Advertisement
E-Paper

কেচ্ছা

অতুলপ্রসাদ সেনের জীবনে এমন অন্তত তিনটি এপিসোডের কথা বলা যায়, যা নিয়ে সে সময় ঢের কেচ্ছা হয়েছিল। প্রথম ঘটনাটির ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি জড়িত নন। অতুলপ্রসাদের বাবা মারা যাওয়ার পর, বছর ছয়েক অতুলপ্রসাদের মা হেমন্তশশী তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকতেন। ১৮৯০ সালে, ছেলেমেয়েদের রেখে হেমন্তশশী কিছু সময়ের জন্য গিয়েছিলেন বড়ভাই কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তর কাছে।

সুস্নাত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৪০

অতুলপ্রসাদ সেনের জীবনে এমন অন্তত তিনটি এপিসোডের কথা বলা যায়, যা নিয়ে সে সময় ঢের কেচ্ছা হয়েছিল। প্রথম ঘটনাটির ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি জড়িত নন। অতুলপ্রসাদের বাবা মারা যাওয়ার পর, বছর ছয়েক অতুলপ্রসাদের মা হেমন্তশশী তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকতেন। ১৮৯০ সালে, ছেলেমেয়েদের রেখে হেমন্তশশী কিছু সময়ের জন্য গিয়েছিলেন বড়ভাই কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তর কাছে। কয়েক দিন পরেই হঠাৎ প্রকাশ পেল একটি খবর— পুনরায় বিয়ে করেছেন হেমন্তশশী! পাত্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের জ্যাঠা ও আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর শ্বশুর সমাজসংস্কারক দুর্গামোহন দাস। তিনিও বিপত্নীক। গোটা ব্যাপারটা ঘটে অত্যন্ত গোপনে। কিন্তু এক বার চাউর হতেই চারিদিকে ছিছিক্কার পড়ে যায়। গভীর আঘাত পান অতুলপ্রসাদও। জানা যায়, দুর্গামোহনকে তখন তিনি দু’চোখে দেখতে পারতেন না। পরম অভিমান পোষণ করতেন মায়ের প্রতিও। হেমন্তশশীর বাপের বাড়ির লোকজন বা দুর্গামোহনের বাড়ির লোকও এ ঘটনাকে একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। আসলে, দুর্গামোহনের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তখন পনেরো বছর কেটে গিয়েছে। তার পর কিনা, ৪৯ বছরের এক ব্যক্তি, ছ’টি সন্তান থাকা সত্ত্বেও ফের বিয়ে করছেন ৪৩ বছর বয়সের এক বিধবাকে, যিনি আবার চার ছেলেমেয়ের মা!

এপিসোড টু। ১৮৮২ সালে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত যান অতুলপ্রসাদ। কিছু পরেই সপরিবারে বিলেতে আসেন তাঁর বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত। এই সময় কৃষ্ণগোবিন্দের মেয়ে, নিজের মামাতো বোন হেমকুসুমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে অতুলপ্রসাদের। হেমকুসুমের গানে, বেহালা-পিয়ানো বাজানোর হাতে মুগ্ধ হন অতুলপ্রসাদ। শুরু হয় তাঁদের প্রেম। বিলেত থেকে ফিরে আসার পর, বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। প্রবল অশান্তি শুরু হয় পরিবারে। হেমন্তশশীও এই বিয়ের বিরোধিতা করেন। এ কথাও শোনা যায়, অতুলপ্রসাদের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে কোথাও হয়তো কাজ করেছিল তাঁর মায়ের প্রতি পুরনো অভিমান। তাই প্রতিশোধস্বরূপ বংশের মুখ পুড়িয়ে, ‘নিষিদ্ধ’ সম্পর্ক গড়তে পিছপা হননি তিনি। কিন্তু বিয়ে হবে কী করে? এ দেশের আইনেই তো তখন ভাই-বোনের এমন বিয়ে স্বীকৃত নয়। আইনের কারবারি অতুলপ্রসাদ তাঁর সিনিয়র সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের পরামর্শে, পাড়ি দিলেন স্কটল্যান্ডের গ্রেটনা গ্রিন গ্রামে। সেখানকার রীতিতে এই বিয়ের কোনও বাধা ছিল না। ১৯০০ সালে বিয়ে করলেন অতুলপ্রসাদ ও হেমকুসুম। ছিল বেড়াল, হয়ে গেল রুমাল! অতুলপ্রসাদের মামা থেকে শ্বশুর হয়ে গেলেন কৃষ্ণগোবিন্দ, হেমন্তশশী বদলে গেলেন হেমকুসুমের পিসি থেকে শাশুড়িতে! এ ঘটনার অভিঘাত ছিল বহু দূর। বিলেতে পসার জমাতে না পেরে, এক সন্তানের মৃত্যুর পর ১৯০২ সালে যখন আর এক পুত্র দিলীপকুমারকে নিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় তাঁরা কলকাতায় ফেরেন, প্রকাশ্যে এক জন আত্মীয়ও পাশে দাঁড়ায়নি।

এর পরই সপরিবারে লখনউ চলে আসেন অতুলপ্রসাদ। সেখানে তাঁর প্র্যাকটিস জমে ওঠে। তাঁর সংগীতের জীবনে এই পর্বটিই সবচেয়ে সমৃদ্ধ। আর পারিবারিক জীবনে সবচেয়ে বেদনাবহুল। এত ঝঞ্ঝাট পুইয়ে যাঁকে বিয়ে করলেন, সেই স্ত্রীর সঙ্গেই শুরু হল তুমুল অশান্তি। দুর্গামোহনের মৃত্যুর পর তখন অতুলপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর মায়ের দূরত্ব কমেছে। হেমন্তশশী লখনউ এসে থাকতে শুরু করলে, দেখা দিল চেনা ছকের সাঁস-বহু সিরিয়াল! নিজের পিসি হওয়া সত্ত্বেও যিনি তাঁর বিয়ের বিরোধিতা করেছেন, তাঁকে আর কোনও দিনই মেনে নিতে পারেননি হেমকুসুম। এর পর থেকে বেশির ভাগ সময়েই অতুলপ্রসাদ ও তাঁর স্ত্রী আলাদা থেকেছেন। হয়তো একই শহরে রয়েছেন দুজন, কিন্তু আলাদা আলাদা। সেই সময়ের চোখে কম দৃষ্টিকটু নয়! আবার যখনই একসঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছেন, কিছু দিনের মধ্যেই ফের শুরু হয়েছে মনোমালিন্য। ফের সাময়িক বিচ্ছেদ। আজকের সহজ-ডিভোর্স-ত্বরান্বিত ‘ভদ্র’ সমাজেও এক-একটা বিচ্ছেদ কী পরিমাণ তামাশার জন্ম দেয়, তা থেকেই অনুমেয় একশো বছর আগের ছবিটা কী হতে পারে। শেষ বার, হেমন্তশশীর মৃত্যুর পর ঘরে তাঁর ছবি টাঙানো রয়েছে দেখে ভয়ংকর খেপে ওঠেন হেমকুসুম। অতুলপ্রসাদ সেই ছবি সরাতে রাজি না হওয়ায় স্বামীর ঘর ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে বেরিয়ে আসেন তিনি। সেই অলিখিত সেপারেশনই ছিল তাঁদের শেষ বিচ্ছেদ।

susnatoc@gmail.com

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy