Navaratri Golu Festival

নবরাত্রিতে পূজিত হয় পুতুল! কোথায় আছে এই অদ্ভুত রীতি?

দুর্গাপুজোর সময় পুজো করা হয় পুতুলকে! ভারতের কোন প্রান্তে রয়েছে এই নিয়ম?

Advertisement

তমোঘ্ন নস্কর

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:৩৭
Share:

প্রতীকী চিত্র

তিনটি থাক বা স্তর। তাতে সাজানো সার সার পুতুল। একেবারে তলার থাকে ন’টি পুতুল। তার উপরে পাঁচটি। তার উপরে তিনটি। পুতুলের সে কী অপূর্ব সমাহার!

Advertisement

কোনওটায় চিত্রিত হয়েছে সুখী দাম্পত্য। কোনওটায় কোণে গুটিসুটি মেরে বসে বাড়ির বরিষ্ঠতম দুই দম্পতি। আবার কোনওটায় পৌরাণিক গাথা ফুটে উঠেছে অপূর্ব ভাবে।

সেখানে দেবী দুর্গা বধ করছেন মহিষাসুরকে। কৃষ্ণ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরছেন মা যশোদাকে। রাম-লক্ষণ সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরছেন। এক্কেবারে ঝুলনের মতো।

Advertisement

হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, এ এক ধরনের পুতুল উৎসব। যার নাম বোম্মাই গোলু। বোম্মাই কথার অর্থ হল পুতুল আর গোলু কথার অর্থ হল দরবার। অর্থাৎ, পুতুলের দরবার। এই উৎসব হয় নবরাত্রির সময়ে। দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধ উদযাপন করার এই অনন্য প্রথাটির আর এক নাম তাই নবরাত্রি গোলু।

আনুমানিক ১৪ শতাব্দীতে বিজয়নগর রাজবংশে প্রথম নবরাত্রি গোলু পালিত হয়। সেই শুরু, কারণ গোলু এক বার শুরু হলে আর বন্ধ করা যায় না। তাই বিজয়নগর সাম্রাজ্য যখন ভেঙে যায়, এই রীতিও ছড়িয়ে পড়ে ছোট্ট ছোট্ট রাজ অংশে। তাঞ্জাভুর এবং পুদুক্কোট্টাইয়ের রাজপরিবারের রীতি ও প্রথা প্রচলিত ছিল। বর্তমানে তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলঙ্গানা এবং কর্ণাটক রাজ্যে সাড়ম্বরে গোলু পালিত হয়।

পূজা পদ্ধতিঃ–

প্রথমে কাঠের তিনটি ধাপ তৈরি করা হয়। সেই ধাপগুলোকে সুন্দর করে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে, তাতে লাল কাপড় বিছিয়ে গোলুর আয়োজন শুরু করা হয়।

মনে রাখতে হবে, নবরাত্রি কেবলমাত্র মহিষাসুর বধ বা অশুভকে হারিয়ে শুভর জয় নয়। তার চেয়েও বেশি নারীত্বের জয়গান, মাতৃত্বের জয়গান। ভারতবর্ষের মাতৃতান্ত্রিকতাকে স্মরণ করার কাল।

পুরত্তসী মাসের অমাবস্যা তিথিতে, অর্থাৎ মহালয়ার দিনে মাঝের স্তরে একটি কলস বা ঘট (রূপা বা পিতলের) স্থাপন করা হয়। ঘটটির মুখ আমের সরা বা আম্র পল্লব দিয়ে ঢেকে উপরে একটি নারকেল স্থাপন করা হয়। ফুলের মালা দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় ঘটটিকে। তেলের প্রদীপ, কর্পূর, ধূপ, ধুনো জ্বালিয়ে দেবী শক্তিকে আমন্ত্রণ জানান ব্রতী ও উপাসকরা। এই পদ্ধতি বাঙালির পূজা পদ্ধতির মতোই। ঘট আদতে মাতৃ আরাধনার এক প্রাথমিক স্তর। এই জলপূর্ণ ঘট মাতৃগর্ভকে সূচিত করে।

এ বার একেবারে উপরের স্তরে স্থাপন করা হয় কাঠের তৈরি এক জোড়া দম্পতি পুতুল বা মারাপাচি পুতুল। এই দম্পতির এক জন বিষ্ণু ভেঙ্কটেশ্বর এবং অপর জন তাঁর স্ত্রী মহালক্ষ্মী।ভেঙ্কটেশ্বরের পরিধেয় ধুতি এবং দেবীর পরণে শাড়ি । এই পুতুল স্বামী-স্ত্রীর মিলন তথা সমৃদ্ধি এবং উর্বরতার প্রতীক।

– এর পরে স্তরে স্তরে সাজানো হয় বাকি পুতুলগুলিকে। একেবারে উপরের স্তরে মহাদেব, বিষ্ণু, দুর্গা, সরস্বতী প্রমুখ দেবদেবীদের স্থাপন করা হয়।

– মধ্যবর্তী স্তরে যেখানে ঘটটি রয়েছে, সেখানে বিবিধ বরেণ্য সাধকদের স্থান দেওয়া হয়।

– একেবারে নীচের স্তরে থাকে পরিবারের আদি দম্পতি যুগল অর্থাৎ পিতামহ এবং পিতামহী। তার সঙ্গে বিবাহের পুতুল, নানা রকম সাংসারিক সামাজিক চিত্রণের পুতুল, গ্রামে চাষাবাদ, মাছধরা ইত্যাদির পুতুল।

উৎসবে দেবী শক্তির তিনটি রূপের পূজা করা হয়। তাই নবরাত্রির নয় দিনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়।

প্রথম তিন রাত দেবী দুর্গার উদ্দেশ্যে সমর্পিত ও উৎসর্গীকৃত।

এই সময়ে ভক্তরা চিন্তা ও কর্মের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অশুভকে দূর করার জন্য, অশুভের সঙ্গে সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য মাতৃশক্তির কাছে প্রার্থনা করেন।

পরবর্তী তিন রাত দেবী লক্ষ্মীর চরণে সমর্পিত।

দেবী লক্ষ্মীর কাছে মানুষ ধন, ভাগ্য, শ্রী ও সমৃদ্ধি প্রার্থনা করে।

শেষ তিন রাত জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং শিল্পের দেবী সরস্বতীর পুজোর পালা। তিনি বিদ্যা দ্বারা জ্ঞানচক্ষু খুলে দেন। বোধ নামক বিশ্লেষণের কষ্টিপাথর দেন ভক্তকে।

নবরাত্রির নয় দিন পুতুলগুলিকে পুজো করা হয়। তার পরে দেবীর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ভক্তিগীতি গাওয়া হয়। গোলু উৎসব দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় প্রতিবেশীদের। সবাই মিলে এসে গোলুকে দর্শন করে যান, প্রণাম করে যান। অতিথি হয়ে আসা প্রতিটি নারীকে থালায় সাজিয়ে দেওয়া হয় সিঁদুর অর্থাৎ কুমকুম, হলুদ, পান, ফুল, ফল, মিষ্টি। গোলু উৎসবের এই রীতিতে মনে করা হয়, গৃহকর্ত্রী যা দেবেন, তাই ফিরে আসবে। মিষ্টি দিলে মিষ্টতা ফিরে আসবে। সিঁদুর দিলে সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হওয়ার আশীর্বাদ মিলবে। আর পান-হলুদ তো মঙ্গলচিহ্ন।

শুধু তাই নয়, কুমারী পুজোর মতোও একটি পুজো করা হয়। এই নয় রাত্রির মধ্যে একটি দিন ধরে নয় জন বালিকা কুমারীকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করা হয়।

এই ন’দিনে মায়ের নৈবেদ্য দেওয়া হয় নিরামিষ ভোগে। সেই ভোগই প্রসাদ হয়। কেবল দশমীর দিনে দই এবং মশলা দিয়ে তৈরি একটি বিশেষ পানীয় দেবী দুর্গার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। মনে করা হয়, মহিষাসুরের সঙ্গে নয় দিনব্যাপী ভীষণ যুদ্ধের পরে দেবী ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত। এই বিশেষ পানীয় তৃষ্ণা নিবারণ করে তাঁকে সজীব করে তুলবে।

তার পরে আসে দশমীর বিদায়ের দিন, মা অর্থাৎ বাড়ির গৃহকর্ত্রী শুইয়ে দেন মারাপাচি পুতুল দম্পতিকে। অর্থাৎ তাঁরা ঘুমিয়ে পড়লেন বছরকালের জন্য, কিন্তু রেখে গেলেন অক্ষয় আশীর্বাদ। সমস্ত পুতুলগুলিকে কাপড়ে পেঁচিয়ে সাবধানে কাচের বাক্সে তুলে রাখা হয়। মেয়ের বিয়েতে মা-বাবা কন্যা বিদায়কালে মেয়ে-জামাইয়ের কোলে তুলে দেন মারাপাচি পুতুল। মেয়ে তার নতুন সংসারে শুরু করবে গোলু উৎসব। এ ভাবেই বয়ে চলে গোলু। অখণ্ড আশীর্বাদ নিয়ে।

তথ্য সূত্র— Navaratri Golu: The Hindu Festival of Dolls by Anasuya Soundararajan

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement