Durga Puja 2022

সুভাষগ্রামের ঘোষ বাড়িতে একই মূর্তিতে দেবী কালী ও দুর্গার চিরাচরিত আরাধনা

মায়ের এই দুই রূপই একত্রে পুজিতা হয়ে আসছে বাংলার প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রামের দুর্গাবাড়িতে।

Advertisement

আনন্দ উৎসব ডেস্ক

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৫০
Share:

ভারতবর্ষ দুর্গা দেবী আরাধনl শুরু প্রাচীন বৈদিক যুগ থেকে। দেবী আরাধনার পাশাপাশি দেবী মূর্তির ইতিহাসও অনেক পুরানো। আজ মহাশক্তির মহিষাসুরমর্দিনী যে প্রচন্ডা রূপ আমরা দেখি তার আবির্ভাব অনেক পরে পুরাণের যুগে। তখনকার সেই মূর্তি ছিল বাসন্তী দেবীর। তারপর অনেক রকমের ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে আজ দশ ভূজা মা দুর্গা আমাদের পরম আরাধ্যা, দেবীর অনেক রূপ শাস্ত্রের বর্ণনায় তার মধ্যে অন্যতম একটি বিশেষ রূপে দেবী পুজো পেয়ে আসছেন অনেক বছর ধরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রামে।

Advertisement

দেবী দুর্গা ও দেবী কালিকা-শক্তির দুই রূপ। মাতৃ পূজার এই পৃথক দুই রূপই বাংলার দিকে দিকে প্রচলিত। কিন্তু মায়ের এই দুই রূপই একত্রে পুজিতা হয়ে আসছে বাংলার প্রত্যন্ত এক অঞ্চলে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রামের দুর্গাবাড়িতে। দেবী শারদা এখানে আরাধ্যা অর্ধ কালী অর্ধ দুর্গারূপে। ১৫৯ বছরের প্রাচীন পুজোটির পিছনে রয়েছে একটি ছোট্ট অথচ সুন্দর ইতিহাস।

১৮৬৪ সালে পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডলের জাঁদরেল দারোগা হরিকিশোর ঘোষ একরাত্রে স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন জগজ্জননী মায়ের। সঙ্গে সঙ্ঙ্গে শুরু হল পুজোর তোড়জোড়। এক শুভতিথিতে সূচনা করলেন মূর্তি তৈরির কাজ। ধীরে ধীরে চিন্ময়ী দেবী রূপ পেতে লাগলেন মৃন্ময়ী প্রতিমায়। কিন্তু মূর্তি তৈরির একেবারে শেষ পর্যায় পটুয়ারা হলুদ রঙ করা মাত্রই মূর্তির ডানদিকের অংশের রঙ বদলে যায় কালো রঙে। তখন হরিকিশোরের মনে পড়ল তার স্বপ্নের দেবীমূর্তিও যেন ঠিক সাধারণ ছিল না। এই সঙ্কটের মুহূর্তে কুলপুরোহিত তাকে উপদেশ দিলেন দেবীকে অর্ধকালী অর্ধদুর্গা রূপ দিতে। সেই থেকে আজও মা এই নতুন রূপে সুভাষগ্রামের ঘোষদের বসতবাটীতে সাড়ম্বরে পুজিতা। দেশভাগের পর ঘোষ বংশের উত্তরপুরুষরা চলে এসেছেন এপার বাংলায়, সঙ্গে এনেছেন পূজার কিছু তৈজস পত্র ও বলিদানের খড়গ|| আর এনেছেন ওপার বাংলার পুজো বেদির একমুঠো মাটি, যা রয়ে গেছে এখনকার পুজোর দালানের মাটির মিশেলে| অনেক প্রতিকূলতা এসেছে, কিন্তু দুর্গাপুজোর ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি কখনও।

Advertisement

নির্দিষ্ট মাপের পাটাতনের ওপর একচালার প্রতিমা। দেবীর শরীরের ঠিক মাঝ বরাবর চুলচেরা ভাগ- ডানদিকে অমানিশারূপী দেবী কালিকা এবং বামদিকে তপ্তকাঞ্চনবর্ণা দেবী দুর্গা। দশ হাতে দশপ্রহরণ ধারিণী দেবীর ডান পা সিংহের পিঠে আর বাম পা অসুরের স্কন্ধে স্থাপিত। মহিষাসুর দেবী কালিকার হস্তধৃত শূলে বিদ্ধ। স্বর্ণবর্ণা লক্ষ্মী এবং শুভ্রবর্ণা সরস্বতী দেবীর ডান ও বাম পাশে থাকলেও চিরকুমার কার্তিক থাকেন দেবীর ডানপাশে, বিঘ্নবিনাশক গনেশ বামদিকে। পুত্রকন্যাসহ জগন্মাতার এই রূপই স্বপ্নে দেখেছিলেন হরিকিশোর। প্রতিটি মূর্তিই অপরূপ সাজে সজ্জিতা ও স্বর্ণরৌপ্য অলংকারে ভূষিতা।

মায়ের এই বিশেষ রূপের মতন পুজোর আচার-বিধিও কিছু ভিন্ন। বৃহৎনান্দীকেশ্বর পুরাণ মতে পুজো হয়ে থাকে। ললিতাসপ্তমী তিথিতে হয় কাঠামোপুজো। পুরানো প্রথানুযায়ী ঠাকুরদালানেই প্রতিমা তৈরি হয়। সপ্তমীর সকালে চক্ষুদান ও প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর হয়ে থাকে মহাস্নান। মায়ের প্রতীকরূপে দর্পনকে স্নান করানোর রীতি এখানে। স্নানে লাগে ১০৮রকমের জল। যেমন- তিন সমুদ্রের জল, গঙ্গার জল, দুধ, শিশির, মধু ইত্যাদি। পুজোর প্রতিটি পর্ব চলে ঘড়ির সূক্ষ্ম হিসাব অনুযায়ী। পুজোর তিনদিনই একটি করে আখ, চালকুমড়ো বলি হয়, নবমীর দিন থাকে শত্রু বলি.| চালের পিটুলি দিয়ে মানুষের আকৃতি গড়ে কচু পাতায় মুড়ে বলি হয় এটি ষড় রিপু কে দূর করার প্রতীকী অনুষ্ঠান| অন্নভোগ দেওয়ার রীতি নেই এখানে। পরিবর্তে সাড়ে বারো কেজি কাঁচা চালের নৈবেদ্য হয়। দশমীর ভোগে থাকে একবারে গ্রাম বাংলার আয়োজন, বোরো ধানের চাল, কচুর লতি, শালুক শাপলা শাক, আমড়া ইত্যাদি!| ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং চালকুমড়ো বলি দিয়ে হয় সন্ধিপূজা| দশমীর সকালে দর্পন বিসর্জন হয়। সন্ধ্যাবেলা বাড়ির সধবা মহিলারা দেবীকে বরণ করেন। এরপর বাড়ির পুরুষেরা মহা সমারহে দেবীকে বিসর্জন দেন বাড়ির পুকুরে। এই ভাবেই আভিজাত্য ও বনেদিয়ানায় আজও পুজো হয় সুভাষগ্রামের ঘোষ বাড়িতে।

এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন