শারদোৎসবের সময় দশভুজা দেবী দুর্গার কন্যা হিসাবে পূজিত হন সরস্বতী। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সময়েই মর্ত্যে আগমন ঘটে তাঁর। বিদ্যা, জ্ঞান, শিল্পকলা ও সঙ্গীতের দেবী হিসেবে তিনি পূজিতা হন। দেবীর রূপ যেমন শুভ্র, তেমনই তাঁর বাহনও শুভ্র, যাকে বলা হয় 'হংস' বা রাজহাঁস। কিন্তু এত প্রাণী থাকতে কেন হাঁসই হলেন তাঁর বাহন? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে হিন্দু পুরাণের গভীর দর্শন ও প্রতীক তত্ত্বের মধ্যে।
দেবী সরস্বতী ও তাঁর বাহন: দেবী সরস্বতী, বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী। তাঁর চার হাতের মধ্যে তিনটি হাত ধারণ করে বীণা, পুস্তক, জপমালা। আর তাঁর চরণতলে সদা উপস্থিত থাকে শুভ্র বর্ণের হংস বা রাজহাঁস। কেন এই রাজহাঁস দেবীর বাহন? উত্তর লুকিয়ে আছে এর বিশেষ গুণাবলীর মধ্যে।
রাজহাঁসের প্রথম গুণ - ‘নীর-ক্ষীর’ বিচার: হাঁসের সব চেয়ে বিখ্যাত ক্ষমতা হল 'নীর-ক্ষীর' বিচার। অর্থাৎ, জল মেশানো দুধ থেকে সে শুধু মাত্র দুধটুকু পান করতে পারে, জল ফেলে দিয়ে! এই ক্ষমতাই তাকে করে তুলেছে জ্ঞানের প্রতীক।
অসার ত্যাগ, সার গ্রহণ: 'নীর-ক্ষীর' বিচারের এই ক্ষমতা শিক্ষা জীবনের এক গভীর দর্শন তুলে ধরে। জীবনের চলার পথে কী গ্রহণযোগ্য আর কী বর্জনীয় — সেই জ্ঞান প্রদান করে হংস। এই ক্ষমতা আসলে মানুষকে অবিদ্যা থেকে বিদ্যাকে বা মন্দ থেকে ভালকে বেছে নেওয়ার শিক্ষা দেয়। জীবনের সমস্ত অসার, মায়া ও মিথ্যা ত্যাগ করে কেবল মাত্র সারবস্তু বা সত্য জ্ঞানকে গ্রহণ করার প্রতীক এই হংস।
শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক: দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহাঁসের রং শুভ্র, যা শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক। দেবী নিজেও 'সর্বশুক্লা' বা শুভ্রবর্ণা। রাজহাঁসের শুভ্র বা সাদা রং পবিত্রতা ও বিশুদ্ধ জ্ঞানকে বোঝায়। দেবী সরস্বতী নিজেও জ্ঞানময়ী ও দোষহীনা। তাই তাঁর সঙ্গে এই শুভ্র বাহনের সঙ্গত খুব স্বাভাবিক। এটি জ্ঞানের নির্মলতা ও আধ্যাত্মিকতার ইঙ্গিত দেয়।
একাগ্রতা ও শৃঙ্খলা: জ্ঞান অর্জনের জন্য দরকার একাগ্রতা ও শৃঙ্খলা। এই দুটি গুণও রাজহাঁসের মধ্যে বিদ্যমান। তাই সে বিদ্যার দেবীর যোগ্য বাহন। তা ছাড়া, হিন্দু শাস্ত্রে রাজহাঁসকে শৃঙ্খলা ও উৎকর্ষের প্রতীক হিসাবেও গণ্য করা হয়। এক জন শিক্ষার্থী বা জ্ঞান অন্বেষণকারীর জীবনে এই দুটি গুণ অপরিহার্য। হংস দেবীর কাছে এসে এই গুণের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
ত্রি-লোকে বিচরণ ক্ষমতা: রাজহাঁস জল, স্থল ও আকাশে বিচরণ করতে পারে। এই ত্রিমুখী গতিশীলতা জ্ঞানের তিনটি স্তর বা প্রদেশ চিহ্নিত করে। অন্য দিকে, জ্ঞানের দেবী হিসেবে সরস্বতীর বিচরণ সমস্ত জ্ঞান ও সৃষ্টিতত্ত্বে। তাই সব প্রদেশেই বিচরণকারী হংস তাঁর বাহন হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
'হংস' এবং 'পরমহংস' ধারণা: হাঁস বা 'হংস' শব্দটি ভারতীয় দর্শনে আরও গভীর তাৎপর্য বহন করে। 'পরমহংস' উপাধি আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের সর্বোচ্চ স্তর বোঝায়। 'হংস' শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় 'আত্মা' বা 'পরমাত্মা'র সঙ্গে যুক্ত। যে ব্যক্তি বা সন্ন্যাসী 'পরমাত্মা' সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে জীবনের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছন, তাঁকে 'পরমহংস' উপাধি দেওয়া হয়। সরস্বতীর বাহন সেই 'পরম জ্ঞান' লাভের ইঙ্গিত দেয়।
কামুকতার থেকে ঊর্ধ্বে জ্ঞান: পৌরাণিক মতে, সরস্বতীকে সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার স্ত্রী হিসাবেও দেখা হয়। হাঁস প্রায়শই ব্রহ্মার বাহনও বটে। একটি মত অনুসারে, ব্রহ্মার অহংকার দূর করতে সরস্বতী হাঁসকে বাহন হিসাবে গ্রহণ করেন। আবার অন্য মতে, ব্রহ্মার সৃষ্টির কাজে তাঁর শক্তি (সরস্বতী) যখন সক্রিয় হন, তখন তাঁর বাহন হংস জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়। এই সম্পর্ক জাগতিক কামুকতা থেকে ঊর্ধ্বে জ্ঞানের সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করে।
জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব ও জ্ঞান: হংসকে মোক্ষ বা আধ্যাত্মিক মুক্তির প্রতীক হিসাবেও ধরা হয়। এটি সংসার চক্র থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করে। এর দ্বারা বোঝানো হয়, জীবনের ক্ষণস্থায়ী সব কিছু বর্জন করে চিরন্তন সত্য ও জ্ঞান খুঁজে নেওয়া উচিত। এই অনুসন্ধানই মুক্তি বা মোক্ষের পথ। এই সমস্ত গুণের কারণেই দেবী সরস্বতী রাজহাঁসকে তাঁর বাহন হিসাবে বেছে নিয়েছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। (‘আনন্দ উৎসব ২০২৫’-এর সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছেন একাধিক সহযোগী। প্রেজ়েন্টিং পার্টনার ‘মারুতি সুজ়ুকি অ্যারেনা’। অন্যান্য সহযোগীরা হলেন ওয়েডিং পার্টনার ‘এবিপি ওয়ানস্টপ ওয়েডিং’, ফ্যাশন পার্টনার ‘কসমো বাজ়ার’, নলেজ পার্টনার ‘টেকনো ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি’, ব্যাঙ্কিং পার্টনার ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’, কমফোর্ট পার্টনার ‘কার্লন’।) (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।