Advertisement
E-Paper

রবীন্দ্রনাথ থেকে কুস্তি, বিয়ের পদ্যে ঠাঁই সবার

ছাপাখানা থেকে ছেপে আসত আত্মীয়-বন্ধুদের লেখা হরেক পদ্য।  কোনও পদ্যে বরের বংশপরিচয়, কোথাও যুদ্ধের ছায়া। বিশ্বকবিও লিখেছেন বিয়ের কবিতা।ছাপাখানা থেকে ছেপে আসত আত্মীয়-বন্ধুদের লেখা হরেক পদ্য।  কোনও পদ্যে বরের বংশপরিচয়, কোথাও যুদ্ধের ছায়া। বিশ্বকবিও লিখেছেন বিয়ের কবিতা।

অমিতাভ পুরকায়স্থ

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০০
ছন্দিত: নিমন্ত্রণপত্রের প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথের কবিতাংশ। ডান দিকে, ‘কাকুলীর বিয়েতে’ পদ্য

ছন্দিত: নিমন্ত্রণপত্রের প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথের কবিতাংশ। ডান দিকে, ‘কাকুলীর বিয়েতে’ পদ্য

উনিশ শতকের শেষের দিকে জনপ্রিয় রেওয়াজ ছিল বিয়েতে পদ্য ছাপানোর। প্রথম বিয়ের পদ্য নাকি রাজা সুবোধ মল্লিকের বিয়েতে ছাপা হয়েছিল বাংলা ১৩০৪ সালে। সেই সব পদ্যের রচয়িতাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ পদ্য-লিখিয়ে নিজের নাম রাখতেন না, বর বা কনের মা-বাবা, দাদু-দিদিমা, ভাগ্নি-ভাইপো, এমনকী পড়শির নাম দিয়ে ছাপতেন।

বিয়ের পদ্যগুলি ছিল ‘প্রীতি উপহার’। পদ্য ছাপিয়ে সমস্ত নিমন্ত্রিতের কাছে হাতে হাতে বিলি করার প্রচলন ছিল। সব জায়গায় যে ‘প্রীতি উপহার’ লেখা হত, তা নয়। কোনও পদ্যে বর-কনের নাম লিখে নীচে লেখা হত ‘প্রীতির ডালা’ বা ‘প্রীতি নিবেদন’। ‘আশিস’, ‘স্নেহাশিস’, ‘শ্রদ্ধার্ঘ্য’, ‘মেয়েদের দুটি কথা’, ‘খোশ রোজ’, এ সবও লেখা থাকত। তার তলায় থাকত দীর্ঘ কবিতা। ছোটদের নামে ছাপা হলে ‘ভালোবাসা’, বড়দের নামে হলে লেখা থাকত ‘আশীর্বাদ’। বর-কনের প্রশংসা ও শুভ কামনাই ছিল সে সব পদ্যের মূল বিষয়।

বিয়ের পদ্য ছাপানো উপহারপত্র সে কালে অনুষ্ঠানবাড়ির সাংস্কৃতিক অবস্থানেরও সূচক ছিল। কাব্যপ্রতিভাধারী আত্মীয় বা বন্ধু নিজেরাই লিখতেন অভিনব সব কবিতা। অন্যরা স্মরণ নিতেন ছাপাখানার। সে কালে সব ছাপাখানাতেই বিয়ের পদ্য ছাপা হত। এমনকী শুধু বিয়ের পদ্য ছাপিয়েই ব্যবসা চলত অনেক ছোটখাটো ছাপাখানার। মালা হাতে পরি, ফুল-লতাপাতার নকশা করা কাগজ তৈরি থাকত, ফরমায়েশ মাফিক নাম বদলে দিলেই হল। এর ফলে প্রায়ই যা হত— শ্রাবণ মাসে কোকিল ডেকে উঠত পদ্যে, ঘোর অমাবস্যার বিবাহলগ্নও ভেসে যেত ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়। সকলের তো আর কবি-বন্ধু বা সাহিত্য-ঘেঁষা আত্মীয় থাকত না। অথচ বিয়ের মরশুমে পদ্য চাই-ই চাই। তাই সাধারণের জন্য এই বাজারি ব্যবস্থাই সই। জাতি, ধর্ম, সামাজিক অবস্থান-নির্বিশেষে বিয়ের পদ্য ছাপাতেন সবাই।

আরও পড়ুন: দুশো বছর পেরিয়ে এসেছে ব্রহ্মসঙ্গীত

বর বড় না কনে, বিয়ের আসরের সেই প্রতিযোগিতারও অঙ্গ ছিল বিয়ের পদ্য। বরের বাড়ি থেকে ক’টা পদ্য ছাপা হল? কনের বাড়ি থেকেই বা কেমন পদ্য দিল? মজার গল্প শুনিয়েছেন পদ্মশ্রী যতীন্দ্রমোহন দত্ত। তাঁর বোনের বিয়ে উপলক্ষে কনেবাড়ি থেকে চারটে পদ্য ছাপিয়ে বিলি করা হয়েছিল। বিয়ে ঠিক হয়েছিল বর্ধমানে চান্ডু-র জমিদারবাড়িতে, পাত্র সেই আমলের মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার। তাদের ঘরে হাতি ছিল, ষোলো বেহারার পালকিও। অথচ বরের বাড়ি থেকে বিয়েতে একটিও পদ্য ছাপা হয়নি। সেই নিয়ে বাসরঘরে খুব পিছনে লাগা হল জামাইয়ের। কেউ বলল ‘রেঢ়ো’, কেউ আবার ছড়া কাটল: ‘কোঁচা লম্বা, কাছায় টান— তবে জানবে বর্ধমান!’

কাব্যিক: বিয়ের পদ্যে ঠাঁই হত প্যারডিরও। ‘ছোট মামার বিয়েতে’ ‘নীল নবঘনে’র ছায়া

‘বিয়ের মন্তর’ নামে একটি পদ্যের সঙ্কলনই প্রকাশ করে ফেলেছিলেন সত্যচরণ মিত্র। ১৩২০ সালের বৈশাখে, ছেলের বিয়ে উপলক্ষে প্রকাশিত সেই সংকলনে পদ্যের সংখ্যা মোট তিরিশটি। একটি পদ্যে লেখা:

আজকাল

পদ্যহীন বিয়ে— ভাবলে গা কেঁপে ওঠে

আরে ছি ছি লাজে মরে যাই,

বর কনে থাক বা না থাক,—

পুরুত আসুক আর নাই আসুক

(অন্ততঃ) একটা পদ্য চাইই চাই।

লাল নীল কাগজেতে যা’তা লেখা

লোকের হাতে দিলেই তাই

তার বদলে একটা ‘‘থ্যাংকস’’

পেলে এক্কেবারে বর্ত্তে যাই।

বরের কোষ্ঠী ও বংশপরিচয় নিয়েও লেখা হত পদ্য। সেগুলি মূলত ছাপা হত বন্ধুদের নামে। শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে পাওয়া ‘কাকুলীর বিয়েতে’ পদ্য লিখেছে ছোট একটি মেয়ে: ‘ও কাকুলী সত্যি বুঝি তোমার নাকি বিয়ে/ তুমি নাকি বউ আনবে টোপর মাথায় দিয়ে...’ নববধূর কাছে পদ্য-শেষে তার আবদার: ‘যত পাবে সাজার জিনিষ ভাগ যেন তার পাই।’ আবার ভরা বর্ষায় ‘ছোট মামার বিয়েতে’ পদ্য লেখা হচ্ছে রবিঠাকুরের ‘আষাঢ়’ কবিতার ছাঁদে: ‘শ্রাবণের মাঝে মামার বাড়ীতে তিল ঠাঁই আর নাহিরে।/ ওরে তোরা আজ যাস্‌নে আজিকে যাস্‌নে বাড়ীর বাহিরে।’ হাসি-মশকরাও ছিল— অবশ্যই সে কালের মূল্যবোধের নিরিখে। দাদামশায়ের চতুর্থ পক্ষের বিয়ে উপলক্ষে পাওয়া যাচ্ছে নাতিদের ছাপানো, চারিদিকে কালো বর্ডার দেওয়া পদ্য, বিষয়— নবপরিণীতার সম্ভাব্য একাদশীর ব্যবস্থা!

গ্রামেও জনপ্রিয় ছিল এই প্রথা। হাতে হাতে বিলি হত বিয়ের পদ্য। সেই সব পদ্যের কাগজ নিয়ে ছোটদের উৎসাহ ছিল অপরিসীম। এই বিষয় নিয়ে একটু খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, কলকাতার বাঙালি মুসলমান পরিবারেও এই রেওয়াজ ছিল। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘বণিক–বার্তা’ পত্রিকার একটা পুরনো সংস্করণে ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বিয়ের পদ্য থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় বসতি স্থাপন করা আবুল হাসানের স্মৃতি উদ্ধৃত করে তাঁর পুত্র ইফতিখার হাসনাত জানিয়েছেন, হাসান সাহেবের বিয়ে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, ১৯৪২ সালে। সেই বিয়ের কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন কবি সিকান্দার আবু জাফর। হাসান সাহেব ছিলেন ব্যায়ামবীর এবং প্রথম মুসলমান ‘মিস্টার বেঙ্গল’। রাবীন্দ্রিক শৈলীতে রচিত বিয়ের পদ্যে সেই বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে।

মধু বসন্ত জাগিল কি শেষে

মরমের তরুশাখে!

‘পেশীর দানব’ চঞ্চল হোল

‘রাঙা কুসুমের’ ডাকে?

অশান্ত আশা অন্তরে রাখি

পথে পথে যারে ফিরেছিলে ডাকি,

পেয়েছো কি আজ সন্ধান তার

বসন্ত ঝংকারে?

মনে রেখ ভাই এ ‘ফুল’ তোমার

ডাম্বেল, রিং নয়,

কুস্তিতে জেতা চলিবেনা হেথা

শুধু মানা পরাজয়।...

যুদ্ধের বাজার বলে বিয়ে থেমে থাকেনি। থেমে থাকেনি বিয়ের পদ্য ছাপাও। কবিতায় ছায়া পড়েছে যুদ্ধের, বাঙালি তার মধ্যেও অননুকরণীয় রসবোধে মশকরা করে গিয়েছে। নেমন্তন্ন খাওয়ার সময় যদি সাইরেন বেজে ওঠে? শুভদৃষ্টির মুহূর্তে যদি ব্ল্যাক আউট হয়ে যায়? এই সব সম্ভাবনাও উঠে এসেছে পদ্যে।

পদ্য নিয়ে আলোচনায় ঠাকুরবাড়ির প্রসঙ্গ না ছুঁয়ে গেলে হয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ের আশীর্বাদ বা উপহার হিসাবে প্রচুর লিখেছেন। তবে বিয়ে উপলক্ষে কোনও কবিতা নয়, প্রথম লিখেছিলেন দু’টি গান। ১৮৮১ সালে। গানদু’টির প্রথম লাইন— ‘দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি’ আর ‘মহাগুরু দুটি ছাত্র এসেছে তোমার’। দ্বিতীয় গানটি পরে পরিবর্তন করে করেছিলেন ‘শুভদিনে এসেছে দোঁহে’। গান দু’টি রাজনারায়ণ বসুর মেয়ে লীলাবতীর সঙ্গে কৃষ্ণকুমার মিত্রের বিয়ে উপলক্ষে লেখা।

এই গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও একটা ইতিহাস। লীলাবতীর বিয়েতে গানদু’টি গাইতে হবে বলে গায়কদের নিজেই তালিম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই গায়কদের দলে এক জনের নাম— ‘শ্রী নরেন্দ্রনাথ দত্ত’। ভবিষ্যতের স্বামী বিবেকানন্দের প্রিয় গানের মধ্যে ছিল ‘দুই হৃদয়ের যদি’— যা তাঁর সম্পাদনায় ‘সঙ্গীতকল্পতরু’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।

রবি ঠাকুর কলম ধরার পর রবীন্দ্রসৃষ্টি দিয়ে বিয়ের পদ্য সঙ্কলনের প্রচ্ছদ সাজানো শুরু হল। প্রথম পাতায় রবীন্দ্র-কবিতাংশ, ভিতরের পাতায় নিজেদের লেখা বিয়ের কবিতা। সেই উদাহরণও পাওয়া যায়। যেমন শোভাবাজার রাজবাড়ির অমল কৃষ্ণ দেবের বিয়ের পদ্য সঙ্কলনের প্রচ্ছদে কবিগুরুর রচনা:

নূতন পথের যাত্রী দুটি

ছুটছে যাহার সন্ধানে

যোগ করে দাও, এক করে দাও,

হলদে সুতোর বন্ধনে।

আরও যে বিয়ের উৎসবগুলিতে কবিগুরু তাঁর লেখা উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন, তার মধ্যে আছে বিহারীলাল গুপ্তের কন্যা স্নেহলতার বিয়ে, দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা নলিনীর বিয়ে, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ে, লীলাদেবীর বিয়ে, দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের কন্যা ইন্দিরার বিয়ে, কবি অমিয় চক্রবর্তীর বিয়ে, লালগোলার রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের বিয়ে, কোচবিহারের রাজকন্যা ইলাদেবীর বিয়ে ইত্যাদি।

কবির আশীর্বাণী সকলেই চাইত। কাউকে বিমুখ করতেন না তিনি। এ দিকে ফরমায়েশি লেখা লিখতেও মন চাইত না। সে কথা জানিয়েছিলেন চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের মেয়ের বিয়ের জন্য কবিতা পাঠানোর সময়। এই ধরনের সৃষ্টি সব নিশ্চয়ই ছাপা হয়নি। কে জানে, হয়তো কিছু বিয়ের পদ্য এখনও লুকিয়ে আছে কোনও পারিবারিক অ্যালবামের গহনে!

ছবি সৌজন্য: অলোক কৃষ্ণ দেব

Marriage Ceremony Invitation Card Poems
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy