কোনও শঙ্কা ছাড়াই শেষ হল বিসর্জন। মা চলে গেলেন শিবঠাকুরের ঘরে। বাংলাদেশে নির্বিঘ্নে শেষ হল দু্র্গাপুজো। কয়েক মাস আগের পুরোহিত যাজক পীর আর মুক্তমনাদের ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড যে শঙ্কার মেঘ তৈরি করে ছিল- সেই মেঘের ছিটেফোঁটাও চোখে পড়েনি সারা বাংলাদেশের ২৯,৩৯৫টা পুজো মন্ডপে। গত বছরে এই সংখ্যা ছিল ২৯,০৭৪। এ বার যেমন পুজোর সংখ্যা বেড়েছে, তেমনই মানুষের ভীড় অতিক্রম করেছে গত অনেক বছরের রেকর্ড। মফস্বল, শহর থেকে গ্রাম- শহরতলী থেকে রাজধানী ঢাকা, সব জায়গাতেই এ বারের পুজোর দিনগুলো সত্যিই সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বছরের শুরুর দিকে যখন টার্গেট কিলিং শুরু হল, তখন সারা বাংলাদেশই থমকে গিয়েছিল। গ্রাম, শহরে পরপর কয়েকজন পুরোহিত হত্যার পর বিভিন্ন মন্দিরে প্রতিমা ভাঙা শুরু হল। কিছুটা হলেও ভয় পেয়েছিলেন বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়। তবে সাম্প্রতিক একের পরে এক জঙ্গী বিরোধী অভিযানে সেই মেঘ এখন কেটে গেছে। হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা নাড়া দিয়েছিল রাষ্ট্রের শেকড়ে। আমরা দেখলাম টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, পদ্মা থেকে কর্ণফুলির পাড়ের মানুষদের শেকড়ে ফেরা। দেখলাম মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কী ভাবে একত্র হল, আর তার ফলেই দেশের প্রায় প্রতিটা মানুষ হয়ে উঠলেন রাষ্ট্রের পাহারাদার। এক দিনে ৫০ লাখ মানুষ হাতে হাত রেখে মানববন্ধন গড়ে রচনা করল নতুন ইতিহাস। সেই ইতিহাস অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের গতিধারায় ফেরার ইতিহাস। লাইনচূত্য ট্রেনের নতুন করে লাইনে উঠে যাত্রার ইতিহাস। লাল সবুজের সেই যাত্রায় মানুষেরই জয় হল। জয় হল অসাম্প্রদায়িকতার।
এ বারের দুর্গা পুজোর বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল বাংলাদেশের কাছে। প্রথমত, সারা দেশে জঙ্গী দমনে একের পরে এক অভিযান চালানো হলেও দেশ জঙ্গীমুক্ত হয়ে গেছে এখনই এমনটা বলা সম্ভব নয়। নব্য জেএমবির চাঁইদের অনেকে কুপোকাত হলেও তারা একেবারে শক্তিহীন হয়ে এখনও মুখ থুবড়ে পড়েনি। সে ক্ষেত্রে সারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা ২৯৩৯৫টা মন্ডপের মধ্য কয়েকটাতে তান্ডব চালানোর শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায়নি। আর সে কারনেই আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা প্রতিটা মানুষের জন্য চ্যানেঞ্জ ছিল আরও বড়। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনির এ বারের সফলতা এই ক্ষেত্রে শতভাগ। অন্য দিকে, প্রতি বছর পুজোর আগে প্রতিমা ভাঙার ঘটনার শঙ্কাও থাকে। সেই ঘটনাও এ বার উল্লেখ করার মতো ঘটেনি। গত বছরের সঙ্গে এ বছরের হিসেব করলেও অনেকটাই সাফল্য এসেছে নিয়ন্ত্রণে।
হোলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলা ১ জুলাইয়ের পর অনেকটাই থমকে দিয়েছিল বাংলাদেশের গতি। পথঘাট থেকে শপিং মল, সবখানেই ভয়টা ছিল প্রকাশ্য। কিন্তু কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় সফল অভিযানের পর থেকে বদলে যেতে শুরু করে ছবিটা। আবার শুরু হয় মানুষের বুক ভরে স্বাস নেওয়া। চালু হতে থাকে প্রায় বন্ধ হোটেল, রেস্তরাঁ, সব বড় মলগুলো। স্বাভাবিক গতি ফিরে পায় অর্থনীতির চাকা। ভয়কে জয়ের সেই লড়াই মানুষকে তার শেকড়ে ফিরিয়ে এনেছে।
১ জুলাইয়ের পর সেই আগের টার্গেট কিলিং-এর ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়েছে। সাধু, পুরোহিত, পীর হত্যার কারণে যে আতঙ্ক, তার মেঘটাও কেটেছে বিস্তর। আর একই সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ড সাধারণ মানুষের মনজগতে ফেলেছে বড় প্রভাব। বাঙালি পরিচয়কে প্রধান করে ধর্ম, বর্ণ, ভেদ ভুলে আবার সামনে এসেছে সেই স্লোগান, ধর্ম যার যার- রাষ্ট্র সবার।
বাংলাদেশ পুজো উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার পালের কাছে আনন্দবাজারের প্রশ্ন ছিল, এ বারের পুজোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক কী? তিনি বললেন, এবারে পুজোয় বাংলাদেশ অনেকটাই পিছনে ফেলেছে সাম্প্রদায়িকতাকে। ঢাকা সহ সারাদেশেই মানুষ কোনও ধর্মের ব্র্যাকেটে আটকে না থেকে উৎসবকে আপন করে নিয়েছে। যে কারণেই গত বহু বছরের রীতি ভেঙে এ বার মন্ডপগুলোতে পঞ্চমীর দিন থেকেই মানুষের সমাগম শুরু হয়েছিল। তাসব ধর্মের মানুষ যেমন আনন্দে সামিল হতে এসেছেন, তেমনই এসেছেন সামাজিক ও মানবিক বন্ধনের বার্তা নিয়ে।
বিজয়া দশমী উপলক্ষে মঙ্গলবার ছিল সরকারি ছুটির দিন। পুজো উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য সবগুলো বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করছে। জাতীয় দৈনিকগুলো পুজো উপলক্ষে বিশেষ সাময়িকী প্রকাশ করেছে। পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে পুজোর শুভকামনা জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ সরকারের মন্ত্রী সংসদ সদস্যরা প্রতি বছরের মতো এ বছরও বিভিন্ন মণ্ডপে গিয়েছেন। অভয় আর সাহস দিয়েছেন। জানান দিয়েছেন, ধর্ম যার যার- রাষ্ট্র সবার।
বাংলাদেশ পুজো উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তাপস কুমার পাল জানান, এই বছর ঢাকা বিভাগে মোট ৬ হাজার ৩৯৩টা, বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ৬০১টা, রাজশাহীতে ৩ হাজার ৩১৫টা, খুলনায় ৪ হাজার ৬৩২টা, ময়মনসিংহে ১ হাজার ৮৫৪টা, চট্রগ্রাম বিভাগে ৪ হাজার ১৫০টা, রংপুর বিভাগে ৫ হাজার ১০টা, সিলেটে ২ হাজার ৪৪০টা পূজা মণ্ডপপসহ সারা দেশে মোট ২৯ হাজার ৩৯৫টি স্থায়ী ও অস্থায়ী মণ্ডেপে শক্তির আরাধনা হয়েছে।
বিভিন্ন মণ্ডপে বিদেশিদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। হোলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে বিদেশিদের হত্যা করে যে সন্ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল সেটা আর নাই। বাংলাদেশ তার যে অসাম্প্রদায়িক রূপ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, সেই রূপেরই আবার উত্থান ঘটেছে এ বারের পুজোতে। মানুষের উৎসব মনে করিয়ে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের রক্তধারাকে- যে রক্তধারার কোন ধর্ম পরিচয় না, ছিল বাঙ্গালি পরিচয়।