা ক্যানভাসে অসংখ্য বিন্দুর ছিটে ফেলতে ফেলতে এগিয়েছে। তার মধ্যে কোনও জোড়াজুড়ি নেই। কিংবা জোড়াটা দর্শকের দায়। সে কী ভাবে জুড়বে, সরলে, নাকি বক্রে! অন্য দিকে, ব্রাত্যর এই ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় আগেই ভেসে ওঠে অজস্র সরলরেখা। অভাবী শরীরের গা বেয়ে যেখানে কখনও উঁকি দেয় পুরুষের চোখে নারী, কখনও ঢুকে পড়ে কলোনির রাজনীতি, কখনও আলগা-দেখনদারি শোক-দুঃখ, শঠতায় ভরা মধ্যবিত্তপনা।

ঋত্বিকের বুননে ছিল পাহাড়ের গায়ে ঝরতে থাকা ঝরনার মতো সঙ্গীতের নিরন্তর বয়ে চলা। যেখানে কাহিনির সঙ্গে যেন সহবাসে যায় সুর। সুরের সঙ্গে আভাস আসে সময়ের। এ-নাটকে সঙ্গীত-কাহিনি-সময়ের সেই মেলামেলি তেমনটা নয়। সঙ্গীত (দিশারী চক্রবর্তী) এসেছে। গিয়েছে। বাকি অনেকটা সময় রয়েছে ফাঁক। সেই ফাঁকে সুরের বদলে জুড়ে আছে শব্দ, এমনকী গুমরে ওঠা, জারিয়ে ওঠা নৈঃশব্দ্যও। সেই নৈঃশব্দ্য চিরে এক-এক সময় যখন বেজে উঠেছে বাগেশ্রী, হংসধ্বনি কিংবা মল্লার— বুকের কাছে ধক করে লাগে বইকী!

মেঘের আচমকা গুরু গুরু গর্জনে যেমন হয়, অনেকটা তেমনই!

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy