Advertisement
E-Paper

বেদে সর্বোচ্চ নম্বর, তবু ক্লাসের বাইরে

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতে স্নাতক প্রথম মুসলমান ছাত্র। পরে বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর পৃষ্ঠপোষক।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতে স্নাতক প্রথম মুসলমান ছাত্র। পরে বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর পৃষ্ঠপোষক।

সুনন্দনকুমার সেন

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
সারস্বত: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌

সারস্বত: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌

তখন তিনি বসিরহাট কোর্টে ওকালতি করেন। স্বেচ্ছায় নয়, নিতান্তই পেটের দায়ে। শিক্ষকতা ও গবেষণা করা যাঁর সুপ্ত বাসনা, তাঁর কি ‘ব্যাড লাইভলিহুড’ ভাল লাগে? বিএল ডিগ্রিটার এই রকম নামই দিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ এক দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা। আশুতোষ তাঁকে বললেন, ‘‘বার ইজ নট ইওর প্লেস শহীদুল্লাহ্‌। জয়েন দি ইউনিভার্সিটি।’’ গত শতাব্দীর প্রথম অর্ধশতকে যত উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌।

জহুরি যেমন জহর চিনতে ভুল করে না, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ও শহীদুল্লাহ্‌কে চিনতে ভুল করেননি। আশুতোষ জানতেন, লেখাপড়া করার জন্য কত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে তাঁর এই ছাত্রটিকে। একে মুসলমান, তার উপরে পড়াশোনার বিষয় সংস্কৃত! তখনকার সমাজে এই সংমিশ্রণ বিরল। হুগলি কলেজে সংস্কৃত ও ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন শহীদুল্লাহ্‌। হরিনাথ দে’র পরামর্শে ইংরেজি ছেড়ে দিয়ে শুধু সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে আর পরীক্ষা দেওয়া হল না। লেখাপড়ায় ছেদ পড়ল। এক বছর পরে যখন বহিরাগত পরীক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিলেন, এক নম্বরের জন্য পাশ করতে পারলেন না। দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায়ে কলেজে ভর্তির চেষ্টাও ব্যর্থ হল। মুসলমান ছাত্রকে সংস্কৃতে ভর্তি করতে কলেজগুলি অনিচ্ছুক। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায় ভর্তি হলেন কলকাতা সিটি কলেজে। সম্ভবত ব্রাহ্ম সমাজ পরিচালিত কলেজ বলেই তা সম্ভব হয়েছিল। এক বছর পর বেদের পত্রে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সংস্কৃতে স্নাতক প্রথম মুসলমান ছাত্র তিনি।

ভাগ্যের পরিহাস তাঁর জীবনের চলার পথে সঙ্গী হয়ে থেকেছে। সংস্কৃত নিয়ে এমএ পড়তে এলেন। বেদের ভাষা, দর্শন তাঁর গভীর আগ্রহের বিষয়। পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রামী পড়াতেন বেদ। যবন ছাত্রকে বেদ পড়ানো সত্যব্রত সামশ্রামীর পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব নয়, তিনি শহীদুল্লাহ্‌কে ক্লাসে বেদ পড়াতে অস্বীকার করলেন। শোনা যায়, শহীদুল্লাহ্‌ ক্লাসের বাইরে বেঞ্চে বসে থাকতেন। বেদের ক্লাস না করতে পারলে তাঁর কাছে সংস্কৃত পড়া আর না পড়া একই ব্যাপার। আশুতোষ জানতেন বেদ নিয়ে শহীদুল্লাহ্‌র গভীর আগ্রহের কথা। সত্যব্রতের মতো গোঁড়া ব্রাহ্মণের মত পরিবর্তন কোনও মতেই সম্ভব নয় বুঝতে পেরে আশুতোষ ছাত্রকে পরামর্শ দিলেন সংস্কৃত ছেড়ে সদ্য-প্রতিষ্ঠিত তুলনামূলক শব্দবিদ্যা বিভাগে এমএ পড়তে। কারণ এই বিভাগে বেদ পড়ার সুযোগ আছে। শহীদুল্লাহ্‌র সেই মুহূর্তে সংস্কৃত ছেড়ে অন্য কোনও বিষয় নিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছে ছিল না, তবু আশুতোষের পরামর্শ তিনি গ্রহণ করলেন। কারণ ছোটবেলা থেকেই তাঁর ভাষার প্রতি প্রবল আগ্রহ। স্কুল জীবনেই নিজ চেষ্টায় প্রায় আট-ন’টি ভাষা শিখে ফেলেছিলেন। পারিবারিক ঐতিহ্য সূত্রে আরবি, ফারসি, উর্দু এবং বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে ইংরেজি ও সংস্কৃত। ছাত্রজীবনে হাওড়াতে থাকাকালীন এক উৎকলবাসী রজক পরিবারের সংসর্গে এসে ওড়িয়া ভাষাও শিখে ফেলেন। এ ছাড়াও হিন্দি, নিজ চেষ্টায় কিছুটা গ্রিক ও তামিলও শেখেন। শহীদুল্লাহ্‌ নিজেই বলেছেন, যে বয়সে ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াত, লাট্টু নিয়ে খেলা করত, সেই বয়সে তিনি ভাষাশিক্ষার জন্য সময় দিতেন।

ভাষা শেখার প্রতি যাঁর এত তীব্র আগ্রহ, তাঁর পক্ষে তুলনামূলক শব্দবিদ্যা নিয়ে এমএ পড়ার সুযোগ কিছু কম নয়। ভাষার উৎপত্তি, বিবর্তন, পরিবর্তন, ভাষার সংগঠন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে জানার, শেখার সুযোগ আছে তুলনামূলক শব্দবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনায়। সর্বোপরি আছে বেদ পড়ার সুযোগ। যথাসময়ে এমএ পাশ করলেন। তুলনামূলক শব্দবিদ্যা বিভাগের প্রথম এমএ পাশ করা ছাত্রও শহীদুল্লাহ্‌। তিনি ওকালতি করুন তা স্যর আশুতোষ চাননি। মামলা-মোকদ্দমার দুনিয়া থেকে লেখাপড়ার জগতে আবার শহীদুল্লাহ্‌কে ফিরিয়ে আনলেন আশুতোষ। তাঁর মধ্যে যে একটা সম্ভাবনা ছিল তা শুধু আশুতোষই প্রত্যক্ষ করেননি, সমকালীন যে যে বাঙালি মনীষীর সংস্পর্শে শহীদুল্লাহ্‌ এসেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁর বিদ্যাচর্চার গভীরতা এবং‌ অনুরাগ দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: নিষ্কৃতি মৃত্যুও শাস্ত্রসম্মত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহ পেয়েছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌। শান্তিনিকেতনে একাধিক বার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎও হয়েছিল। বিশ্বকবি নিজের ছবি ও বই উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে। বিশ্বভারতী যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তার ম্যানেজিং কমিটিতে রবীন্দ্রনাথ তরুণ গবেষক শহীদুল্লাহ্‌কে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। যদিও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে রবীন্দ্রনাথের এই অনুরোধ তিনি গ্রহণ করতে পারেনি।
কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল। বাংলা বানান সংস্কার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ শহীদুল্লাহ্‌কে চিন্তা-ভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধেই তিনি বাংলা বানান সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত মত প্রকাশে উদ্যোগী হন। শহীদুল্লাহ্‌ মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র কবি, সাহিত্যিক বা দার্শনিক নন। তিনি আমাদের দেশের এক জন প্রথম শ্রেণির ভাষাবিদও বটে।

শহীদুল্লাহ্‌ প্রায় দু’বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের গবেষক সহকারী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করার সময়েই শহীদুল্লাহ্‌ বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হন। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছেন, তখন দীনেশচন্দ্র সেন উদ্যোগী হয়েছিলেন তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেখে দেওয়ার জন্য। তাঁর বিদ্যাচর্চার ব্যাপ্তি দীনেশচন্দ্রকে আকৃষ্ট করেছিল। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, শহীদুল্লাহ্‌র সঙ্গে আলাপচারিতায় সব সময় কিছু না কিছু শেখার সুযোগ থাকে।

তাঁর জন্ম এক গোঁড়া মুসলমান পরিবারে। তিনি নিজেও ছিলেন এক জন নিষ্ঠাবান মুসলমান। পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যাভাসে নিজ ধর্মের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে চাইতেন। কিন্তু তাতে কোনও সাম্প্রদায়িকতার স্থান ছিল না। কোরান অধ্যয়নে তাঁর যতটা আগ্রহ ছিল, ঠিক ততটাই উৎসাহ ছিল বেদ বা পালি সাহিত্য অধ্যয়নে।

মাতৃভাষার প্রতি ছিল অবিচল ভক্তি। বাংলার প্রতি কোনও অবিচার তিনি সহ্য করতেন না। পূর্ব পাকিস্তানের উপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। এই নিয়ে কলম ধরতেও দ্বিধা করেননি। মাতৃভাষা আন্দোলনে নিজে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না করলেও ছাত্রসমাজকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। আন্দোলনের সময় নিজের কনিষ্ঠ পুত্রকে বলেছিলেন, ‘‘মাতৃভাষার জন্য যদি তোমার প্রাণ যেত, আমার কোনও দুঃখ থাকত না।’’ একেই তিনি সংস্কৃতের ছাত্র, তার উপর মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ। স্বাভাবিক ভাবেই দেশের সরকারের রোষে পড়েছিলেন। তিনি ‘হিন্দু ঘেঁষা’, এই তকমাও ছিদ্রান্বেষীরা দিতে দ্বিধা করেনি। দেশভাগের অনেক পরে ভারত সরকার তাঁকে একটি ফেলোশিপ দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘হিন্দু ঘেঁষা’ শহীদুল্লাহ্‌কে তাঁর দেশের সরকার এই ফেলোশিপ গ্রহণ করার অনুমতি দেয়নি।

সারা জীবন লেখাপড়া, গবেষণা, অধ্যাপনা করে গিয়েছেন শহীদুল্লাহ্‌। এগুলিই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি ছিল অকুণ্ঠ ভালবাসা ও স্নেহ। সর্বদা তাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলেন। কোনও অসুস্থ ছাত্র বা ছাত্রীকে আর্থিক সাহায্য করা, ঠিক সময় বেতন দিতে না পারার জন্য কোনও ছাত্রের নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা থেকে কাটা গেলে তাকে সাহায্য করা— এই সবই করে গিয়েছেন অক্লেশে। কোনও পড়ুয়ার বিবাহের প্রস্তাব হয়তো পরিবার-পরিজন গ্রহণ করছেন না, তাঁদের বুঝিয়েছেন। প্রকৃত ছাত্রদরদি এক শিক্ষক ছিলেন তিনি। শুধুমাত্র বিদ্যাদান নয়, ছাত্র-ছাত্রীদের মানুষ করে তুলতে চাইতেন। তাঁদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতেন স্বদেশপ্রীতি, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ।

ভাল খাওয়া-দাওয়ার প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। মনে করতেন, স্বাস্থ্য ভাল না হলে পড়াশোনা কি গবেষণা-অধ্যাপনা, সবই বৃথা। তাই জীবন ধারণের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেন। মাংস, বিশেষ করে গো-মাংসের প্রতি ছিল তাঁর ছিল গভীর আকর্ষণ। ঢাকার যে অঞ্চলে বাড়ি করেছিলেন তার পাশেই ছিল কসাইপাড়া। কখনও যদি কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন, এমন জায়গায় বাড়ি করলেন কেন? তার উত্তরে বলতেন, ‘‘স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য গোস্ত খাওয়ার প্রয়োজন। পাশেই কসাইপাড়া, হাত বাড়ালেই গোস্ত পাওয়া যায়।’’ এমনই রসিক মানুষ ছিলেন তিনি।

তাঁর বিয়ে হয়েছিল ১৯১০ সালের ১০ অক্টোবর। হালকা চালে বলতেন, ‘‘আমার বিবাহের দিনটা মনে রাখা সহজ। টেন কিউব।’’ সারা জীবন গুরুগম্ভীর বিদ্যাচর্চা করলেও আসলে মানুষটি ছিলেন সহজ সরল মনের।

যে বাংলা ভাষা, যে বাঙালি সংস্কৃতি ছিল তাঁর একান্ত গর্বের জায়গা, জীবদ্দশায় তার বিভাজন তাঁকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল। কর্মসূত্রে সেই যে ঢাকা গিয়েছিলেন, আমৃত্যু ছিলেন সেখানেই। শেষ জীবনে খুব ইচ্ছে ছিল এক বার নিজের মাতৃভূমিতে আসার। কিন্তু সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। তবু কোনও ভৌগোলিক বিভাজন শহীদুল্লাহকে মাতৃভূমি থেকে আলাদা করতে পারেনি। সাক্ষী তাঁর ঢাকার বাসভবন। নাম রেখেছিলেন, ‘পেয়ারা ভবন’। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া থানার অন্তর্গত পেয়ারা গ্রাম যে তাঁর জন্মভূমি! মাতৃভূমিকে কি কখনও ভোলা যায়! সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে তিনি এক জন প্রকৃত বাঙালি।

Muhammad Shahidullah Writer Educationist Linguist Philologist মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ University Of Calcutta CU
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy