Durga Puja Celebration

তিনি এসেছিলেন, তিনি বিদায় নিয়েছেন

বেশ কয়েক বছর হল মা দুর্গার মণ্ডপ শুধু পূজাপার্বণের আখড়াই নয়, একেবারে নতুন ধারার শিল্প হয়ে উঠেছে।

Advertisement

তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:০০
Share:

আবার কবে?

Advertisement

বছর পরে

আসছে বছর

Advertisement

আবার হবে

বিসর্জনের বাজনার তালে দুর্গাভাসানের চিরচেনা স্লোগান! গ্রাম, শহর, নগর, মফসসল— সর্বত্রই দুর্গাপুজোর মতো এই স্লোগান সর্বজনীন। মা এলেন, মা যাচ্ছেন।

কী যেন আছে দুর্গাভাসানের ঢাকের বোলে! কেমন কান্না পায়। এর কারণ নির্ণয় করা কঠিন। হতে পারে সারা বছর ধরে দুর্গাৎসবের যে অপেক্ষা, তার সঙ্গে কত কিছুই না লগ্ন থাকে! নতুন নতুন জামা, পোশাক, জুতোর উপহার, পূজাবিষয়ক বাণিজ্য, তার লাভের হিসাব, মণ্ডপসজ্জার প্রলম্বিত আয়োজন! বেশ কয়েক বছর হল মা দুর্গার মণ্ডপ শুধু পূজাপার্বণের আখড়াই নয়, একেবারে নতুন ধারার শিল্প হয়ে উঠেছে। এক অভিনব আর্ট ফর্ম। চিত্রকর, ভাস্করগণ, তাঁদের উদ্ভাবনী ক্ষমতার অপূর্ব ও চমৎকার প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন মণ্ডপসজ্জায়। এক পুজো মিলিয়ে যেতে না যেতেই পরের পুজোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়া। এই যে আজ দশমীর যাত্রা— মায়ের চক্ষু ছলোছলো! এক হপ্তা পরেই মহালক্ষ্মী পুজো। তবু তাঁরও চোখ ভিজে ভিজে। আলাদা করে প্রত্যেকেই পুজো পান, তবু আজকের দিনে সবারই চোখ বিষাদসিক্ত। অমন যে, সুরসেনা কার্তিক, তাঁরও মুখখানা কান্না-কান্না। এত বড় মহোৎসবের শরিক যাঁরা, দেব, মানব, শিল্পী, রসিক— এই উৎসবান্তের বিষাদ বেদনা অল্পবিস্তর সকলকেই স্পর্শ তো করবেই!

চলছিল কারণের সন্ধান, বিসর্জনের বাজনা শুনে কান্না পায় কেন?

আরও পড়ুন: ট্রেনে বেড়াতে যাচ্ছেন? জেনে নিন কিছু জরুরি তথ্য​

দুর্গাপুজো মানেই যে উপহারের আশা, মণ্ডপের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও সাজিয়ে তোলার উদ্যোগ, বাঁধা নিয়মের জীবন থেকে বেরিয়ে কয়েক দিনের বাঁধনহারা আনন্দ যাপন, তা শেষ হলে মন খারাপ হবেই তো! ঢাকের যে নির্দিষ্ট বোল বিসর্জনে বাজে তাকে প্রতি বছর শুনতে শুনতে চেনা হয়ে যায় বলেই কি ওই বাদনে কান্না আসে? নাকি একেবারে বিচ্ছিন্ন ভাবে, অর্থাৎ যে ওই ঢাকবাদ্যির সঙ্গে বিসর্জনের অনুসঙ্গ অবহিত নয়, সে-ও এ হেন বাজনা শুনলে বিষাদ বোধ করবে? বাজনার কারুণ্য তাকে স্পর্শ করবে, উথলে দেবে ব্যথার আবেগ। যেমনটা হয় কোনও কোনও রাগরাগিণীর বেলায়!

এই সম্ভাবনা বাদ দেওয়া চলে না। বিসর্জনের বিষাদরিক্ততা শব্দের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া ঢাকির মুন্সিয়ানা নিশ্চয়ই। যেমন অনেক আদিবাসী জনজাতি ঢাকের বোলে ফুটিয়ে তোলেন মানবদেহের অন্তিমযাত্রার শোকাবহ শব্দ। যেমন অতীতে ছিল রণবাদ্য, জয়ঢাক ইত্যাদি।

পাশ্চাত্য সঙ্গীতে বর্তমানে ভারতীয় গানের অনুষঙ্গে ড্রাম খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তালরক্ষা ছাড়াও ড্রাম বাদনের সুরের রকম গানের আবহ নিশ্চিত করে। আমাদের বিসর্জনের ঢাকেও সেই করুণ রিক্ততা।

আরও পড়ুন: পুজোর মরসুমে সুস্থ থেকে আনন্দ করুন এইসব উপায়ে​

পূজা এবং পূজা শেষের এই বাদনে উৎসবান্তের সরব ঘোষণার সঙ্গে আরও একটি বিষয়, তার নাম সংকল্প। সংকল্প ও তার খতিয়ান।

দুর্গোৎসবের জাঁকজমক, আত্মীয়-বন্ধু মিলন, আনন্দ ও শরতের মনমাতানো প্রকৃতি আমাদের মনের ক্লান্তি অনেকখানি দূর করে দেয়। এই উৎসবে নতুনের আরাধনা আছে। নতুন পোশাক পরিচ্ছদ, নতুন গান, নতুন গল্প-উপন্যাস ভরা শরৎ সাহিত্য। অর্থাৎ, দুর্গতিনাশিনীর আগমনী আমাদের হৃদয়ের অঙ্গে অঙ্গে নতুনের সাজ পরায়। সারা বছর যা কিছু করা হল না, পূজাশেষে সেই সব করে ফেলার নবতর উদ্যম জাগে। যিনি শক্তিরূপেণ সংস্থিতা, তিনি যেন বিদায়ের আগে তাঁর শক্তির বিচ্ছুরণে নতুনতর প্রতিজ্ঞায় পৌঁছে দেন আমাদের।

আজ মঙ্গল বিজয়া। আজ শত্রু-মিত্র ভুলে মিলনের দিন, আলিঙ্গনের দিন। এর পর জীবন আবার বইবে নিজ ছন্দে! সেই ছন্দে মাধুর্য যেমন, অসহ তিক্ততাও কম নেয়। রোজকার জয়-পরাজয়, সম্মান-অসম্মান, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে দীর্ণ হয়ে ক্লান্তিতে, অবসাদে যখন নুয়ে আসবে পিঠ, ঝিমিয়ে পড়বে মন, তখন আবার একটি-দু’টি করে শিউলি ফুটে উঠবে। ফিসফিসিয়ে বলবে মা আসছেন। কাশের গুচ্ছ মাথা দোলাবে হাওয়ায়। বলবে, ওই আসছেন। আবার নব কোলাহলে সাজের আয়োজন হবে। উৎসব উজ্জীবিত করে। আবার উৎসবের আলোয় পথের চোরাগোপ্তা খানাখন্দ যেমন প্রকাশ পেয়ে যায়, তেমনই সম্বৎসরের সংকল্প, প্রতিজ্ঞা, সাফল্য ও ব্যর্থতার খানিক হিসেবনিকেশও চলতে থাকে। পুরনোর খতিয়ানের উপরেই যে নতুনের প্রতিষ্ঠা। মা দুর্গার মতোই এ জগতের সকল চিরপুরাতনই চিরনতুন হয়ে ফেরে!

আরও পড়ুন: পকেটমারি তো ‘হস্তশিল্প’-র বাইরে নয় রে বাবা!​

যাই হোক আর তাই হোক, বঙ্গজীবনে দূর্গাপূজার তুল্য আর কিছুই নেই। অন্য সমস্ত উৎসবই স্বমহিমায় আসীন। কিন্তু দুর্গাপূজা বঙ্গদেশের হৃদয়ে বিরাজ করে। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ভাষার অন্তর ঘুচিয়ে দিয়ে যে আলো জ্বলে উঠেছিল, তার মঙ্গল ও কল্যাণী রশ্মিপাতে নতুনতর প্রাণে ভরে উঠুক সংসার!

তবু আজ বিষাদ। আনন্দমঙ্গলের মধ্যেও অশ্রুপাত থাকেই। আজ যত আলোই জ্বলুক, যত গানই বাজুক, বিসর্জনের বাদনে বিদায়ের ধ্বনি মন ভার করে তুলবেই! কাঁসর-ঘণ্টার শব্দও বুঝি সিক্ত। দুর্গা মাঈ কি জয়...ধ্বনির তলায় পড়ে আছে কাশের গুচ্ছ, ঝরা শিউলির ফুল আর বাসি পদ্ম! তিনি এসেছিলেন। তিনি বিদায় নিয়েছেন!

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন