Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

কর্তৃত্ব বিস্তারে ‘দাদাগিরি’ দেখাতে উদ্যত চিন

পাকিস্তান-চিন সম্পর্কের মোকাবিলায় জাপান, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও আমেরিকার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়া প্রয়োজন। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালপাকিস্তান-চিন সম্পর্কের মোকাবিলায় জাপান, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও আমেরিকার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়া প্রয়োজন। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

ডোকলামে চিনা সেনা। ফাইল চিত্র।

ডোকলামে চিনা সেনা। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন ডোকলামের পর কার্যত তলানিতে এসে ঠেকেছে। খ্যাতিমান রাজনীতি বিজ্ঞানী নর্মান ডি পামার ভারত-চিন সম্পর্কের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনটি অধ্যায়ের কথা বলেন। প্রথমে ’৪৯ সাল থেকে ’৫৪ সাল— এই স্বল্প সময়ে ভারত নানা ভাবে বন্ধুত্বের বার্তা দেয়। চিনেরও এই সময় হিন্দি-চিনি ভাই ভাই সম্পর্কে বেশ কিছু অভিমত ছিল। এখন পিছন দিকে তাকালে দেখা যাবে সেই সময়েও চিনের বক্তব্যে যত না রোমান্স ছিল, তার চেয়ে ভারতের বিরুদ্ধে সীমান্ত নিয়ে অনুযোগ ছিল বেশি।

এর পর ’৫৪ থেকে ’৫৯ সাল বাহ্যত হিন্দি-চিনি ভাই ভাই অধ্যায় দু’পক্ষেই বাহ্য রোমান্স চরমে, অথচ তলে তলে দু’দেশের মধ্যে সংঘর্ষ ও সংঘাত বেড়েছিল এবং ’৫৯ থেকে ’৬২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এ সময়ে এল প্রকাশ্য যুদ্ধ পরিস্থিতি। চিন শত্রুতাপূর্ণ আগ্রাসী লাইন নিল।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ম্যাকমোহন লাইনকে অস্বীকার করার মাধ্যমে চিন পরিস্থিতিকে এ সময়ে আরও জটিল করে দেয়। ’৬২ সালে যুদ্ধের আগে নেহরু কিন্তু ম্যাকমোহন লাইন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পক্ষে ছিলেন। ম্যাকমোহন লাইনের কিছু সংশোধন‌ও মেনে নিতে চাইছিলেন নেহরু। ’৬২ সালের পর পুরো পরিস্থিতিটাই বদলে গেল। চিনের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল পাকিস্তান। ’৬৩ সালে চিনকে ১০০০ বর্গ কিলোমিটার দান করে পাকিস্তান। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর থেকে যেখানে কারাকোরাম হাইওয়ে তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।

দেং জিয়াও পিং চিনের আর্থিক সংস্কার ও উন্নয়নের নীল নকশা তৈরি করেন। কিন্তু দেং জিয়াওয়ের কূটনীতির মন্ত্র ছিল, মাথা ঠান্ডা রাখ, লো প্রোফাইলে থেকে নিজের আর্থিক বৃদ্ধিতে মন দাও দেশের ভিতর। দেশের বাইরে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টাই কোর না। ভারত কিন্তু এ সময়ে খুবই সক্রিয় উন্নয়নের প্রশ্নে। চিন তখন থেকে ভারতকে কড়া নজরে রাখে। ’৯৮ সালে ভারতের পরমাণু বোমা বানানো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের দ্রুত এগিয়ে যাওয়া কূটনীতি— চিন এর পাশাপাশি এটাও তত দিনে বুঝে গেছে, ভারত এক বিশাল বাজার। ভারতকে বিশেষ প্রয়োজন চিনের। বহুকেন্দ্রিক পৃথিবীতে ভারত এক গুরুত্বপূর্ণ শরিক। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থারও পতন হচ্ছিল নানা কারণে। ’৯০ সালের শেষ ভাগে অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারত আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠায় চিনও জেগে ওঠে।

সেই চিন কিন্তু এখন তার বিদেশনীতিতে এক নিঃশব্দ বিপ্লব আনছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সামনে চিন তার সাম্রাজ্য বিস্তারের স্পষ্ট ‘দাদাগিরি’ দেখাতে উদ্যোগী হয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ভারত যে ‘সিকিউরিটি জোন’ তৈরি করে তা আজ অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত। এই উপমহাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে। মায়ানমারে নিজের ‘নতুন পজিশন’ চিন তৈরি করে ফেলেছে। নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাতেও তাই। মূলত পরিকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে আর্থিক সাহায্য বাড়িয়ে ভারতের সঙ্গে এই দেশগুলির সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রসম্ভার ও মিসাইল ক্ষমতা বৃদ্ধিতে চিনের সক্রিয় সাহায্য ভারতের সাবেক ‘সুপিরিয়রিটি’র কর্তৃত্বে ভাঙন এনেছে। ইসলামাবাদকে ‘লো ইন্টেনসিটি কনফ্লিক্ট’-এ যাওয়ার জন্য সাহায্য করছে চিন। দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত ডিম তা হলে চিন পাকিস্তানের ঝোলায় ফেলছে?

এখন তা হলে ভারত কী করবে? প্রথমত, চিনের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়টিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা দরকার। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ চিনের সমুদ্রপথের বিতর্ক সম্পর্কে ভারতকে কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করতেই হবে। তৃতীয়ত, চিনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি অনেক। এই আর্থিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে আলোচনা চাই। ২০১৫ সালে এই বাণিজ্য ঘাটতি ৭০ বিলিয়ন (৭ হাজার কোটি) ডলার। বাণিজ্যক্ষেত্রে চিন নিয়ে ভারতের রণকৌশল বদলালে ভারতের চেয়ে চিনের লোকসান বেশি। চতুর্থত, পাকিস্তান-চিন সম্পর্কের মোকাবিলায় জাপান, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও আমেরিকার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়া। সমস্যা হচ্ছে, ট্রাম্প এবং ওয়াশিংটন এক বিচিত্র পরিস্থিতির মধ্যে। চিন নিয়ে মার্কিন বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে, তা ছাড়া, ভারতের স্বার্থ দেখা তো আমেরিকার কাজও নয়। তারা চিন সম্পর্কে কী অবস্থান নেবে সেটা ঠিক করবে তাদের সার্বভৌম স্বার্থ অনুসারে।

একটা সময় ছিল যখন চিনের বিদেশনীতি ছিল নিরপেক্ষ, মতাদর্শ দ্বারা সংক্রামিত নয়, এমনকী, আক্রমণাত্মকও নয়। আর্থিক অগ্রগতি লাভের পর এখন চিনের কূটনীতি বদলাচ্ছে। অবশ্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং ‘ইসলামিক র‌্যাডিক্যালাইজেশন’-এর যে প্রভাব এশিয়াতে পড়ছে তাতেও চিনের উদ্বেগ আছে। এমনকী, সিন জিয়াং-এও যে ভাবে চিন নিজেই সন্ত্রাসে আক্রান্ত তাতে তারা নিজের বিপদ নিয়েও ভাবিত।

এই অবস্থায় চিন যদি রাওয়ালপিন্ডির কোনও সেনাপ্রধানের মতো আচরণ দেখায়, তবে ভারতকেও তার জন্য প্রস্তুত তো হতেই হবে, তার পাশাপাশি কূটনৈতিক দৌত্যকেও অবহেলা করা যাবে না। যুদ্ধ ও শান্তির দ্বৈতবাদ সম্পর্কে সচেতন হওয়াই আজকের সভ্যতার দাবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE