চ্যালেঞ্জার: নিজের কোম্পানির ট্র্যাক্টর ও গাড়ির সঙ্গে ল্যাম্বরগিনি
ইতালির ট্র্যাক্টর বিক্রেতা ফেরুচো ল্যাম্বরগিনির সমস্যাটা শুনে তাচ্ছিল্যের সুরে এনজো ফরারি বললেন, ‘‘সমস্যাটা গাড়ির নয়, সমস্যা ড্রাইভারের। আপনি বরং ট্র্যাক্টর নিয়েই থাকুন।’’ এনজো তখন বিশ্ববিখ্যাত ফরারি কোম্পানির কর্ণধার।
যুদ্ধটা ছিল আত্মসম্মানের। সময়টা বিশ শতকের মাঝামাঝি। ফরারি স্পোর্টস কার তখন দুনিয়া কাঁপাচ্ছে। কিন্তু সেই বনেদি গাড়ি আম আদমির নাগালের বাইরে। এ দিকে গাড়িপ্রেমী ল্যাম্বরগিনির গ্যারেজে তখন জাগুয়ার, মার্সেডিজ বেঞ্জ... একাধিক নামী কোম্পানির গাড়ি। এক এক সপ্তাহে এক একটি গাড়ি ব্যবহার করতেন তিনি। সেই নামী গাড়ির তালিকায় এ বার তিনি নিয়ে এলেন পছন্দসই একটি ফরারি স্পোর্টস কার।
যে গাড়ি নিয়ে এত হইহই, সেই গাড়ি চালিয়ে তিনি মোটেও খুশি হলেন না। নির্ঘাৎ গাড়ির ক্লাচে কোনও গন্ডগোল আছে, তাঁর মন বলল। সরাসরি এনজোকে জানালেন সমস্যার কথা। ল্যাম্বরগিনিকে পাত্তাই দিলেন না এনজো।
সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি ল্যাম্বরগিনি। অথচ ইতালির এক দরিদ্র আঙুর চাষির ঘরের ছেলে হয়ে ল্যাম্বরগিনিকে কোনও দিনই চাষের খেত আকর্ষণ করেনি। বরং তাঁর আগ্রহ ছিল খেতের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি নিয়ে। টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করে যোগ দেন ইতালিয়ান রয়্যাল এয়ার ফোর্স-এ। সে সময় বাতাসে বারুদের গন্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। এয়ারফোর্সে অবশ্য ল্যাম্বরগিনি কাজটা পেয়েছিলেন তাঁর মনের মতো। বিদঘুটে সব ইঞ্জিন মেরামত করে এক্কেবারে নতুন করে তোলাই ছিল তাঁর কাজ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। ইতালি পরাজিত। যুদ্ধবন্দি হয়ে নির্বাসনে যেতে হল ল্যাম্বরগিনিকে। মুক্তি পাওয়ার পর দেশে ফিরে শুরু করলেন নিজের ব্যবসা। একটা ছোট্ট গ্যারেজ, সেখানে মেরামত করতেন মোটরসাইকেল, গাড়ি। কিন্তু অত ছোটতে কী তাঁর মন ভরে! কাজে লাগালেন পুরনো পরিচিতি। সামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত যন্ত্রপাতি কিনে তৈরি করলেন ট্র্যাক্টর ‘ক্যারিওকা’। ল্যাম্বরগিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ইতালির মতো কৃষিপ্রধান জায়গায় ট্র্যাক্টরের চাহিদা আছে। ক্রমশ ক্যারিওকার সুনাম বাড়ল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পেট্রলের দাম আগুন। ল্যাম্বরগিনি তৈরি করলেন ডিজেল চালিত ট্র্যাক্টর। ল্যাম্বরগিনির সাফল্য তাঁর আত্মবিশ্বাসকে আরও মজবুত করল।
এনজোর কথায় অপমানিত হলেও সে দিন তাঁর মুখের উপর কিছুই বলেননি ল্যাম্বরগিনি। অপমান হজম না করে নীরবে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। ইতালির ছোট্ট শহর সান্ত’আগাতা-য় তৈরি করলেন গাড়ির কারখানা। সঙ্গে পেলেন জিয়োত্তো বিৎজারিনি, ফ্রাঙ্কো শ্যাগলিয়ন ও জান পাওলো দালেরা-কে। এঁরা তিন জনই ফরারির প্রাক্তন কর্মচারী। মাত্র চার মাস! তৈরি হয়ে গেল প্রথম গাড়ি ‘ল্যাম্বরগিনি ৩৫০ জিটিভি’ (পরে হয় জিটি)। আত্মপ্রকাশ করল জেনেভা মোটর শো-এ। প্রশংসা পেল সংবাদমাধ্যমের। ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে জেনেও স্রেফ প্রতিযোগিতায় ফেলার জন্য গাড়ির দাম ফরারির চেয়ে ছিল বেশ কম। এই গাড়ি ফলে দু’বছরের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেল ১২০টা।
পঞ্চাশ ছোঁয়ার আগেই ল্যাম্বরগিনি ছুঁয়ে ফেললেন ফরারির আর্থিক সম্পত্তির পরিসংখ্যানকে। ল্যাম্বরগিনি সংস্থাও সেই আভিজাত্যের মুকুট পরল, যা এত দিন ফরারির ছিল। পরবর্তী কালে ইতালির বিরাট অঞ্চলে শিল্পশহর গড়ে তোলেন এই স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষটি।
নামযশ পেয়েও শৈশবের আঙুরখেতের কথা ভোলেননি তিনি। তাঁর এস্টেটের মধ্যেই ছিল আঙুরখেত। সেই আঙুর দিয়েই তৈরি হত ল্যাম্বরগিনির প্রিয় মদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy