Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শিল্প থেকে রাজনীতি একাকার তাঁর লেখায়

তাঁর গবেষণাপত্র আবির্ভাবেই বিক্রি হয়েছিল ৮০ হাজার কপি। উপন্যাস থেকে ক্লাসরুম, টক-শো, সর্বত্র নিজেকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। ৬ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন কেট মিলেট।তাঁর গবেষণাপত্র আবির্ভাবেই বিক্রি হয়েছিল ৮০ হাজার কপি। উপন্যাস থেকে ক্লাসরুম, টক-শো, সর্বত্র নিজেকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। ৬ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন কেট মিলেট।

পথিকৃৎ: কেট মিলেট।

পথিকৃৎ: কেট মিলেট।

ঐশিকা চক্রবর্তী ও রাজলক্ষ্মী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ছোট থেকেই বাবার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকত। মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে বাবা বেধড়ক পেটাত ছোট মেয়েটাকে। যত দিন না তিন মেয়ে আর বেরোজগেরে বউকে রেখে বাড়ি থেকে একেবারে চলে যায়, তত দিন কালশিটের দাগটা যায়নি প্রাত্যহিকতা থেকে। দারিদ্রের ছায়ামাখা শৈশবে একমাত্র ভরসা মায়ের ইনশিয়োরেন্স এজেন্সির কাজ। যন্ত্রণার খণ্ডকাব্য সঙ্গে নিয়েও কেট মিলেটের মেয়েবেলাটা অনন্ত দুঃখগাথা হয়েও হয় না। বরং পথচলাটা হার না-মানা জীবনের স্পর্ধিত উচ্চারণে বিশ্বজোড়া নারী আন্দোলনের একাধিক মাইলফলক বিছানো আখ্যান হয়ে ওঠে।

কেট মিলেট জন্মেছিলেন ১৯৩৪ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে অক্সফোর্ডের সেন্ট হিল্ডাস কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার পরেও ফাইল ক্লার্ক, নিউ ইয়র্কের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ানো। ষাটের দশকের অস্থির সময়ে নারীবাদী বিপ্লব-চেতনায় দীক্ষিত মিলেট আর এক বার গণ্ডি ডিঙোন শিল্প-মাধ্যমের বিনির্মাণে। সৃজনশীল চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের নতুন ভাষার সন্ধানে দেন প্রাচ্যের পথে পাড়ি, আর জাপানি শিল্পী ফুমিয়ো ইয়োশিমুরার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে শিকড় গাড়েন ফের আমেরিকাতেই।

সত্তরের দশকের গোড়াতেই চমক। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সদ্য-সম্পূর্ণ পিএইচডি গবেষণাপত্র ‘সেক্সুয়াল পলিটিক্স’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৮০ হাজার কপি নিঃশেষিত। দ্বিতীয় স্রোতের নারীবাদী আন্দোলনে মাইলফলক হয়ে ওঠে তাঁর প্রতিবাদী স্বাক্ষর। নারীবাদী তত্ত্বের নিরিখে সাহিত্যের পঠনের এই কাটাছেঁড়া শুধু প্রতিষ্ঠানের পিতৃতান্ত্রিক সর্বময়তা খণ্ডন করেনি, নারীজীবনের পরতে পরতে পিতৃতন্ত্রের দাঁত-বসানো যৌন অবদমনকেও তুলে ধরেছিল। ডি এইচ লরেন্স এবং হেনরি মিলারের মতো তথাকথিত নারীমুক্তি প্রবক্তাদের লেখায় অন্তর্নিহিত গাঢ় নারীবিদ্বেষ চিহ্নিত করে মিলেট সাহিত্যকে বলেছিলেন এক পিতৃতান্ত্রিক রাজনীতির ক্যামোফ্লেজে মোড়া মিথ্যে সচেতনতার প্রতিফলক, যা তার পরিপাটি ভাঁজ ও মোচড়ে পুরুষ-নারীর যৌন বৈষম্যকে আজীবন মেনে নিতে শেখায়।

আরও পড়ুন:প্রাসাদের দেওয়ালে নিজের হাতে ভৃত্যের ছবি টাঙিয়ে গিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া

‘সেক্সুয়াল পলিটিক্স’ হয়ে ওঠে নারী আন্দোলনের বাইবেল। কেট মিলেট হয়ে ওঠেন মার্কিন দুনিয়ার বৌদ্ধিক-রাজনৈতিক শিহরন। একাধারে মার্কিন মিডিয়ার চর্চিত নাম; ক্যাম্পাস পলিটিক্সের অন্যতম মুখ ও দ্বিতীয় স্রোতের আন্দোলনে নতুন জোয়ার এনে অবিসংবাদী নারীবাদী ব্যক্তিত্ব। রাতারাতি হয়ে যান ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ, তলায় ক্যাপশন, ‘নারীমুক্তির মাও জে দং’। টিভির টক-শো’তে ঘন ঘন আমন্ত্রণ আসতে থাকে। সত্তরের দশকেই সাড়া ফেলে মিলেটের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘ফ্লায়িং’। আরও কিছু পরে ‘সিটা’। যৌনতা, বিবাহ, শরীর, সমকাম— নিজের জীবনেরই ভাঙাচোরা গল্প।

তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘সেক্সুয়াল পলিটিক্স’-এর প্রচ্ছদ

প্রথম বই বিক্রির ৮০০ ডলার দিয়ে মিলেট কিনেছিলেন দু’টো দামি পার্সিয়ান কার্পেট আর একটা পুরনো গাড়ি। তবে খ্যাতির আতিশয্য সবটুকু গলাধঃকরণ করতে পারেননি বলেই হয়তো এক দিন ব্রেকফাস্টে হড়হড় বমি করে দেন ওই কার্পেট দু’টোর ওপর। তাঁর খ্যাতিকেও গলাধঃকরণ করেননি সমকালীন নারীবাদীরা। ‘সেক্সুয়াল পলিটিক্স’-এর সাফল্যের তীব্র ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া উঠে আসে কিছু মহলে। নারী আন্দোলনের মধ্যেকার লেসবিয়ান কমিউনিটির কাছে তাঁর সমকামী যৌন সত্তার ‘কুণ্ঠিত’ জবাবদিহি প্রশ্নাতীত ছিল না। অনেকটা পথ-পরিক্রমার পরেও, সমকালীন নারীবাদী গ্লোরিয়া স্টেইনেম বা বেটি ফ্রিডানদের থেকে নিজেকে একটু সরিয়ে রেখে মিলেট বলতেন ‘‘আমি ঠিক রাজনীতিক নই।’’ যদিও মিলেটকে বাদ দিলে নারীবাদী রাজনীতির বৃত্ত অসম্পূর্ণ।

মনস্তত্ত্ব থেকে রাষ্ট্রনীতি, শিল্প থেকে যৌনতা একাকার হয়েছে মিলেটের লেখায়। ‘বেসমেন্ট’ উপন্যাসে ধর্ষিতা সিলভিয়া লাইকেন্সের শরীরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিলেট নিজের শরীরে মিলিয়ে দেন সিলভিয়ার কাটা-ছেঁড়া-পোড়া তলপেট, সিগারেটের ছ্যাঁকা আর হত্যা-মুহূর্তের যন্ত্রণাকে। ১৯৭৮-এর ‘ট্রায়াল অব সিলভিয়া লাইকেন্স’-এর ইন্সটলেশন, কল্পনা থেকে বাস্তবের পাতায় তুলে এনেছিল ধর্ষণের এক নারীবাদী পোস্টমর্টেম, যেখানে মিলেট ধর্ষণের সমস্ত চিহ্ন নিজেরই শরীরে প্রতিস্থাপিত করার মাধ্যমে বাঙ্ময় করে তুলেছিলেন। একই মাধ্যমে কোনও দিন আটকে বা থেমে থাকেননি তিনি। কখনও ডকুমেন্টারি, ছবির ক্যানভাস, কখনও জীবনের ব্যক্তিগত উচ্চারণে নিজেকে ছাপিয়ে গেছেন বারবার। সানগ্লাস পরে ক্লাস নিতে ঢুকতেন, ক্যাম্পাস-রাজনীতিতে নিতেন ছাত্রপক্ষ। আশির দশকে খোমেইনির ইরানের মৌলবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরদা ছেঁড়ার ডাক দিয়েছিল তাঁর লেখা ইরানের নারীজীবনের চাদরচাপা অন্তর-কাহিনি— ‘গোয়িং টু ইরান’।

জীবনভর নারী আন্দোলনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা মিলেটের হাত যখন কলম থামিয়ে মাটি, ব্রোঞ্জ, কাঠ বা পাথর ধরেছে, তখন সেই ভাস্কর্যেও উঠে এসেছে প্রতিস্পর্ধার স্বাক্ষর— খাঁচাবন্দি নারীর মেটাফরে। জীবনে বারবার খাঁচা ভেঙেছেন মিলেট। বারবার দোসর বদলেছেন। একাধিক নারী, পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছেন, ভেঙেছেন। নিজেও নিজেকে ভেঙেছেন অজস্র টুকরোয়।

গত ৬ সেপ্টেম্বর প্যারিসে ৮৩-তম জন্মদিন পালনের আগেই জীবনসঙ্গী সোফি কেইর-এর পাশে শেষ বারের মতো ঘুমোতে গেলেন মিলেট। ২০০০ সালে নিজের বইয়ের পুনর্মুদ্রণের ভূমিকায় বলেছিলেন, পিতৃতন্ত্র সম্ভবত অমোঘ ও অবিনশ্বর। মৌলবাদ ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আধিপত্যবলে পিতৃতান্ত্রিকতা এক অনিবার্য বা স্থায়ী প্রতিক্রিয়া। যদি পিতৃতন্ত্রের মৃত্যু না-ই হয়, তবে আরও অনেক কেট মিলেটের পুনর্জন্মের আশায় জেগে থাকতে ইচ্ছে করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE