Advertisement
E-Paper

সিনেমায় আমার গাওয়া গান এখন ইউটিউবে

তখন শিশু রংমহলে, গান শুনিয়ে দিলাম ভি বালসারাকে। তাঁর সুরে আমার গাওয়া গান নিয়ে সিনেমাও মুক্তি পেল। তারই মাঝে পাড়ার মাঠে কখনও যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার, কখনও বা তিন চাকার সাইকেল রেসে বরাবর সকলের শেষে। তখন শিশু রংমহলে, গান শুনিয়ে দিলাম ভি বালসারাকে। তাঁর সুরে আমার গাওয়া গান নিয়ে সিনেমাও মুক্তি পেল। তারই মাঝে পাড়ার মাঠে কখনও যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার, কখনও বা তিন চাকার সাইকেল রেসে বরাবর সকলের শেষে।

দীপেশ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
শৈশব: অন্নপ্রাশনের দিন, বাবার কোলে।

শৈশব: অন্নপ্রাশনের দিন, বাবার কোলে।

ছেলেবেলায় প্রথম স্মৃতির গুচ্ছ জড়িয়ে আছে পার্ক সার্কাসের কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস রোডের সঙ্গে— যেখানে আমরা একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। পাশেই তারক দত্ত রোডে একটি বাড়ির দোতলায় পুব বাংলা থেকে আগত মামাবাড়ির যৌথ পরিবার। সবচেয়ে পুরনো দু’টি স্মৃতি। সুখের স্মৃতি ভোরবেলা বাবার সঙ্গে বেরিয়ে ট্রাইসাইকেল চালানো। পার্ক সার্কাসের বড় রাস্তার দু’পাশে অনেক গাছ ছিল— একটি কাঠবাদামের গাছের তলা থেকে ঝরা কাঠবাদাম কুড়িয়ে বাড়ি ফিরতাম। তার পর সেই বাদামের খোলা ভেঙে বাদাম আবিষ্কারে বেশ একটি জয়ের আনন্দ ছিল। দ্বিতীয় স্মৃতিটি দুঃখের, পরাজয়ের। সুরেশ বিশ্বাস রোডের ছোটদের মধ্যে— ছেলেদের মধ্যেই— ট্রাইসাইকেল রেস হত। আমি যতই জোরে পা চালাই না কেন, আসতাম সবার শেষে। লাস্ট হয়ে খুব মন খারাপ হত। শারীরিক খেলাধুলোর প্রতিযোগিতায় অনাগ্রহী হতাম। টালিগঞ্জের পাড়ায় গিয়ে সেই অনাগ্রহ কিছুটা কেটেছিল।

পার্ক সার্কাস ময়দানের কাছেই প্রতিষ্ঠিত একটি ছোট স্কুলই আমার প্রথম স্কুল। যত দূর মনে পড়ে, বালিগঞ্জ পার্ক ডে স্কুল কি এই রকম কিছু তার নাম। এই স্কুলের আমার একটি স্মৃতি আছে, তাও বেশ লজ্জার। এক দিন খুব ‘ছোট বাথরুম’ পেলেও দিদিমণিকে কথাটি ইংরিজিতে কী ভাবে বলতে হবে বুঝতে না পেরে প্যান্ট নষ্ট করেছিলাম। বিজাতীয় ভাষা শেখার মধ্যে যে কত অপমান ও হেনস্তা লুকিয়ে থাকে, সে কথাটি সে দিনের ওই স্মৃতির কথা ভাবলে এখনও মনে হয়!

যে বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম পার্ক সার্কাসে, সেটি পূর্বে ছিল কোনও মুসলমান ভদ্রলোকের বাড়ি। তিনি দেশের অবস্থা দেখে বাড়ি-আসবাবপত্র সবই— ধরে নিচ্ছি সুলভেই— বিক্রি করে পূর্ব পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন। আমাদের বাড়িওয়ালা কিনেছিলেন বাড়িটা, আমার বাবা কিনেছিলেন ভদ্রলোকের সমস্ত ফার্নিচার। নিশ্চয়ই সস্তায় পেয়েছিলেন, কারণ বাবা মধ্যবিত্ত ছিলেন, কিন্তু বড়লোক তো ছিলেন না! আমার মায়ের বাড়ির মানুষেরা পুব বাংলা ছেড়ে পশ্চিমে এসেছিলেন একই কারণে— ওঁদের মনে হয়েছিল মুসলিম-প্রধান দেশে থাকা দুষ্কর। অথচ ইতিহাসের রসিকতাটা ভাবুন! আমার বাবা-মা অন্তরঙ্গ জীবনের খাট-বিছানা, মা’র স্নো-পাউডারের ড্রেসিং টেবিল— সবই ছিল কোনও মুসলমান দম্পতির ব্যক্তিগত জীবনের অংশ। ছোটবেলা থেকেই হিন্দু-মুসলমানের কাজিয়া ও ১৯৪৬-এর দাঙ্গার কথা শুনে বড় হয়েছি, কিন্তু পরে মনে হয়েছে হিন্দু-মুসলমানের ইতিহাসে ব্যবধান ও নৈকট্য কেমন হাত-ধরাধরি করে আছে, কত নিবিড় এই আপাত-দূরত্ব।

আরও পড়ুন: কণ্ঠ ছাড়ো জোরে

হয়তো যখন আমার ছ’সাত বছর বয়স, তখন আমরা টালিগঞ্জ চলে গেলাম। বাবা সেখানে জমি কিনে একতলা বাড়ি বানালেন, সে অঞ্চলটি তখনও কলকাতা কর্পোরেশনের এক্তিয়ারের বাইরে। আমাদের কেনা আড়াই কাঠা জমির আদি মালিক চারুচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি তখন বর্তমান নন, তাঁর পুত্র দেবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর কনিষ্ঠ ভাইরা মালিক। আমাদের বাড়ির পাশে এক টুকরো রাস্তা, তার ও পাশেই ‘দেববাবু’দের জমির একটি প্রান্তদেশ। সেখানে একটি বড় পুকুর, তার তিন পাশে ডাব আর তালগাছ। সেই সব গাছ ভরা শকুন পাখির বাসা, আর প্রতি দিন পুকুরে স্নান করতে আসত নিকটস্থ ঘড়িঘরের বস্তির মুসলমান মেয়েরা। তাঁদের দেখলেই বোঝা যেত তাঁরা খুব গরিব। হয়তো তাঁদের পূর্বপুরুষেরা টিপু সুলতানদের বংশধরদের সঙ্গে কলকাতা এসেছিলেন। সেই সব রাজপুত্রদের বানানো মসজিদের পাশেই ছিল ঘড়িঘর। বড় হতে হতে কখনও দাঙ্গার সম্ভাবনা হলে হিন্দুপাড়ায় সবার মনে ভয় জাগত যে ওই বস্তির মুসলমানরা— যাদের গলি দিয়ে আমাদের প্রতিদিনের চলাফেরা— তারা হয়তো আমাদের আক্রমণ করবে! হয়তো তারাও ভয় পেত, কারণ তারা ছিল আমাদের তুলনায় অনেক বেশি গরিব ও অসহায়।

টালিগঞ্জে যে রাস্তাটিতে আমরা থাকতাম, টিপু সুলতানের এক বংশধরের নামে তার নাম ছিল প্রিন্স বক্তিয়ার শাহ রোড। কাছেই প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ রোড ও প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড। আমাদের এই সুলতানি আমল অবশ্য বেশি দিন চলেনি। কিছু দিন বাদে আমাদের রাস্তাটির নাম বদলে হয়ে গেল চারুবাবুর স্ত্রীর নামে: পঙ্কজিনী চ্যাটার্জি রোড। পার্ক সার্কাসে ঠিক ‘পাড়ার ছেলে’ হয়ে ওঠা হয়নি। এখানে হল। পাড়ার মুরুব্বিরা মিলে একটি ক্লাব করলেন, বৈশাখী সংঘ। সেই ক্লাবের তদারকিতে পাড়ারই একটি খোলা মাঠে— ‘খেতের মাঠ’ নামটির মধ্যেই সেই জমির ইতিহাসের গন্ধ লেগে ছিল— ফুটবল খেলা, ভোরবেলার পি.টি. ইত্যাদি শুরু হল। সেই সুবাদেই পরিচিত হলাম পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে। তাঁরা এখন সবাই নাতি-নাতনি পরিবৃত, দাদু হিসেবে তাঁদের পোশাকি নামে পরিচিত। আমি কিন্তু তাঁদের জানতাম সুবু, বাবু, ভানু, ট্যান্ডন হিসেবে!

পাড়ায় ‘বৈশাখী সংঘ’ মাঝে মাঝে ফ্যান্সি ড্রেসের আয়োজন করতেন। এটি ছিল একটি প্রতিযোগিতা। মনে আছে দু’বারই আমি সুবুর কাছে হেরে গিয়ে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম (সুবুর এক মেয়ে এখন খুব নামী টেবিল টেনিস খেলোয়াড়—পৌলমী, দেশের হয়ে খেলতে যায়)। প্রথম বার হেরে দ্বিতীয় বার ‘কী সাজি, কী সাজি’ ভাবতে ভাবতে মাথায় এল— এখন মনে হলে লজ্জাই করে— চাকাওয়ালা কাঠের তক্তায় বসে গড়িয়ে-যাওয়া কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ভিখিরি সাজব! এ গল্পটি যখন পরে পশ্চিমি বন্ধুদের কাছে করেছি, তাঁদের চোখ নিয়মিত কপালে উঠেছে! তাঁদের কাছে দৃশ্যটি অকল্পনীয়। কিন্তু আমার ছোটবেলার কলকাতায় এই দৃশ্য প্রাত্যহিক ছিল, ইউরোপের মধ্যযুগের কোনও শহরের মতো। এখন ভাবলে মনে হয়, মানুষের দুঃখও অন্য মানুষের প্রতি দিন দেখতে দেখতে কত সহজে গা-সওয়া হয়ে যায়। পুরস্কারটি বস্তুত প্রমাণ করেছিল যে সংবেদনশীলতার এই দৈন্য শুধু আমার একারই ছিল না।

ছেলেবেলার আর একটি ছবি

নতুন পাড়ায় এসে ইস্কুল বদলাতে হল। বাবা এক দিন নিয়ে গেলেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। আমার শুধু এইটুকু মনে আছে যে আমার মধ্যবিত্ত পিতৃদেব আমার হাত ধরে পাদরিদের পোশাক পরা কয়েক জন সাহেবকে কী বলার চেষ্টা করছেন ও তাঁরা সবাই ব্যস্ততার সঙ্গে হাত জোড় করে বাবাকে ‘নমো, নমো’ বলে সরে যাচ্ছেন। ইস্কুলটি থেকে বেরোতে বেরোতে ছোট আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা, ওরা তোমাকে ‘নমো নমো’ বলছিল কেন? বাবা বললেন, ‘‘নমো নমো নয়, নো মোর, নো মোর।’’ আমার এখনও অসহায় বাবার মুখখানা মনে পড়লে কষ্ট হয়।

অবশেষে ভর্তি হলাম ঢাকুরিয়ার এন্ড্রুজ স্কুলে। বইপত্র ইংরেজিতে, নিচু ক্লাসে কয়েক জন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ভারতীয় খ্রিস্টান শিক্ষিকাও ছিলেন। এখানেই এক দিন বাংলা ক্লাসে ‘দাতব্য চিকিৎসালয়’-এর মানে বোঝাতে গিয়ে ‘দাঁতের চিকিৎসালয়’ বলাতে শিক্ষিকা মহাশয়া স্নেহভরেই বেশ হেসেছিলেন। এন্ড্রুজ স্কুলে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়ত। বড় ক্লাসে উঠে দেখেছিলাম যে মেয়েদের সঙ্গে বেশি কথা বললে ইস্কুলের আয়ারা চোখ রাখে, ধমক দেয়, নালিশ করে ইত্যাদি। কিন্তু নিচু ক্লাসেই ছোটদের একটি নাটিকায় অভিনয় করতে গিয়ে গোলগাল, ফরসাপানা, পুতুল-পুতুল দেখতে একটি পঞ্জাবি বালিকাকে আমার বেশ ভাল লেগে যায়। ছোট তখন আমি, কিন্তু ‌ভাললাগাটা যে দিব্যি লাগছে, তা বেশ বুঝতে পারছি! অনুভূতিটির নাম জানি না, কিন্তু এই বোধ ছিল যে এর প্রকাশ অনুচিত হবে। আজ তিনি এই লেখা কোনও দিন পড়বেন না জেনে নতজানু হয়ে তাঁকে বলি: বলজিৎ চিমনি, তুমিই আমার প্রথম ভাললাগা রহস্যময়ী রাজকন্যা! এই রহস্যের সেই প্রথম অভিজ্ঞতা আজও আমার গোপন সঞ্চয়।

আমার বয়স যখন আট-নয় হবে, বাবা এক দিন আপিস থেকে এসে বললেন, ‘‘চল, তোদের নিয়ে সিএলটি-র অনুষ্ঠান দেখতে যাব।’’ ‘তোদের’ বলতে মা, আমার বোন রিমি ও আমি। ‘সিএলটি’ কী জানি না, কিন্তু জাদুঘরের আঙিনায় তাঁদের প্রযোজিত ‘মুগলী’ দেখে মন ভরে গেল। তার পর থেকে বাবা ‘সিএলটি’ টিকিট আনলেই আমি মুগ্ধনেত্রে টিকিটে আঁকা সিএলটি বা শিশুরংমহলের লোগোটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম— ঢাল-তরোয়াল হাতে উষ্ণীষধারী একটি শিশু। এই বুঝি নাটক শুরু হল বলে! আমার জীবনে শিশুরংমহলের অবদান অফুরন্ত। প্রতিষ্ঠাতা সমর চট্টোপাধ্যায়কে, আমাদের ‘সমরদা’কে খুব কাছ থেকে দেখেছি। অমন ব্যক্তিত্বশালী গুণী ও দক্ষ সংগঠক মানুষ আমি আর জীবনে দু’টি দেখিনি। সিএলটি-তেই পরিচয় হয় সংগীতশিল্পী শৈলেন মুখোপাধ্যায়, পিন্টু ভট্টাচার্য, অর্ঘ্য সেন প্রমুখের সঙ্গে। এঁদের মধ্যে একমাত্র অর্ঘ্যদাই বেঁচে আছেন।

এক দিন সন্ধেবেলা সিএলটি-তে শৈলেনদা আমাকে ডেকে এক ভদ্রলোকের সামনে বসিয়ে বললেন, ‘‘একটা পল্লিগীতি শোনা তো!’’ আমি গান গাইতাম, কেউ শুনতে চাইলেই গাইতাম। গাইলাম। ভদ্রলোক গান শুনে আমার বাড়ির ঠিকানা নিলেন। ভদ্রলোকের নাম ভি বালসারা। ওঁরা নাকি কী একটি বাংলা ছবিতে কোনও বালক অভিনেতার জন্য বালক-গায়ক খুঁজছেন। অবশেষে সত্যিই একটি সিনেমায় গান গাইলাম! মিল্টু ঘোষের কথায় ও ভি বালসারার সুরে আমার গাওয়া ‘আকাশ জুড়ে রঙের খেলা’ গানটি এখন ইউটিউবে শোনা যায়। ছবিটি চলেনি বিশেষ— সুশীল ঘোষ পরিচালিত ‘অঙ্গীকার’। কিন্তু সে দিন ইউটিউবে হঠাৎ গানটি শুনে পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। সিনেমায় গাওয়ার ওখানেই ইতি। বাবা বললেন, ‘‘আর গাইলে পড়াশুনো হবে না।’’ যেমন বলতেন সে কালের বাবারা।

নিষ্পাপ: বাবার দাড়ি কামানোর ব্রাশ হাতে

যৌবনের কুঁড়ি ফোটার আভাস দেখা দিয়েছে— তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমি ঘোর বিবেকানন্দপন্থী হয়ে পড়লাম। খুব সম্ভবত প্রাইজে পাওয়া স্বামীজির কিছু রচনা পড়ে। নিজের কাছেই প্রতিশ্রুত হলাম যে মিথ্যে কথা বলব না, বয়সের ধর্মে উঠে-আসা ‘কুচিন্তা’ মন থেকে তাড়াব, আর নিয়মিত ধ্যান করা শুরু করলাম। এমন সময়ে বাবা বললেন, ‘‘এ বার আরও ভাল একটি স্কুলে যা।’’ প্রধানত বাবার ইচ্ছেতেই ভর্তি হলাম ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশনে। কিন্তু সেখানে ঢুকেই বিবেকানন্দপন্থী আমার এক ভয়ানক বিপত্তি! আমাদের এক মাস্টার ছিলেন কালীবাবু। তাঁকে বারান্দায় দেখে ক্লাসের একটি দুষ্টু ছেলে ডেকে উঠেছে, ‘‘কালী, কালী, ব্যোমকালী।’’ ব্যস, আর যায় কোথা? ‘‘কে বললি?’’ কেউ বলতে চায় না কে বলেছে। কানমলা, মাথায় গাঁট্টা, সমস্ত ক্লাসকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেও যখন ‘ছাত্র ঐক্য’ ভাঙছে না, তখন হেডমাস্টার প্রফুল্লবাবু ও জাঁদরেল সহকারী প্রধানশিক্ষক বীরেনবাবু ছাত্রদের এক জন এক জন করে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। আমি তো সত্য কথা বলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই দোষী ছাত্রটির নাম বলে দিলাম। ক্লাসে ফিরে আসতেই— আমি তখন নতুন ছাত্র— সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘কী হল? কী হল?’’ আমি তাদেরকেও সত্যি কথাই বললাম যে আমি শিক্ষকদের কাছে সত্যিটাই বলেছি। সারা বছর দু’-একটি দয়ালু ছাত্রকে বাদ দিলে অন্য কেউ আমার সঙ্গে আর কথা বলেনি। ক্লাসে আমার ধোপা-নাপিত বন্ধ! গোটা একটি বছর লেগেছিল নতুন ইস্কুলের বন্ধুদের মন ফিরে পেতে। ভাবি, এখনকার সময় হলে কি আমাকে না-পিটিয়ে ছাড়ত?

সেই একটি বছরেই অবশ্য আমার জীবনের মোড় বদলাচ্ছিল। ঘরে-বাইরে নানান তর্কাতর্কির সূত্রে বিবেকানন্দের জায়গা ধীরে ধীরে কেড়ে নিচ্ছিলেন কার্ল মার্ক্স। এমনকী সত্যবাদিতার প্রতিজ্ঞাটাও ভেসে গেল এক দিন। মনে হতে লাগল, বিপ্লবের স্বার্থে মিথ্যাচারণেই বা ক্ষতি কী? কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পৌঁছতে আসলে যেটি ভেঙে গেল তা আরও বড় জিনিস। সিএলটি, গান, ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা, বাংলা সাহিত্য, সাহিত্যের ইতিহাস, বৈষ্ণব পদাবলি, পদার্থবিদ্যা ও বিজ্ঞানের হাতছানি— এ সব নিয়ে আমি একটি স্বরচিত কল্পনার জগতের বুদ্বুদের মধ্যে বাস করতাম। বড়লোকি নয়, কিন্তু একটি নিশ্চিন্ত মধ্যবিত্ত শিশুজীবনের রচনা আমার শৈশবের কলকাতায় সম্ভব ছিল। কিন্তু এ বার আমার বড় হতে হতে কলকাতাও উত্তাল হয়ে উঠেছে। ১৯৬৪-র খাদ্য আন্দোলন, ১৯৬২-র চিনের যুদ্ধ, ১৯৬৪-তে সিপিএম-এর উত্থান, এই সব ঝড়ের দাপটে আমার শৈশবের জগৎ খানখান হয়ে গেল। ১৯৬৫ সালে যখন স্কুল ছাড়লাম, তখন জানি, প্রেসিডেন্সিতে পদার্থবিদ্যা পড়ব বটে, কিন্তু আসলে বামপন্থাই আমার পথ। বামপন্থী চিন্তায় পৌঁছেই আমার শৈশবের অবসান। ষাটের দশকে সমরেশ বসুর ‘বিবর’, বুদ্ধদেব বসুর ‘রাতভর বৃষ্টি’ নিয়ে ঘোর বিতর্কে, সুনীল-শক্তি-শীর্ষেন্দু-দেবারতি মিত্রের সাহিত্যিক আহ্বানে, ঋত্বিক-মৃণাল-সত্যজিতের সিনেমা নিয়ে বিবাদ-বিসম্বাদে, বাদল সরকার, অজিতেশ, উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্রের নির্দেশিত নাটকের আলোচনার উত্তেজনায়, মার্ক্স এবং মার্ক্সবাদী আন্দোলনের জোয়ারে আমার সিএলটি-লালিত শৈশব খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। অন্তত তখন তাই মনে হত। এখন বুড়ো বয়সের দোরগোড়ায় এসে সবটার জন্যই কৃতজ্ঞ বোধ করি—এই সব নিয়েই তো আমার বাঙালি সত্তা!

Dipesh Chakrabarty You Tube Historian দীপেশ চক্রবর্তী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy