সিরিয়ায় বাহিনী

বেপাত্তা ২৬০, ছেলেধরার খোঁজে বাংলাদেশ পুলিশ

টিভির পর্দায় প্রথমে ফুটে উঠছে এক বাবা-মায়ের যন্ত্রণাকাতর মুখ। ধীরে ধীরে তার ওপর লেখা হচ্ছে তিনটি শব্দ— ফিরে আয় বাবা! ঢাকার গুলশনে হোলি আর্টিজান বেকারির অন্যতম হামলাকারী রোহান গত বছর ৩০ ডিসেম্বর নিপাত্তা হয়ে যাওয়ার পরে তার খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরেছিলেন তাঁর বাবা ইমতিয়াজ বাবুল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ঢাকা শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৬ ০৫:৫৯
Share:

টিভির পর্দায় প্রথমে ফুটে উঠছে এক বাবা-মায়ের যন্ত্রণাকাতর মুখ। ধীরে ধীরে তার ওপর লেখা হচ্ছে তিনটি শব্দ— ফিরে আয় বাবা!

Advertisement

ঢাকার গুলশনে হোলি আর্টিজান বেকারির অন্যতম হামলাকারী রোহান গত বছর ৩০ ডিসেম্বর নিপাত্তা হয়ে যাওয়ার পরে তার খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরেছিলেন তাঁর বাবা ইমতিয়াজ বাবুল। তার পরে ছেলের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখে জানিয়েছিলেন সেই আর্তি— ফিরে আয় বাবা!

সেই আর্তিই আজ প্রচারের ক্যাচ লাইন হয়ে উঠেছে ঢাকার সংবাদমাধ্যমে। প্রচারের বিষয়— ‘কারও ছেলে নিখোঁজ থাকলে এখনই পুলিশকে জানান।’ সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে একটি ফোন নম্বরও।

Advertisement

এ পর্যন্ত ২৬১ জন এমন ছেলের খোঁজ পেয়েছে পুলিশ। তার মধ্যে এক জন পরে ফিরে এসেছে। অর্থাৎ নিখোঁজের সংখ্যা ২৬০। যদিও অনেকে বলছেন, সব নিখোঁজের নাম র‌্যাবের তালিকায় ওঠেনি। প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।

হামলাকারীর বাবা হিসেবে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে ঢাকার আওয়ামি লিগের নেতা, পরিচিত ক্রীড়া প্রশাসক বাবুল ছেলে হারানোর যে কাহিনি শুনিয়েছিলেন, তা কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। বাবুল বলেছিলেন, ছেলের খোঁজ করতে গিয়ে তিনি জেনেছেন— কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর রোহানের মতো অনেক ছেলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি। তাদের কারও বাবা বিচারপতি, কারও সেনা অফিসার। কারও বাবা সরকারি আমলা, কারও আবার বেসরকারি সংস্থার শীর্ষকর্তা। বাবুল জানান, লোক জানাজানি এড়াতে অনেকে পুলিশের কাছে মৌখিক অভিযোগটুকুও জানাননি।

বাবুল বলেছিলেন, ‘‘আমি ব্যর্থ পিতা। কিন্তু আমার ভিতু ছেলের হাতে রাইফেল তুলে দিয়ে যে সব ছেলেধরা তাকে জঙ্গি বানিয়েছে— তাদের খুঁজে বার করুন। না হলে দেশ বাঁচবে না!’’

এর পরেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশের বিশেষ শাখা র‌্যাব (র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন)-কে নির্দেশ দেন, নিখোঁজ ছেলেদের তালিকা তৈরি করতে। শুক্রবার সেই তালিকা প্রকাশ করেছেন র‌্যাবের প্রধান বেনজির আহমেদ। তবে বাবুলের স্বীকারোক্তি প্রশাসনের উদাসীনতার একটি দিককেও চোখে খোঁচা দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আইএস (ইসলামিক স্টেটস)-এর মুখপত্র ‘দাবিক’-এর এপ্রিল সংখ্যাতেই আবু জান্দাল আল বেঙ্গলি নামে এক বাংলাদেশি জঙ্গির মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে বলা হয়েছিল, কী ভাবে এই সেনা অফিসারের ছেলে একটি কলেজের ভুয়ো কাগজপত্র দেখিয়ে সিরিয়ায় পালিয়ে এসেছিল। সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে সে লড়াইয়ের ময়দানে মারা পড়ে। আইএস-এর মুখপত্রেই জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে আসা তরুণদের একটি গোটা বাহিনীই রয়েছে সিরিয়ায়। তারা এক সঙ্গে থাকে, ‘কাজ’ও করে এক সঙ্গে। প্রশ্ন উঠেছে, দেশে জঙ্গি নিকেশে ব্যস্ত বাংলাদেশ সরকার কেন বিষয়টিকে তখন গুরুত্ব দেননি?

গুলশনে হামলার পরে প্রকাশিত আইএস-এর ভিডিওয় সিরিয়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে আরও বড় হামলার হুমকি দিতে শোনা গিয়েছে যে তিন তরুণকে, তার এক জনের বাবা এক সময়ে দেশের নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। র‌্যাব এখন খুঁজতে বেরিয়ে জেনেছে, খন্দকার রোকনউদ্দিন (৫০) নামে এক চিকিৎসক সপরিবার নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক জামাইকে নিয়ে তিনি প্রথমে মালয়েশিয়া যান। সেখান থেকে পৌঁছেছেন সিরিয়ায়। রোকনউদ্দিন নিজেই স্বজনদের বার্তা দিয়েছেন, ‘আইএস-এর শাসনে এসে মন ভরে গিয়েছে।’

র‌্যাব সূত্রে জানা গিয়েছে, নিখোঁজদের বেশির ভাগই তরুণ এবং বিত্তশালী পরিবারের ছেলে। বাড়ি থেকে তারা পাসপোর্টটিই শুধু নিয়ে বেরিয়েছে। কয়েক জন মধ্যবয়স্ক মহিলাও রয়েছেন তালিকায়। রয়েছেন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয় শিক্ষক ও কয়েক জন ডাক্তারও। তাঁরা প্রথমে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা ভারতে কিছু দিন থেকে তার পরে পৌঁছে গিয়েছেন সিরিয়ায়। কেউ কেউ বাড়িতে বার্তা পাঠিয়েছেন, ‘এরা আধুনিক সমাজ জীবনের সব আনন্দ উপভোগের সুযোগ দিচ্ছে।’ এক ডাক্তারের বার্তা— ‘কোনও ক্ষোভ নেই। দিব্য রয়েছি।’

নিপাত্তাদের খোঁজে বেরিয়ে পুলিশের বিশেষ শাখাটি নিশ্চিত হয়েছে, ইচ্ছুকদের সিরিয়ায় নিয়ে যেতে বাংলাদেশেই কোনও একটি চক্র কাজ করছে। তারাই ভিসা জোগাড় করে দেয়। অন্য দেশে রাখার পরে সিরিয়ায় পৌঁছে দেয়। এ জন্য যাবতীয় খরচও করে এই চক্রই। এই ছেলেধরা চক্রের খোঁজও এখন শুরু করেছে র‌্যাব। বাহিনীর এক কর্তার কথায়, ‘‘উচ্চবিত্ত ছাত্রদের দিকে ছেলেধরাদের নজর দেওয়ার একটা কারণ সম্ভবত পাসপোর্ট। মাদ্রাসার গরিব পড়ুয়াদের মাথায় জঙ্গিপনা থাকলেও তাদের অধিকাংশেরই পাসপোর্ট থাকে না, দেশ ছাড়ার জন্য যা চাইই চাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন