Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ভূমি সূত্র

হেডমাস্টার শ্বশুর বললেন, পড়া গেল না

১৯৭৮ সালে ‘প্রমা’ নামে একটি পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। সম্পাদকমণ্ডলীতে কয়েকটি নক্ষত্র— অরুণ মিত্র, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, পবিত্র সরকার। কার্যকরী সম্পাদক সুরজিৎ ঘোষ। এখন অরুণ মিত্র ও সুরজিৎ ঘোষ প্রয়াত। প্রথম সংখ্যাটি থেকেই পত্রিকাটি ছিল বেশ উঁচু মানের। মহাশ্বেতা দেবী, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সৌরীন ভট্টাচার্য, শিশিরকুমার দাশরা এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।

স্বপ্নময় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

১৯৭৮ সালে ‘প্রমা’ নামে একটি পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। সম্পাদকমণ্ডলীতে কয়েকটি নক্ষত্র— অরুণ মিত্র, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, পবিত্র সরকার। কার্যকরী সম্পাদক সুরজিৎ ঘোষ। এখন অরুণ মিত্র ও সুরজিৎ ঘোষ প্রয়াত। প্রথম সংখ্যাটি থেকেই পত্রিকাটি ছিল বেশ উঁচু মানের। মহাশ্বেতা দেবী, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সৌরীন ভট্টাচার্য, শিশিরকুমার দাশরা এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। এক দিন সুরজিৎ ঘোষের চিঠি পেলাম। বলছেন— এই পত্রিকায় গল্প লিখতে হবে।
আমি আহ্লাদিত। ওই পত্রিকায় গল্পও ছাপা হতে দেখেছি। মহাশ্বেতা দেবী, মতি নন্দী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়াও জয়ন্ত জোয়ারদার, সাধন চট্টোপাধ্যায়, কল্যাণ মজুমদারদের গল্প দেখেছি। ওঁদের সঙ্গে আমিও? এর আগে পাঁচ-সাতটার বেশি গল্প লিখিনি। প্রথম বইটির কথা বলতে গিয়ে প্রথম লেখাটার কথাও একটু বলতে হয়। ১৯৭২ সালে আমার প্রথম গল্প ছাপা হয় ‘অমৃত’ পত্রিকায়। মণীন্দ্র রায় ছিলেন সম্পাদক। পরের গল্প দুটো ‘চতুরঙ্গ’ এবং ‘মধ্যাহ্ন’ পত্রিকায় পাঠাই। ছাপা হয়। এর পর কয়েক বছর লেখা হয় না। চাকরির চেষ্টা, চাকরি পাওয়া, ছাড়া, আবার চেষ্টা...
১৯৭৩-১৯৭৭ তেমন লিখিনি। গল্পের উপাদান চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছি শুধু। বাগবাজারের এক গলির ছেলের কাছে কত বড় পৃথিবীর কতগুলো জানলা খুলে গেল কয়েকটা বছরে। যাদব-কুর্মি-ভূমিহার; ছাতু-লিট্টি; লোন্ডা-ঝুমুর নিয়ে বিহার। পশ্চিমবাংলার গ্রামের গভীরে গিয়ে দেখলাম মাটির সঙ্গে মানুষের কী নিবিড় আর জটিল সম্পর্ক। অবাক হয়ে দেখি, ধানের ভিতরেও দুধ হয়। ধান-খাওয়া মাঠের ইঁদুর এবং ইঁদুর-খাওয়া মানুষের আহ্লাদ। হাঁড়ি-ভর্তি গাঁজলা-ওঠা তাড়ি ঘিরে গাঁজলা-মুখ মানুষের সান্ধ্য সঙ্গীত। অন্ধকারে আকন্দ-ধুঁধুল জোনাকিতে ভরে গিয়েছে। বাবুইয়ের বাসা দোলে দখিনা বাতাসে! আলো আর বুলবুলি খেলা করে। পটে আঁকা ছবিটির মতো ছোট্ট নদীটির চরে শিশুরা করে খেলা, নিজেদের ত্যাগ করা বিষ্ঠা থেকে কাঠির আগায় বের করে নেয় নিজের পেটের কৃমি, খেলা করে। শুখা নদীর বালি খুঁড়ে জল বের করাও দেখি। শুনি গো-রাখালের কথকতা। বুঝলাম রায়ত-আধিয়া-কোর্ফা-মুনিষ-মাহিন্দার। এ যেন এক বিস্ময়-বিহ্বল আবিষ্কার। আমার চোখে ক্রম-উন্মোচিত গ্রামবাংলাকে নিয়ে পর পর কয়েকটা গল্প লিখতে থাকি। খুব ছোট কাগজেই লিখতাম। পদাবলী, কল্পবাণী, উত্তরকাল... বড় কাগজে লেখা না-পাঠানোর পক্ষে কোনও জুতসই যুক্তি আমার কাছে নেই। পবিত্র সরকার তখন শিকাগো থেকে ফিরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার পড়াচ্ছেন। উনিই সুরজিৎ ঘোষকে আমার কথা বলেন। আমি প্রমা-য় গল্প লিখি। প্রথম গল্পটি সম্ভবত ‘ভাল করে পড়গা ইস্কুলে’। তখন আমি হাওয়া অফিসে। এর কিছু আগে ‘ভূমি-ভূস্বামীর ভূত ও ভবিষ্যত’ নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম একটা ছোট কাগজে। ভূমি-রাজস্ব দফতরে চাকরির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় প্রবন্ধটি লেখা। নামকরণে বিনয় ঘোষের প্রভাব। প্রবন্ধটা পড়ে অনুষ্টুপ সম্পাদক অনিল আচার্য আমাকে ওঁর পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে বলেন। উনি তখনও আমার গল্প পড়েননি। আমি বলি, গল্পই তো লিখি, গল্প লিখতেই ভাল লাগে। উনি বলেছিলেন, তা হলে তা-ই দিন। ভাল লাগলে ছাপব। এর পর ছাপা হতে লাগল প্রমা এবং অনুষ্টুপে। আমার বেশ খাতির হতে লাগল— কারণ দুটো গণ্য করার মতো পত্রিকায় বছরে দুটো করে গল্প বেরচ্ছে। নান্দীকার-এর ঘরে একটা গল্প পড়া হয়েছে, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় নাটক করার কথা ভাবছেন।

কফি হাউসে আসতেন সুরজিৎ ঘোষ। উনি ছিলেন ই়ঞ্জিনিয়ার। অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল। মুজতবা, বাদল সরকার, শঙ্খ-শক্তি-থার্মোডাইনামিক‌্স মুখস্থ বলে যেতেন। ওই আড্ডায় ১৯৮০ নাগাদ বললেন, বইও পাবলিশ করব প্রমা থেকে। বাছা বাছা বই বেরুবে।

তার পর কফি হাউসে এক দিন বললেন, স্বপ্নময়, দশ-বারোটা গল্প রেডি করো। তোমার একটা বই করব। সত্যি বলতে কী, বই করার বিলাসিতা ভাবিইনি। আমার চেনাজানা কেউ কেউ বই করেছিল। তাদের নিজেদের টাকা খরচ করে বই করতে হয়েছিল। প্রথমেই বলে নিলাম, টাকা? সুরজিৎ বললেন, তোমায় ভাবতে হবে না।

তত দিনে সতেরো-আঠেরোটা গল্প বেরিয়েছে। আমি দশটাই বাছলাম (বাকিগুলোর সন্ধান আমার কাছেও এখন আর নেই)। বেছে নেওয়া সব ক’টা গল্পই ছিল মাটির সঙ্গে জড়ানো মানুষদের নিয়ে। কৃষি মজুর, বর্গাচাষি, ভূমি সংস্কার করতে আসা সরকারি কর্মচারি, জোতদার, এরাই ছিল সব মুখ্য চরিত্রে। বইটার নাম দেব ভেবেছিলাম, ‘মা-মাটি-মানুষ’। একটি গল্পে, ভূমিহীনদের বিলি করা জমি কী ভাবে আবার পুরনো মালিকের কাছেই ফিরে যায়, সেই কাহিনি বলা ছিল। গল্পটার নাম ছিল ‘ভূমির নিত্যতা সূত্র’। পদার্থবিদ্যার ‘শক্তির নিত্যতা সূত্র’ মাথায় রেখে ওই নামকরণ, যে সূত্রের প্রতিপাদ্য হল, শক্তির বিনাশ নেই। সে কেবল রূপ পালটায়। শেষ পর্যন্ত বইটির নাম ‘ভূমি সূত্র’ রাখলাম। ভাগ্যিস নাম পালটেছিলাম। খরাক্লিষ্ট জমির ছবির ওপর, ভূমি সম্পর্কিত আইন ও ভূমি বিরোধের খবরের কাটিং কোলাজ করে একটি প্রচ্ছদ তৈরি করেছিলেন দেবব্রত রায়। প্রুফ দেখেছিলেন পবিত্র সরকার। বইটিতে কোনও ছাপার ভুল ছিল না। ১৯৮২ সালের বইমেলার মধ্যেই বইটি বেরিয়েছিল। মনে আছে, আবেগের বিহ্বলতা-জনিত কোনও থরোথরো অনুভূতি হয়নি। ব্যাগে করে দশটি বই নিয়ে এসেছিলাম বাড়িতে। মা বেঁচে নেই। বাবা এক বার দেখলেন, ব্যস। ক’দিন পরে সুরজিৎ ঘোষ জানালেন, মহাশ্বেতা দেবী বইটা পড়েছেন। কথা বলতে চাইছেন। তাড়াতাড়ি যাও। ওঁকে প্রথম দেখার অনুভূতি এখন থাক।

চার বছরে প্রথম সংস্করণ শেষ হয়েছিল। পরে আরও দুটো সংস্করণ হয়। এখন বইটি পাওয়া যায় না।

বই আর বউ একই সময় হয়েছিল আমার। বইটি যখন সদ্যপ্রকাশিত, আমিও সদ্যবিবাহিত। একটা কপি রাষ্ট্রপতির পুরস্কার পাওয়া আমার হেডমাস্টার শ্বশুরমশাইকে দিয়েছিলাম। ক’দিন পর উনি বইটা ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, ‘পড়া গেল না।’ দেখলাম গল্প সংশোধন করেছেন। গু কেটে বিষ্ঠা, রাঁড় কেটে বিধবা। এক জায়গায় ছিল একটি বালক ‘বাগালি’ না করে স্কুলে যাচ্ছে বলে ওর বাবা ওকে বলছে, অ্যাঁঁড় ছিচে দুব।

কেটেছেন। কিন্তু বিকল্প শব্দ বসাতে পারেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE