কালীপুজোর কোলাহল শুরু হয়ে গিয়েছে। কলেজ স্কোয়ারের চত্বরে মণ্ডপ আলোয় ঝলমলে, ভিড় জমছে পথের দু’ধারে।
কলেজ স্কোয়ারের কাছেই বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের এক কোণে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক শতবর্ষ প্রাচীন ঠিকানা, যার নাম— ‘প্যারামাউন্ট’।
১৯১৮ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামী নীহাররঞ্জন মজুমদার যখন এই শরবতের দোকান খুলেছিলেন, নাম ছিল ‘প্যারাডাইস’।
বাইরে ছিল ঠান্ডা শরবতের দোকান, ভিতরে চলত বিপ্লবীদের গোপন বৈঠক।
আজও সেই দোকানের পিছনে রয়েছে সেই ছোট্ট গোপন ঘর, যা স্বাধীনতার ইতিহাসে কলকাতার আগুনে দিনগুলোর সাক্ষী।
বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা হিসেবেই নাকি শুরু হয়েছিল এটি। ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিতেই সামনেটায় মিষ্টি শরবতের দোকান।
দোকানটি বর্তমানে চালান নীহাররঞ্জনের নাতি পার্থপ্রতিম মজুমদার।
সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমার— কত শত কিংবদন্তী এই দোকানের শরবতে চুমুক দিয়েছেন!
শোনা যায়, সুভাষচন্দ্র বসুর প্রিয় ছিল 'ক্রিম ম্যাঙ্গো'। আড্ডার মেজাজে, মুক্ত বুদ্ধির চর্চায় এই দোকানটি যেন বহু বিপ্লবীর, বুদ্ধিজীবীর আশ্রয়স্থল ছিল।
আজও এখানে ৩০টিরও বেশি স্বাদের শরবত মেলে। কিন্তু যা এই শতবর্ষ পেরিয়েও নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে, তা হল— ডাব শরবত, গ্রিন ম্যাঙ্গো মালাই এবং ভ্যানিলা মালাই।
ডাবের শরবতটি নাকি তৈরি হয়েছিল আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের রেসিপিতে, যার গোপনীয়তা আজও আগলে রেখেছে মজুমদার পরিবার।
এই শরবতের মিষ্টতা বা ঘনত্বে নেই কোনও বাড়াবাড়ি, বরং হালকা এক প্রশান্তি তার স্বাদে। সেই আমলে যা চার আনায় পাওয়া যেত, আজ তা ৮০ টাকা। তবে দাম বাড়লেও স্বাদে বা ঐতিহ্যের গল্পে এতটুকুও মরচে পড়েনি।
মার্বেল টপ টেবিল, দেওয়ালে টাঙানো শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নিজামের নিলামে কেনা হরিণের শিং— সব কিছু মিলে এই সংকীর্ণ দোকানটি যেন এক টাইম মেশিন।
কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া ও প্রেসিডেন্সির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গা ঘেঁষে থাকা এই 'প্যারামাউন্ট' শুধু একটি শরবতের দোকান নয়, কলকাতার জীবন্ত ইতিহাস। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।