ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা/যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা/আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা—
ছড়ার সুরে সুরে কড়ে আঙুলের ডগায় চন্দন, কপালে এঁকে দেওয়া ফোঁটা বলে যায় এক চিরন্তন ভালবাসার গল্প।
সকালের প্রথম আলোয় ধান, দূর্বা, চুয়া-চন্দনের মায়া বাঁধনে বাঁধা পড়ে শুধু ভাল থাকার কামনা। সুখের আনন্দে সম্পদ, দুখের বিপদে বর্ম হয়ে থাকার অঙ্গীকার ভাইফোঁটা। একান্ত ভাবে ভাই-বোনের উৎসব।
কী ভাবে শুরু হল এই প্রথা? কেনই বা ভাইফোঁটার রীতি রেওয়াজে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেল যম-যমুনার ছড়া?
কার্তিক মাসে শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয় ভাইফোঁটা।
লৌকিক আচারের অঙ্গ হয়ে ওঠা যম-যমুনার প্রচলিত ছড়াটি প্রায় সব বাঙালি পরিবারেই বোনেরা ভাইফোঁটা দেওয়ার সময়ে মন্ত্রের মতো বলে থাকে।
আসলে ভাইফোঁটার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে একাধিক পৌরাণিক কাহিনি। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত যম-যমুনার গল্পটি।
কথিত, সূর্য ও তাঁর স্ত্রী সংজ্ঞার ছিল দুই সন্তান। যমুনা-যম। অন্য মতে যমী।
পুত্র ও কন্যা সন্তানের জন্মদানের পর সূর্যের উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে প্রতিলিপি ছায়ার কাছে তাঁকে রেখে চলে যান সংজ্ঞা। সংজ্ঞার প্রতিরূপ হওয়ায় কেউ ছায়াকে চিনতে পারেনি। কিন্তু ছায়ার কাছে ওই দুই সন্তান কখনও মায়ের মমতা, ভালবাসা পায়নি। অত্যাচারই ছিল নিত্য সঙ্গী।
ছায়া ছল করে স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেয় যমুনাকে। পরে যমুনার বিয়ে হয়। ভাই যমের সঙ্গে বহু যুগ আর তার দেখা হয় না।
এদিকে দীর্ঘকাল ধরে দিদিকে দেখতে না পেয়ে এক সময়ে অস্থির হয়ে ওঠেন যম। ঠিক করেন, যে ভাবেই হোক সহোদরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
এক দিন হঠাৎ দিদির বাড়ি চলে যান যমরাজ। প্রিয় ভাইকে আনন্দের সঙ্গে অভ্যর্থনা করেন যমুনা। কপালে তিলক পরিয়ে নানা ভোজে ভাইকে আপ্যায়ন করেন দিদি।
যমুনার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যম একটি বর দিতে চান তাঁকে। যমুনা তখন বলেন এই দিনটিতে ভাইদের মঙ্গল কামনা চেয়ে প্রত্যেক বোন যেন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া হিসেবে পালন করে।
সেই থেকেই কার্তিক মাসে শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয় দিনটিতে ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় পালিত হয় ভাইফোঁটা।
তবে যম-যমুনার এই কাহিনির একাধিক ভিন্নমতও পাওয়া যায়। বেদ, পুরাণের একাধিক ক্ষেত্রে যম-যমী তথা যমুনাকে প্রথম পুরুষ ও নারী হিসাবে ব্যাখ্যা করে হয়েছে। এমনকি বলা হয়, তাঁরা ভাই-বোনও নন।
ভাইফোঁটাকে আবার দেখা যেতে পারে সূর্য-সংক্রান্ত উৎসবের প্রেক্ষিতেও। এখানে চন্দনের ফোঁটা হয়ে উঠেছে সূর্যের রূপক।
পুরাণ বলছে, যম দক্ষিণ দিকের লোকপাল বা অধিপতি। ভ্রাতৃ দ্বিতীয়ার মাধ্যমে সূর্যের দক্ষিণায়ন এবং সেই সময়ের উৎসবের সঙ্গে জুড়ে যান যম।
এই সময়ে দিন ছোট হয়, বাড়তে থাকে রাত্রির কাল। ঋগ্বেদে যমকে দিন আর যমীকে রাত্রি বলা হয়।
ভাইফোঁটার দিন ভাই-দাদাদের কপালে চন্দন কিংবা দইয়ের ফোঁটা পরিয়ে মনে মনে মঙ্গল কামনা করেন বোনেরা।
এই তিথি অনেক জায়গায় যমদ্বিতীয়া নামে পরিচিত। উত্তর ভারতে আবার ভাই-বোন সম্মিলিত হয়ে যমুনায় স্নানের রেওয়াজও রয়েছে।
তবে ছড়ার কাহিনিতে আম বাঙালির ঘরে ঘরে যম-যমুনার ছড়া যেন ভাই বোনের সম্পর্কের বাঁধন মজবুত করে তোলার ম্যাজিক মন্ত্র। সারা বছর কাটে যেমন তেমন, এই একটি দিনেই অন্য সব সম্পর্ককে ছাপিয়ে মুখর হয়ে ওঠা ভাই-বোন, দাদা-দিদিদের টক-ঝাল-মিষ্টি গল্প আর দেদার আনন্দ! (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।