ক্যামেরা হাতে কলকাতায় ও-পার বাংলার গেরিলারা

ঢাকা পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে এক বিকেলে জমাট বেঁধেছিল সঙ্কল্প। তার কয়েক দিন আগেই মৌলবাদীদের চাপাতির ঘায়ে খুন হয়েছেন মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়। চিত্রপরিচালক রাকিবুল হাসানের ডাকে জড়ো হয়ে তখন কিছু একটা করার জন্য ছটফট করছেন ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীলের মতো এক ঝাঁক তরতাজা তরুণ।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৬ ১০:৪৯
Share:

প্রতিবাদে সরব বাংলাদেশ। —ফাইল চিত্র

ঢাকা পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে এক বিকেলে জমাট বেঁধেছিল সঙ্কল্প। তার কয়েক দিন আগেই মৌলবাদীদের চাপাতির ঘায়ে খুন হয়েছেন মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়।

Advertisement

চিত্রপরিচালক রাকিবুল হাসানের ডাকে জড়ো হয়ে তখন কিছু একটা করার জন্য ছটফট করছেন ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীলের মতো এক ঝাঁক তরতাজা তরুণ।

অনেক বাধা অতিক্রম করে সেই স্বপ্ন আজ একটা রূপ পেয়েছে। কিন্তু তত দিনে বাবু এবং নিলয়কেও সরিয়ে দিয়েছে ঘাতকের অস্ত্র। যার ফলে অভিজিতের সঙ্গে তারাও এখন রাকিবুলের তথ্যচিত্রের বিষয়। মৌলবাদের থাবায় বেসামাল বাংলাদেশে বার বার মুক্তচিন্তার টুঁটি চেপে ধরার সেই সব কাহিনি নিয়ে রাকিবুলের তথ্যচিত্র ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’ এখন কলকাতায় ঢুকে পড়েছে, যার কলাকুশলীরা অনেকেই পরিচয় লুকিয়ে গেরিলা কায়দায় দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরতে তৎপর।

Advertisement

নেটরাজ্যে সাড়া ফেলেছে বাংলাদেশ-পরিস্থিতি নিয়ে আরও একটি তথ্যচিত্র। ইংরেজি ধারাভাষ্যে সে ছবির নাম ‘রেজরস এজ’ (ক্ষুরের ধার)। দেশে থাকা বন্ধুদের সাহায্যে নেদারল্যান্ডসে বসে জনৈক বাংলাদেশির কাজ। ১৮ মিনিটের তথ্যচিত্রেও কলাকুশলীদের অনেকের নাম গোপন রাখতে হয়েছে। পরিচালক নিজেও ‘নাস্তিকের ধর্মকথা’ ছদ্মনামে।

গুলশানের রেস্তোরাঁয় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের অসুখের ভাইরাস খুঁজতে সক্রিয় হয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। কিন্তু হিংস্র মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে মুক্তচিন্তকদের এই সব তথ্যচিত্র বাংলাদেশে যত্রতত্র দেখানোর পরিস্থিতি এখনও নেই। অভিজিতের মৃত্যুর এক বছর বাদে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাকিবুলের ছবিটি প্রথম ঢাকায় দেখানো হয় কয়েক জন আমন্ত্রিত বন্ধুকে। সে ছবি এখন পৌঁছেছে কলকাতায়। ‘আমরা— এক সচেতন প্রয়াস’ নামে একটি মঞ্চের উদ্যোগে ছবিটির একটি প্রদর্শনীও হয়েছে। আরও কয়েকটি শো হওয়ার কথা এ শহরে। ব্রিটেন ও সুইডেনেও ছবিটি দেখানোর তোড়জোড় চলছে।

চিত্রপরিচালক রাকিবুল হাসান

তবে জঙ্গিদের রোষ এড়াতে নির্মাতারা এখনই ছবিটি ইন্টারনেটে দিতে চান না। কলকাতায় বসে রাকিব ও তাঁর বন্ধুরা বলছিলেন, কী ভাবে একে একে তাঁদের অনেক বন্ধু জঙ্গিদের চাপাতির শিকার হয়েছেন। ইউনিটের এক সদস্যের কথায়, ‘‘ফেসবুকের একটি সিক্রেট গ্রুপের জন্য আমরা কয়েক জন ছবি তুলেছিলাম। বিপদের আশঙ্কায় বাবু ছবি তুলতে চাইছিল না। আর সেজেগুজে ছবি তুলেছিল নিলয়। দু’জনেরই কিন্তু একই পরিণতি ঘটল!’’ গত বছর মার্চে বাবু খুন হন। নিলয় তার মাস দু’য়েক বাদে। ছবিটির কাজে সামিল হতে সিলেটের অনন্তবিজয় দাসকেও অনুরোধ করেছিলেন নির্মাতারা। কিন্তু খুন হয়ে যান তিনিও। একের পর এক বন্ধুর মৃত্যুই ছবিটি তৈরির জেদ আরও বাড়িয়ে তোলে।

ঠিক কী দেখানো হয়েছে এ সব তথ্যচিত্রে? রাকিবুলের কথায়, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের পরে শেখ মুজিবুর রহমান যে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের আদর্শ মেলে ধরেছিলেন, তা থেকে কী ভাবে ধাপে ধাপে দেশটা সরে আসছে, সেটাই তুলে ধরেছি আমরা।’’ তাঁর মতে, গুলশানে জঙ্গি হামলা, ভিন্ধর্মের পুরোহিত-যাজক, বা ব্লগার খুন— বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। এক যুগ আগে ঢাকায় লেখক হুমায়ুন আজাদ খুন বা তারও আগে যশোরে ‘উদিচী’ শিল্পী গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে বিস্ফোরণেই এর বীজ ছিল। রাকিবুল বলছিলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে ছিটকে গিয়েই দেশ আজ এই দুর্গতিতে পড়েছে।’’

ও বাংলায় মৌলবাদীদের হিংস্র মুখটি দেখিয়েছে ‘রেজরস এজ’ ছবিটিও। প্রাণহানির আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন মুখ ঢাকা কয়েক জন মুক্তচিন্তক লেখক। দু’টো ছবিতেই মুখ খুলেছেন নিহত অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদ এবং বাবা অজয় রায়। রাকিবুলের তথ্যচিত্রে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবীরও জানিয়েছেন, ‘স্বাধীনতার শত্রুদের’ দাপাদাপিতে তিনি কতটা উদ্বিগ্ন।

কিন্তু এ সবের মধ্যেও আজকের বাংলাদেশের মনন থেকে উঠে আসছে আর এক লড়াইয়ের স্বর। কারও হাতিয়ার কলম-কম্পিউটার, কারও বা ক্যামেরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement