ব্রহ্মার বরে নিজেকে অমর, অজেয় ভাবতে শুরু করেছিল মহিষাসুর। ঠিক সেই সময়েই তাকে বধ করে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়েছিলেন দশভূজা দেবী দুর্গা। মাতৃরূপী দেবী তখন রণরঙ্গিণী! তাঁকে রণসজ্জায় সজ্জিত করতে একে একে এগিয়ে এসেছিলেন দেবতারা। দিয়েছিলেন নানা অস্ত্র। আপাতদৃষ্টিতে সেগুলিকে যুদ্ধের হাতিয়ার বলে মনে হলেও আদতে কিন্তু এই প্রত্যেকটি অস্ত্রের উপস্থিতিই গভীর অর্থবহ। যেমন -
ত্রিশূল - দেবীকে ত্রিশূল প্রদান করেছিলেন দেবাদিদেব মহাদেব। মহিষাসুরের সঙ্গে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধের পরে এই ত্রিশূলই তার বুকে বিঁধিয়ে দিয়েছিলেন দশভূজা। ত্রিশূল আসলে মনুষ্য জীবনের ত্রিতাপ এবং ত্রিগুণের নির্ণায়ক। সেই কারণেই যুদ্ধের অন্তিম লগ্নে এই ত্রিশূলকে মারণাস্ত্র হিসাবে মহিষাসুরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন দেবী দুর্গা।
সুদর্শন চক্র - ত্রিদেবের অন্যতম, বিষ্ণু দেবীকে যে অস্ত্র প্রদান করেছিলেন, তা হল সুদর্শন চক্র। যা সর্বদা ঘূর্ণায়মান। অর্থাৎ, এই চক্র সময় তথা কাল ও গতিশীলতার প্রতীক। এই চক্র দেবীর আঙুলকে কেন্দ্র করে সর্বদা ঘুরতে থাকে। যার থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিশ্ব সংসারে যা কিছু ঘটছে, তার কেন্দ্রে রয়েছেন আদ্যাশক্তি স্বয়ং!
পদ্ম - ফুটে থাকা শতদল বা পদ্মফুল হল জ্ঞান ও বোধের প্রতীক। এই পদ্ম মহিষাসুরমর্দিনীকে অর্পণ করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। দেবীর হাতে আধফোটা পদ্ম থাকার অর্থ হল - মানুষের মনে যে চেতনা সুপ্ত হয়ে থাকে, কালক্রমে সেই চেতনাই তার উত্থানের পথ প্রশস্ত করে।
তির ও ধনুক - মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের প্রাক্কালে উমাকে তির ও ধনুক দিয়েছিলেন বনদেব ও সূর্যদেব। তির-ধনুক চালানোর নিয়ম হল - প্রথমে ধনুকের জ্যা টেনে শক্তিকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত করতে হবে এবং তার পরে সেই শক্তি ব্যবহার করেই তির ছুড়তে হবে, যা নির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদ করবে। এর থেকে বোঝা যায়, আসলে এই মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তি ও গতি দেবীরই পরিবর্তিত রূপ।
তরবারি - এটি একটি ধারালো অস্ত্র। যে অস্ত্র দেবী পেয়েছিলেন সিদ্ধিদাতা গণেশের কাছ থেকে। গণপতি যেমন বুদ্ধি ও সিদ্ধি প্রদান করেন, তেমনই তাঁর প্রদান করা তরবারিও ক্ষুরধার বুদ্ধি ও জ্ঞানের প্রতীক। যা অজ্ঞানতার অন্ধকারকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেয়।
বজ্র - দেবরাজ ইন্দ্রের দেওয়া অস্ত্র হল বজ্র, যা দৃঢ়তার প্রতীক। অশুভ শক্তি দমনে দেবীর প্রহার যে অদম্য, এই অস্ত্র সেটাই প্রমাণ করে। সেই কারণেই ইন্দ্র মহামায়াকে নিজের অস্ত্র প্রদান করেছিলেন।
বর্শা - বর্শার ফলা তীক্ষ্ণ, যা বুদ্ধিমত্তা নির্দিষ্ট করে। এই অস্ত্র দেবী লাভ করেছিলেন অগ্নিদেবের কাছ থেকে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিই ঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে এবং সঠিক পথ বেছে নিতে শেখায়।
সর্প - সাপ যে ভাবে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে, মানুষের অন্তরেও সে ভাবেই শুদ্ধ চেতনা সুপ্ত হয়ে থাকে। সেই ভাবনাই জড়িয়ে আছে শেষনাগের দেওয়া এই নাগপাশ অস্ত্রে।
কুঠার ও বর্ম - কুঠার অসীম সাহসের প্রতীক। যার আঘাত প্রকাণ্ড বৃক্ষের কাণ্ডের মতো শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতাকেও টুকরো টুকরো করে দেয়। আবার বর্ম হল চিন্তা শক্তি ও জ্ঞানের প্রতীক, যা অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে সক্ষম। দেবীকে কুঠার ও বর্ম দিয়েছিলেন বিশ্বকর্মা।
গদা - যমরাজ দেবী দুর্গাকে যে গদা প্রদান করেছিলেন তা একইসঙ্গে আনুগত্য, ভালবাসা, ভক্তি, শক্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতীক। এই গদা ভাল ও মন্দের মধ্যে সহজেই প্রভেদ করতে সক্ষম।
শঙ্খ - হিন্দু শাস্ত্র মতে, শঙ্খের ধ্বনি অশুভের বিনাশ ঘটায় এবং যা কিছু শুভ, তাকে আহ্বান করে। দেবী দুর্গাকে শঙ্খ প্রদান করেছিলেন বরুণদেব। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।