Advertisement
E-Paper

কে সভ্য, কে বর্বর বলে গেছেন রামনাথ বিশ্বাস

কালো সঙ্গীদের ত্যাগ করতে চাননি, তাই ভারতীয়রা এই বাঙালিকে বার করে দিত ধর্মশালা থেকে। নয়ডায় কালো ছাত্রদের পাড়াছাড়া করার শিকড় মেলে এখানেই। স্বাতী ভট্টাচার্যএক ভারতীয় আইনজীবী যাচ্ছিলেন ডারবান থেকে প্রিটোরিয়া। ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট, সেখানেই বসেছেন। এক সাহেব উঠে হাঁকডাক শুরু করলেন, কী করে একটা কুলি এখানে বসে? সাদা-চামড়া চেকার এসে স্টেশনে ঠেলে ফেলে দিলেন যুবককে। প্ল্যাটফর্মে আছড়ে পড়ল তার মালপত্র।

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

এক ভারতীয় আইনজীবী যাচ্ছিলেন ডারবান থেকে প্রিটোরিয়া। ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট, সেখানেই বসেছেন। এক সাহেব উঠে হাঁকডাক শুরু করলেন, কী করে একটা কুলি এখানে বসে? সাদা-চামড়া চেকার এসে স্টেশনে ঠেলে ফেলে দিলেন যুবককে। প্ল্যাটফর্মে আছড়ে পড়ল তার মালপত্র।

সেটা ছিল ১৮৯৩। কাট টু ১৯৩৮। ডারবান থেকে এক ভারতীয় যুবক চলেছেন কিলিমাঞ্জারো পর্বতের নীলপদ্ম দেখতে। সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গী তারু। ভারতীয়দের জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির কামরা বরাদ্দ, কালোদের জন্য তৃতীয় শ্রেণি। মেঝেতে চাটাই পাতা, একটা কামরা ঠাসা হলে তবে খোলা হয় অন্য কামরা। তারুর ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট। তার পর? ‘ভারতীয় চেকার তারুকে কোনও মতেই দ্বিতীয় শ্রেণিতে বসতে দেবে না। শেষটায় আমিও স্বরূপ ধরলাম। ‘তোমার আইন তোমার কাছে রাখো, নতুবা মেরে হাড় ভেঙে দেব,’ যখন বললাম তখন লোকটার চৈতন্য হল। চেকার আমাকে ‘কংগ্রেসি’ বলে গালি দিয়ে গাড়ি ত্যাগ করল।’

কাট টু ২০১৭। ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রনেতা। কলেজপড়ুয়া আফ্রিকান ছাত্ররা নরখাদক, এমন অভিযোগের সামনে ক্রোধে কঠিন তাঁর মুখের রেখা। বললেন, ‘মার্কিনি বা অস্ট্রেলীয়দের চাইতেও বেশি জাতিবিদ্বেষী ভারতীয়রা।’

মানতে মন চায় না। কিন্তু অবিশ্বাসের পথ আটকে দাঁড়িয়ে রামনাথ বিশ্বাস। তাঁর নাম শুনলেই সকলের মনে পড়ে ‘সাইকেল।’ মনে পড়া উচিত আলপিন। ভারতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা— সযত্নে ফোলানো বেলুনে এই বাঙালি যতগুলো পিন ফুটিয়েছেন, ভূভারতে তার জুড়ি কম। খানিকটা করেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বাঙালির আলস্য, জাতবিচার, চাকরবৃত্তির জন্য। তবে সেটা ‘তোদের দ্বারা কি কিছুই হবে না রে?’ গোছের আক্ষেপ। রামনাথ যা করেছেন, তা আদতে সাংবাদিকতা। ইউরোপীয়, ভারতীয়, আফ্রিকানদের সম্পর্কে তিনি সমান অনুসন্ধানী। যেমন, ধারালো দাঁতের কৃষ্ণাঙ্গ রামনাথও দেখেছেন কুল-মানজার, বা কিলিমাঞ্জারোতে। ‘সংবাদ নিয়ে জানলাম, এটা এদের ফ্যাশান মাত্র। এখানকার লোক নরমাংস কখনও খেয়েছে বলে আজ পর্যন্ত কেউ শোনেনি।’

রামনাথ যে জেদি আর গোঁয়ার-গোবিন্দ ছিলেন, সে তাঁর জীবনীকারই লিখেছেন। তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়, একটু খ্যাপাটেও ছিলেন। এক বার মনে হল, পকেটের একশো পাউন্ডের চিন্তায় জঙ্গলের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাচ্ছে না। অমনি দুই কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীকে ডেকে টাকাগুলো দিয়ে দিলেন, কাকে কত দিলেন গুনলেনও না। ঝাড়া হাত-পা হয়ে ভারী খুশি তিনি। ‘এবার আমি স্বাধীন। টাকা বড় বালাই।’ শেষে এক দিন বিরক্ত হয়ে দুই সঙ্গী ছেড়ে গেল। বিরক্তির কারণ, তাদের হাঁটার গতির সঙ্গে সাইকেলেও তাল রাখতে পারছেন না রামনাথ। যাওয়ার সময়ে গুনে টাকা ফেরত দিয়ে বলে গেল, দেখো, সাদাদের মতো বদনাম কোরো না। রামনাথ কৃষ্ণাঙ্গদের গ্রামে থেকেছেন, তাঁদের সঙ্গে খেয়েছেন, ঘুমিয়েছেন এক মশারির নীচে। তাই তিনি যখন লেখেন, কৃষ্ণাঙ্গরা ঘিয়ে ভেজাল দিতে শেখেনি, তাদের সমাজে উঁচু-নিচু নেই, তারা সৎ, শিক্ষিত, পরিশ্রমী, তখন তা অতিশয়োক্তি মনে হয় না।

রামনাথের দৃষ্টি নির্মোহ। জাতীয়তার গৌরব চিন্তার স্বচ্ছতাকে ঘুলিয়ে দেয়নি। বেনারসের গলি অপরিষ্কার আর জানজিবারের গলি পরিষ্কার, লিখছেন তিনি। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ সিন্ড্রোম-ও কাবু করতে পারেনি। ফলে পদে পদে সংঘাত বেধেছে। টাংগা (এখন তানজানিয়াতে) শহরে এক ধর্মশালায় ঘুমোচ্ছেন রামনাথ, সঙ্গে পাঁচ কৃষ্ণাঙ্গ। রাত দুটোয় বার করে দেওয়া হল তাঁকে। ‘নিগ্রো-সঙ্গ পরিত্যাগ’ না করার শাস্তি। বাইরের আমগাছের নীচে রাত কাটালেন শ্রীহট্টের ব্রাহ্মণসন্তান (পরিবার উপাধি পেয়েছিল ‘বিশ্বাস’)। ভোর হতে ব্যাপার দেখে গ্রিকরা বলে গেল, ‘এক ঘৃণিত অন্য ঘৃণিতকে ঘৃণা করে।’

আর এক বাঙালিকেও ‘নিগ্রো’ বলে লাঞ্ছনা সইতে হয়েছিল। সেটা আমেরিকায়। হোটেল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে মালিক, সেলুন দাড়ি কাটতে রাজি হয়নি। এক ভক্ত প্রশ্ন করেছিল, কেন তিনি বলেননি তিনি নিগ্রো নন, ভারতীয় হিন্দু? স্বামী বিবেকানন্দ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘অপরকে ছোট করে আমি বড় হব?’

কেনিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, এই ছিল রামনাথের আফ্রিকা সফর। গাঁধীর জাতভাই গুজরাতি বানিয়ারাই আফ্রিকায় বাস করতেন বেশি, আর তাঁরাই বিশেষ করে রামনাথকে নিষেধ করতেন নিগ্রোদের সঙ্গে থাকতে। ইংরেজ আর জার্মান সাহেবরা যতটা তাচ্ছিল্য করত ভারতীয়দের, তারা আবার ততটাই আফ্রিকার মানুষদের। সাদাদের ইস্কুলে ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ, ভারতীয়দের ইস্কুলে কৃষ্ণাঙ্গদের। শিক্ষক সোয়াহিলি বলে ফেললেই চাকরি যেত।

রামনাথ ‘নিগ্রো’ শব্দটি আগাগোড়া ব্যবহার করেছেন, কারণ তখনও শব্দটি ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাঁর কলমে ভারতীয়দের ভণ্ডামি আর কৃষ্ণাঙ্গদের সরলতা যেন সাদা-কালোয় আঁকা। ‘আমরা কালীর দরজায় পাঁঠা বলি দিয়ে দেনা শোধ করি। মুসলমানেরা জবাই করে পুণ্য অর্জন করে। নিগ্রোরা সে ধরনের ‘‘ধর্মকর্ম’’ এখনও শেখেনি।’ ভারতীয়রা জাত বাঁচাতে নিগ্রো স্ত্রীকে দূরে রাখে, সন্তানদের অস্বীকার করে, এটা পীড়িত করেছে তাঁকে।

রামনাথ কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন ছিলেন। জাতপাতের বিরুদ্ধে তাঁর কড়া অবস্থান হয়তো আশ্চর্য নয়। অবাক হতে হয় দেখে যে সাম্যের বৃত্তে মেয়েদেরও অনায়াসে স্থান দিয়েছেন তিনি। ন্যাসাল্যান্ডের এক বাজারে মেয়েরা টুকরিতে চাল এনে বিক্রি করছে। তার টাকা নিয়ে বাজার থেকে নানা জিনিস কিনে বাড়ি ফিরছে। প্রত্যেকটি মেয়ে দিগম্বরী। প্রেমিকের দল পিছু নিচ্ছে। উত্যক্ত বোধ করলেই মেয়েটি একটি হাঁটু মাটিতে ছোঁয়াচ্ছে, অমনি প্রেমিক ভিন্ন পথে চলে যাচ্ছে। রামনাথের আক্ষেপ, ‘ন্যাসাদের স্ত্রী স্বাধীনতা দেখলে মনে হয় ভারতের স্ত্রীলোক যেন ভারতের পুরুষদের দাসী হয়েই জন্মগ্রহণ করেছে।’ আজকের অ্যান্টি-রোমিয়ো স্কোয়াড জানলে নিষিদ্ধ বই হবে ‘অন্ধকারের আফ্রিকা।’

কে যে সভ্য, আর কে বর্বর, রামনাথের চোখ দিয়ে দেখলে তার কিছুটা আন্দাজ মেলে। বেঁচে থাকলে হয়তো ফের কলম ধরতে হত। সাতষট্টি বছর পেরিয়ে পরবর্তী খণ্ড, ‘অন্ধকারের নয়ডা।’

Ramnath Biswas Civilized Savage
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy